৫৯ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২২ এপ্রিল, ২০২২ / ৮ বৈশাখ, ১৪২৯
হাঁসখালি ধর্ষণ কাণ্ড
সিবিআই তদন্তে উঠে আসছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ তৃণমূলীদের বাঁচাতে সুগভীর চক্রান্তের চমকে দেবার মতো তথ্য উঠে এলো হাঁসখালি কাণ্ডে। জানা গেল বেহায়া রাজ্য পুলিশের দুঃসাহসিক বেআইনি পদক্ষেপের কথা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রকাশ্যে টিভি ক্যামেরার সামনে ফৌজদারি কেস সাজানোর ফিকির যেভাবে বাতলে দেন তাঁর অনুপ্রেরণায় হাঁসখালি কাণ্ডে সেই পথেই এগিয়েছিল রাজ্য পুলিশ। তাঁরা নিহত নাবালিকার পরিবারের কিছু সদস্যকে অপরাধী সাব্যস্ত করার পথেই এগোচ্ছিল - হাঁসখালির দলবদ্ধ ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় সিবিআই তদন্তে উঠে এলো এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য। ১৮ এপ্রিল সিবিআই অফিসাররা হাঁসখালির নিহত নাবালিকার মা’কে জানিয়েছেন, তাঁর বয়ানের ভিত্তিতে হাঁসখালি থানার পুলিশ এফআইআর’এ নাবালিকার বাবা এবং জেঠতুতো দাদার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। কন্যাহারা মা বিস্মিত হয়ে বলেছেন, ‘একথা আমার জানাই নেই। আমি তো পুলিশের কাছে এমন কোনও বয়ানই দিইনি।’
এপ্রসঙ্গে ১৮ এপ্রিল কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম পুলিশের এই ভূমিকাকে ধিক্কার জানিয়ে বলেছেন, ‘তৃণমূল সরকারের পুলিশের কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। তদন্ত করার জন্য তো পুলিশের নিজের কুকুর আছে, তাদের ব্যবহার করুক। কলকাতায় বসে মমতা ব্যানার্জি শুঁকে যা বলেছেন সেই অনুযায়ী মিথ্যা কেস সাজিয়েছে কেন?’
পুলিশের এহেন চক্রান্তে একই সঙ্গে বেআব্রু হয়েছে ৪ এপ্রিল ঘটা ওই ন্যক্কারজনক ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা। তাঁদের এই তৃণমূলী দলদাসের মতো আচরণে রাজ্য জুড়ে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। কলকাতা প্রেস ক্লাবে বিশিষ্টজনদের উদ্যোগে একটি সাংবাদিক সম্মেলন থেকে গত ১৬ এপ্রিল ধর্ষকদের স্বার্থ দেখার অভিযোগ তুলে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে।
১৭ এপ্রিল হাঁসখালি শ্যামনগর গ্রামে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে নদীয়া জেলার বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ নিহত ধর্ষিতার বাবা এবং মায়ের সঙ্গে দেখা করেন। মহম্মদ সেলিম নিহতের মায়ের হাত ধরতেই তার বুকের উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন নাবালিকার মা। বাবা এবং জ্যেঠা সেলিমের হাত ধরে বলেন, আপনারা না থাকলে বিচারের জন্য লড়াই করতে পারতাম না। আমাদেরকেও ওরা মেরে দিত। পরিবারের সকলেই একযোগে দাবি করেছেন আমাদের কিছু দরকার নেই আমার মেয়েকে তো আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আমাদের শুধু সঠিক বিচার চাই, অপরাধীর শাস্তি চাই। মৃতার মা গর্জে উঠে বলেন এমন শাস্তি চাই যেন আর কোনো মায়ের কোল ফাঁকা না হয়। পার্টি নেতৃবৃন্দ সেই লক্ষ্যেই লড়াইতে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন তাঁদের।
গ্রামে ওই অসহায় পরিবারের মতোই আরও অনেক পরিবার তৃণমূলীদের অত্যাচার, ধর্ষণের হুমকি সংক্রান্ত নানা অভিযোগ এদিন বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের কাছে তুলে ধরেন। এদিন মহম্মদ সেলিমের সঙ্গে ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুমিত দে, পার্টি নেতা অলকেশ দাস, মেঘলাল শেখ, এস এম শাদি, পার্টি নেত্রী রমা বিশ্বাস সহ নদীয়া জেলার অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
১৬ এপ্রিল অল ইন্ডিয়া ল ইয়ার্স ইউনিয়নের রাজ্য নেতা মিহির দাস, বিনয় ঘোষ প্রমুখ সংগঠনের আইনজীবীদের একটি দল শ্যামনগরে আসেন এবং সমস্ত রকম আইনি সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন নিহতের পরিবারকে।
হাঁসখালির নিহত নাবালিকার মা বাবার সঙ্গে মহম্মদ সেলিম কথা বলার পর লাল ঝান্ডা হাতে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে হাঁসখালি রামনগর গ্রামের মানুষ শামিল হন। এদিন লাল ঝান্ডার মিছিল শুরু হতেই ভয়ের গণ্ডি পেরিয়ে তারা শুধু শামিলই হন নি, স্লোগানে গলা মিলিয়ে অপরাধীদের শাস্তির দাবি তুলেছেন। মিছিল শ্যামনগরের মাঠপাড়া থেকে কলাতলা বাজারে এসে শেষ হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সিপিআই(এম) নেতা মৃণাল বিশ্বাস। সভায় মহম্মদ সেলিম বলেন, ধর্ষিতার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে মুখ্যমন্ত্রী নিহত ছাত্রীর চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। আরএসএস যেরকম মৌলবাদী কায়দায় ধর্ষিতাকে দোষারোপ করে, মুখ্যমন্ত্রীও তাই করেন। এরকম করতে তাঁর লজ্জা করে না!
