E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২২ এপ্রিল, ২০২২ / ৮ বৈশাখ, ১৪২৯

সোভিয়েত ইউনিয়নে ইউক্রেনের সংযুক্তি এবং লেনিন

শংকর মুখার্জি


জারের শাসনের রাশিয়াকে ‘জাতিসমূহের কারাগার’ বলেছিলেন লেনিন। যেখানে এথনিক সংখ্যালঘুদের সমস্ত অধিকারকে অস্বীকার করা হতো। সেই রাশিয়ায় একদিকে যেমন ছিল শ্রমিক-কৃষক মেহনতিদের ওপর জারের নিদারুণ শোষণ, একইভাবে এই সংখ্যালঘুদের ওপর চলত সংখ্যাগুরু রুশীয়দের এক মধ্যযুগীয় বর্বরতা। অক্টোবর বিপ্লবের পর সেই জাতিসমূহের কারাগারকে ভেঙেই লেনিনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রসমূহের যুক্তরাষ্ট্র (ইউএসএসআর)। বৈজ্ঞানিক গণতান্ত্রিক লেনিনীয় নীতিই ছিল এই নয়া-নির্মাণের মূল ভিত্তি। এই নীতি জারের শাসনে অত্যাচারিত নিপীড়িত জাতিসমূহকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিয়েছিল; এমনকী প্রয়োজনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারও তারা পেয়েছিল এই নীতিতে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই নীতির সফল প্রয়োগে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিকদিয়ে ওই নিপীড়িত জাতিসমূহের যে ঐতিহাসিক বিকাশ ঘটেছিল তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ে তিন দশকেরও বেশি সময় হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি ঘটেছে। চলতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে সেই অনুপম লেনিনীয় নীতিই রাশিয়ার বর্তমান শাসক পুতিনের আক্রমণের বিষয় হয়েছে। এই যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে ২১ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশে এক ভাষণ দেন পুতিন। সেখানে তিনি পৃথক ইউক্রেন সৃষ্টির দায় বলশেভিকদের ওপর চাপিয়ে বর্তমান ইউক্রেনকে ‘ভ্লাদিমির লেনিনের ইউক্রেন’ বলে আখ্যায়িত করেন।

অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েতসমূহের প্রথম নিখিল ইউনিয়ন কংগ্রেসের অধিবেশন বসে ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে। সেই অধিবেশনে লেনিন এবং স্তালিনের প্রস্তাবক্রমে সোভিয়েত জাতিগুলি স্বেচ্ছায় এক ইউনিয়নে মিলিত হয়। গড়ে ওঠে ইউএসএসআর। এইসময়ে ইউনিয়নে যুক্ত হয়েছিল রুশ সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ট্রান্স-ককেশীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র, বিয়েলোরুশিয়া সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এই ইউনিয়ন গড়ে ওঠার পর জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সহ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ওই জাতিসমূহের বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলি ১৯২৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নিপীড়িত জাতিসমূহকে দেওয়া এই সাংবিধানিক অধিকারগুলিকে পুতিন ওই ভাষণে ‘আদি পাপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এবং পূর্বতন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলিতে জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থানের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কমরেড লেনিনের ১৫৩ তম জন্মদিবসে আমরা একশ বছর আগের সেই ঘটনাবলিকে ইতিহাসের পাতায় দেখার চেষ্টা করব। দেখার চেষ্টা করব সেদিনের সেই ঘটনাক্রমে লেনিনের ঠিক কী ভূমিকা ছিল। তবে অবশ্যই অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে।