তিনি বলেন, রাজ্যের মানুষ জঙ্গলের রাজত্বে রয়েছেন। কোনো আইন-কানুন নেই। পুলিশের যাবতীয় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে চোর জোচ্চোর পাচারকারীদের রক্ষা করা। যারা ভোট লুট করে মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়, তারাই বেকারদের কাজ থেকে বঞ্চিত করে, তারাই এখন বাড়ির মহিলাদের ইজ্জত কেড়ে নিচ্ছে। আমরা শপথ নিতে এসেছি এই জঙ্গল রাজ আমরা শেষ করব।
কলকাতা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে বিশিষ্টজনেরা বলেন, রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ধর্ষকদের প্রতিনিয়ত অক্সিজেন জুগিয়ে চলেছে। তিনি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশ মন্ত্রীও বটে। সেই সূত্রে এই ব্যর্থতার দায়ভার তাঁর। তাই আমরা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি। আমরা রাজ্যে নতুন শাসকপক্ষ চাই, যারা রাজ্যকে নতুন দিশা দেখাতে পারবেন।
১৪ এপ্রিল হাঁসখালিতে ধর্ষণে মৃত নাবালিকার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মহিলা সমিতির নেত্রীরা এক মর্মান্তিক পরিবেশের মুখোমুখি হন। এর আগে মহিলা সমিতির এক প্রতিনিধিদল হাঁসখালি থানায় যান খুনিদের কঠোরতম শাস্তির দাবি নিয়ে স্মারকলিপি জমা দিতে। হাঁসখালি বাজারে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে এক বিক্ষোভসভাও সংগঠিত করা হয়। থানায় স্মারকলিপি জমা দিয়ে ও নাবালিকার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সভানেত্রী অঞ্জু কর ও রাজ্য সম্পাদিকা কনীনিকা ঘোষ বলেছেন, ‘‘হাঁসখালির ঘটনায় নাবালিকার মা আমাদের বলেছেন, ‘আমাদের সঙ্গে থাকুন, এর শেষ দেখে তবেই ছাড়বেন’। তাই আমরা মহিলারা প্রতিজ্ঞা করেছি, হাঁসখালির ঘটনার শেষ দেখার জন্য আমাদের যত দূর যেতে হয় যাব, ছাড়ব না।
এদিকে হাঁসখালি থানার সম্পর্কে আরও এক বিস্ফোরক তথ্য সামনে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চের রাজ্য প্রতিনিধিদলের তরফ থেকে। মঞ্চের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক অলকেশ দাস জানান, ৫ এপ্রিল ওই নির্যাতিতা কিশোরীর দেহ জোর করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর সেই দিনে সকাল সাড়ে দশটায় তপশিলি জাতিভুক্ত দিনমজুর পরিবারের ১৪ বছরের নাবালিকা যে স্কুলে পড়ত সেখানে ছুটি দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানতেন স্কুলের ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে কিন্তু হাঁসখালি থানা-জেলা প্রশাসন জানতে পারে নি ওই ছাত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা।
প্রসঙ্গত, কলকাতা হাইকোর্ট হাঁসখালি কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে গিয়ে যা বলেছে তা রাজ্যের প্রশাসনের নিরপেক্ষতার দিকে বড়ো রকমের অভিযোগের আঙুল তুলে দিয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে... “In the circumstances of the case and after considering the above legal position, we are of the opinion that in order to have fair investigation in the matter and to instill confidence in the family members of the victim and also the residents of the locality and the State, the investigation should be carried out by the CBI instead of the local police.”
তদন্তভার পাওয়ার পরে সেই কেস এখন সিবিআই হাতে পেয়ে দেখছে, নিহতের বাবা এবং জ্যেঠতুতো দাদার নাম এফআইআর’এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ধর্ষিতা কিশোরীর মৃত্যুর পরে পাঁচদিন হাঁসখালি থানার পুলিশ নিহতের বাবা মায়ের এফআইআর গ্রহণ করেনি। সে সময় একদিকে তৃণমূলের বাহিনী বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে গেছে, অন্যদিকে থানা হেনস্তা করে ফিরিয়ে দিয়েছে। পাঁচদিন পরে যখন ১০ এপ্রিল ধর্ষিতার মায়ের বয়ান পুলিশ রেকর্ড করতে বাধ্য হয়েছে তখনও কদর্য ভূমিকা নিয়েছে পুলিশ।
হাঁসখালির ধর্ষিতা কিশোরীকে প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করতে দেয়নি তৃণমূলের ধর্ষকরা। মেয়েটি মারা গেলে তারাই জোর করে দেহ তুলে নিয়ে গিয়ে শ্মশানে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছে। সিবিআই সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ নির্যাতিতার মায়ের বয়ানের রেকর্ডের সময়ে দেখিয়েছে যে, তাঁর স্বামী ও ভাসুরপোর সামনেই পোড়ানো হয়েছিল মেয়ের দেহ। আইন অনুযায়ী, ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া দেহ পোড়ানো মানে তা লোপাটের চেষ্টা। সেই কারণেই দেহ পোড়ানোর সময় ঘটনাস্থলে থাকা নির্যাতিতার বাবা ও জ্যেঠতুতো দাদার নাম ঢোকানো হয়েছে এফআইআর’এ। কিন্তু শ্মশানে দেহ জোর করে তুলে নিয়ে পোড়ানোর শেষপর্বে যে বাবা এবং দাদাকেও তৃণমূলের দুষ্কৃতীরাই তুলে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সেকথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বাবা এবং মা যে দু’বার থানায় গিয়ে হেনস্তা হয়ে ফিরে এসেছেন, সেকথাও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্তু সিবিআই’র কাছে সেই সব কথা এখন ক্ষোভের সঙ্গে উগরে দিয়েছেন নিহতের মা। হাঁসখালি থানায় শেষপর্যন্ত মায়ের যে বয়ান রেকর্ড করা হয়েছিল সেই অভিযোগপত্র কাকে দিয়ে লেখানো হয়েছিল, কার কথামতো কী লেখা হয়েছিল, তার মধ্যেও নৃশংস রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। খুনি ও ধর্ষকদের আড়াল করতে হাঁসখালির পুলিশ নিহতের বাবা ও আত্মীয়দের নামেই দেহ লোপাটের অভিযোগ সাজাতে ব্যস্ততা দেখিয়েছে, এটা স্পষ্ট। সিবিআই সঠিকভাবে তদন্ত করলে পুলিশ এই অপরাধে জড়িয়ে যাবে বলেই মনে করছেন অনেকে।
মহম্মদ সেলিম সাংবাদিকদের বলেছেন, জানি না এভাবে রাজ্যের কোথায় কত নিরীহ মানুষের নামে মিথ্যা কেস সাজিয়ে রেখেছে পুলিশ। মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশের উচিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের কুৎসিত চেহারাটা দেখা। একসময়ে রাজ্য পুলিশের সুনাম ছিল, কলকাতা পুলিশকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হতো। এখন তাদের কালীঘাট ইয়ার্ড বলে লোকে ব্যঙ্গ করছে। পুলিশের উচিত নিজেদের পুরানো সুনাম ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার।
তিনি বলেন, মানুষ পুলিশের ওপরে ভরসা রাখতে পারছেন না বলেই যেখানে যা ঘটনা ঘটছে সবেতেই সিবিআই তদন্ত চাইছেন। সিবিআই তদন্তে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে নারাজ সেলিম একথাও বলেছেন, ‘...সিবিআই’র কাজের ফলাফল না দেখে আমরা কোনও সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারছি না। সিবিআই যাতে দল বদল করানোর প্রক্রিয়া ছেড়ে প্রকৃত তদন্ত করে তার জন্যই গণআন্দোলনের চাপ তৈরির চেষ্টা করছি’...।