অক্টোবর বিপ্লবের পর বিপ্লবী শক্তিকে উচ্ছেদ করতে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং দেশের মধ্যে প্রতিবিপ্লবীরা একযোগে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল, তৈরি করল অবরোধ। বহির্জগতের সঙ্গে সমস্ত সমুদ্রপথ ও অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা রুদ্ধ করে দেওয়া হলো। দেশের প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলির মধ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধান ক্রীড়নক ছিল সাইবেরিয়া অঞ্চলের কোলচাক এবং ইউক্রেনের দেনিকিন। এদের সাহায্যকারী প্রধান বিদেশি শক্তি ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইতালি। সাম্রাজ্যবাদীরা কোলচাককে রুশ দেশের সর্বোচ্চ শাসক বলেও ঘোষণা করে। বিপ্লববিরোধী শক্তিগুলি কোলচাকের কর্তৃত্বাধীনে জড়ো হয়। ১৯১৯ সালের বসন্তকালে কোলচাকের বাহিনী ভলগা নদী পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। কমিউনিস্ট যুবসংঘের সভ্য ও শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত সোভিয়েত লালফৌজ কোলচাকের বহিনীর বিরুদ্ধে কড়া প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এপ্রিল মাস থেকেই পর্যুদস্ত হতে থাকে প্রতিবিপ্লবী শক্তি। ১৯১৯ সালের শেষেরদিকে কোলচাকের বাহিনী সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হলো; বন্দী হলো স্বয়ং কোলচাক। বিপ্লবী কমিটি তার মৃত্যুদণ্ড দিল। কোলচাকের পরাজয়ে সোভিয়েত রাশিয়াকে উচ্ছেদ করার বিদেশি হস্তক্ষেপকারীদের পরিকল্পনাকে সার্থক করতে পারল না। তারা তখন মনোযোগ নিবদ্ধ করল দেনিকিনের ওপর। সেইসময়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ‘স্বেচ্ছাবাহিনী’র সংগঠক সভাপতি ছিলেন দেনিনিক। কর্নিলভ চক্রান্তের সাকরেদও ছিলেন তিনি। দক্ষিণের কুবান অঞ্চলে তিনি সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।প্রসঙ্গত, উত্তর ককেশসে কর্নিলভ, আলেক্সিয়েভ এবং দেনিকিনের মতো সেনাপতিরা ব্রিটেন ও ফরাসীদের সমর্থনে শ্বেতরক্ষী ‘স্বেচ্ছাবাহিনী’ গঠন করেছিল। কসাকদের উচ্চশ্রেণির মধ্যে এরাই বিদ্রোহ বাঁধিয়েছিল, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল।

বিদেশি শক্তিগুলি দেনিকিনকে প্রচুর গোলাগুলি এবং যুদ্ধাস্ত্র দিল সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণকে আরও জোরদার করতে। ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মকালে দেনিকিন বিদেশি সাহায্যে পুষ্ট হয়ে সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে বিরাট অভিযান শুরু করল। বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই রণাঙ্গনে স্তালিন, ভরোশিলভ, অর্জনিকিদজে এবং বুদিয়নিকে পাঠায়। ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ওরেল এবং ভরোনেঝের যুদ্ধে লালফৌজের কাছে দেনিকিন পরাজিত হয়। এই পরাজয়ের পরেও সাম্রাজ্যবাদীরা থেমে যায় নি। তারা য়ুদেনিচের সৈন্যবাহিনীকে দেনিকিনের বাহিনীর সাথে যুক্ত করে সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ সংগঠিত করে। এই যৌথবাহিনী এবারে প্রায় পেত্রোগ্রাদের ফটক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এখানেও কমিউনিস্টরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল, চূড়ান্তভাবে পরাজিত হলো এই প্রতিবিপ্লবী যৌথ বাহিনী। কোলচাক ও দেনিকিনের পতনের পর ১৯২০ সালের জানুয়ারি মাসে ইউক্রেন এবং উত্তর ককেশীয় অঞ্চল প্রতিবিপ্লবীদের কব্জা থেকে মুক্ত হলো। এই জানুয়ারি মাসেই সোভিয়েত রাশিয়া থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিল ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইতালি। তবে তখনও বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং গৃহযুদ্ধের হাত থেকে সোভিয়েত রাশিয়া সম্পূর্ণ মুক্ত হয়নি। পোল্যান্ডের আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল। দূরপ্রাচ্য, ট্রান্স-ককেশীয়া এবং ক্রিমিয়াতে অল্প হলেও প্রতিবিপ্লবী শক্তির ঘাঁটি ছিল। তা সত্ত্বেও এটা ছিল সোভিয়েতের বিপ্লবী শক্তির বড়ো জয়। এবং তারা তখন দেশগড়ার কাজে মনোযোগ দেওয়ার একটু সুযোগ পেল।

●  ●  ●

১৯১৯ সালের একেবারে শেষেরদিকে, ২৮ ডিসেম্বর, তখন জয় সুনিশ্চিত হলেও ইউক্রেন সম্পূর্ণ লালফৌজের কব্জায় আসেনি, - লেনিন ‘দেনিকিনের উপর বিজয়লাভ উপলক্ষে ইউক্রেনের শ্রমিক ও কৃষকদের প্রতি একটা খোলা চিঠি’ লেখেন। ‘প্রাভদা’য় ১৯২০ সালের ৪ জানুয়ারি চিঠিটি প্রকাশ হয়। ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে লেনিনের ভাবনার একটা ছবি ওই চিঠিতে পাওয়া যায়। চিঠিটি খুবই দীর্ঘ। পুরোটা উল্লেখ বা আলোচনা করার সুযোগ এখানে একেবারেই নেই। এই চিঠি লেখার চার মাস আগে কোলচাকের বিরুদ্ধে বিজয়লাভের মধ্যদিয়ে যখন উরাল ও সাইবেরিয়া মুক্ত হয়েছিল, তখন শ্রমিক এবং কৃষকদের প্রতি আরেকটি চিঠি লিখেছিলেন লেনিন। দ্বিতীয় চিঠিটিকে লেনিন সেই চিঠির সম্পূর্ণ অংশ বলে বর্ণনা করেছেন।

তৎকালীন পরিস্থিতিতে মহারুশ ও ইউক্রেনের মেহনতি জনগণ ও সোভিয়েত রাজের সামনে যে দায়িত্ব হাজির হয়েছিল চিঠিতে সে প্রসঙ্গের অবতারণা লেনিন প্রথমে করেনঃ
‘‘মহা-রাশিয়া ও ইউক্রেনের মেহনতি জনগণের সামনে যে সমস্ত এবং আরও অন্যান্য একই ধরনের কর্তব্য ছিল এবং আছে, তা ছাড়াও ইউক্রেনে সোভিয়েত রাজের সামনে বিশেষ কিছু‍‌ কর্তব্য রয়েছে। এই বিশেষ কর্তব্যসমূহের মধ্যে একটির প্রতি বর্তমানে জরুরি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এটি - জাতি সংক্রান্ত প্রশ্ন, অথবা প্রশ্ন হলো এই যে, ইউক্রেন কী রুশ সমাজতান্ত্রিক ফেডারেটিভ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে ইউনিয়নে (ফেডারেশনে) মিলিত হয়ে আলাদা ও স্বাধীনভাবে ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে অবস্থান করবে, অথবা অখণ্ড সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। এই প্রশ্নের ওপর সমস্ত বলশেভিককে, সমস্ত সচেতন শ্রমিক ও কৃষককে মনোযোগের সঙ্গে ভাবতে হবে।

রুশ সমাজতান্ত্রিক ফেডারেটিভ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সারা-রুশ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি এবং রুশ কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক) ইউক্রেনের স্বাধীনতা মেনে নিয়েছে। সুতরাং এটি স্বাভাবিকভাবেই সুস্পষ্ট এবং সাধারণভাবে মেনে নেওয়া চলে যে, একমাত্র ইউক্রেনের শ্রমিক ও কৃষকরা নিজেরাই তাদের সারা ইউক্রেন সোভিয়েত কংগ্রেসে এ প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং নেবেও; ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে, অথবা ইউক্রেন এক স্বতন্ত্র ও স্বাধীন প্রজাতন্ত্র রূপে অবস্থান করবে, এবং শেষোক্ত ক্ষেত্রে এই প্রজাতন্ত্র ও রাশিয়ার মধ্যে ঠিক কী ধরনের ফেডারেটিভ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।’’

এই ধরনের সংখ্যালঘু নিপীড়িত জাতিসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করতে কমিউনিস্টদের কী দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া উচিত, তার উল্লেখ করে চিঠিতে লেনিন বলছেনঃ ‘‘আমরা জাতিসমূহের স্বেচ্ছামূলক ইউনিয়নের পক্ষপাতী - তেমন ইউনিয়নের পক্ষপাতী, যা এক জাতির ওপর অন্য জাতি কোনোক্রমেই কোনোপ্রকার শক্তি প্রয়োগ করবে না - তেমন ইউনিয়ন, যা পরিপূর্ণতম বিশ্বাসের উপর, ভ্রাতৃত্বমূলক ঐক্যের বিশুদ্ধ সচেতনতার উপর, কম-বেশি স্বেচ্ছামূলক সম্মতিদানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। অনুরূপ ইউনিয়ন একেবারে সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তবায়িত হতে পারে না; তার আগে বিশেষ ধৈর্য ও সতর্কতার সঙ্গে বহু কাজ সমাপন করা প্রয়োজন, যাতে উদ্দেশ্য বিনষ্ট না হয়, যাতে অবিশ্বাস না জেগে ওঠে, যাতে অবিশ্বাস দূর হয়, যে অবিশ্বাস জমিদার ও পুঁজিপতির, ব্যক্তিগত মালিকনার খণ্ড-বিখণ্ড করার ফলে শত্রুতা ও নির্যাতন রূপে যুগ যুগ ধরে রয়ে গেছে।’’

ওই পরিস্থিতিতে মহারুশ ও ইউক্রেনের কমিউনিস্টদের কী করা থেকে বিরত থাকতে হবে সে প্রসঙ্গেও আলোকপাত করেছেন লেনিন ওই চিঠিতে।

‘‘মহারুশের কমিউনিস্টরা যদি রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সংযুক্তিকরণের জেদ ধরে, তাহলে ইউক্রেনীয়রা সহজেই তাদের দোষী বলে সন্দেহ করবে এই বলে যে, পুঁজির সঙ্গে সংগ্রামে প্রলেতারিয়েতের ঐক্যের কথা ভেবে তারা অনুরূপ নীতি সমর্থন করছে না, বরং তা করছে পুরানো মহারুশের জাতীয়তাবোধ ও সাম্রাজ্যবাদী কুসংস্কারের কথা ভেবে। এই অবিশ্বাস খুবই স্বাভাবিক, কোনো এক পর্যায় পর্যন্ত তা অবশ্যম্ভাবী ও আইনসম্মত, কেননা যুগ যুগ ধরে জমিদার ও পুঁজিপতিদের অত্যাচারের জোয়াল এবং মহারুশ শোভিনিজমের কলঙ্কজনক ও নোংরা কুসংস্কারের শোষণে মহারুশীরা নিজেকে হামবড়া বলে ভেবে এসেছে।

ইউক্রেনের কমিউনিস্টরা যদি ইউক্রেনের শর্তহীন রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য জেদ ধরে, তাহলে তাকে এই বলে দোষী করা চলে যে, সে অনুরূপ নীতি সমর্থন করছে পুঁজির জোয়ালের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় শ্রমিক ও কৃষকদের সংগ্রামের সাময়িক স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং পেটিবুর্জোয়া, ক্ষুদে ব্যাপারির স্বার্থানুকূল জাতিগত কুসংস্কারের বলে। কেননা অভিজ্ঞতা আমাদের শত শত বার দেখিয়েছে যে, নানা দে‍‌শের পেটি বুর্জোয়া ‘সমাজতন্ত্রীরা’ তার মধ্যে আছে নানা ধরনের পোলিশ, লাতভিয়, লিথুয়ানীয় সমাজতন্ত্রীরা, জর্জীয় মেনশেভিকরা, সোশ্যালিস্ট রেভলিউশনারিরা এবং আরও অনেকে - প্রলেতারিয়েতের সমর্থনে রঙ বদলেছে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্যসাধনে, অর্থাৎ কিনা লোকের চোখে ধূলো দিয়ে ‘নিজেদের’ জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বিপ্লবী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আপসমূলক নীতি অনুসরণ করা। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি-অক্টোবরে রাশিয়ায় এটা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কেরেনস্কি আমলের মাধ্যমে, এটা আমরা দেখেছি এবং দেখছি সমস্ত ও নানান দেশে।

এই একতা, এই সম্মিলনে যদি শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষ ব্যর্থ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কী বিপদ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তাও লেনিন উল্লেখ করেছেন ওই চিঠিতে।

‘‘এর সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হলো সমস্ত দেশের জমিদার ও পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে এবং নিজেদের একচ্ছত্র রাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশে তাদের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজনে প্রলেতারীয় একনায়কত্ব ও সোভিয়েত রাজ রক্ষার উদ্দেশে যৌথ কাজ। অনুরূপ যৌথ সংগ্রাম ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পরিষ্কারভাবে দেখাবে যে, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অথবা রাষ্ট্রীয় সীমারেখার প্রশ্নে যাই সিদ্ধান্ত হোক না কেন, মহারুশ ও ইউক্রেনীয় শ্রমিকদের মধ্যে অতি অবশ্যই প্রয়োজন নিবিড় সামরিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন, কেননা অন্যথায় ‘আঁতাত’, ‘ঐক্যবদ্ধ শক্তির’ পুঁজিপতিরা, অর্থাৎ ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান, ইতালির মতন সর্বাপেক্ষা ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলি আমাদের একের পর এক চাকার নিচে ফেলে ও গলা টিপে মেরে ফেলবে। এই পুঁজিপতিরা যাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল, সেই কোলচাক ও দেনিকিনের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামের দৃষ্টান্তই পরিষ্কারভাবে এই বিপদটি প্রদর্শন করেছিল।’’

চিঠির একেবারে শেষে দৃঢ়তার সাথে লেনিন এই আশাই ব্যক্ত করছেনঃ ‘‘সর্বপ্রকার বুর্জোয়ার জাতীয়তাবাদী ষড়যন্ত্রের ওপর, সর্বপ্রকার জাতীয়তাবাদী কুসংস্কারের ওপর বিজয়লাভ করতে এবং সোভিয়েত রাজের জন্য, জমিদার ও পুঁজিপতিদের নির্যাতন খতম করার জন্য, নিখিল বিশ্ব ফেডারেটিভ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে বিভিন্ন জাতির শ্রমিক ও কৃষকদের স্থায়ী মৈত্রীর যথার্থ দৃষ্টান্ত সমগ্র বিশ্বের মেহনতিদের দেখাবার জন্য ধৈর্যশীল, অপ্রতিরোধ্য ও অটল যৌথ কাজে রা‍‌শিয়া এবং ইউক্রেনের শ্রমিকরা সাফল্য লাভ করুক।

●  ●  ●

এটা ঠিক যে, শুধু ইউক্রেন নয় পূর্বতন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলিকে নিয়ে আমেরিকার আলাদা পরিকল্পনা ছিল। সেই কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইয়োরোপের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর যখন ওয়ারশ চুক্তির আর কোনো অস্তিত্ব রইল না, তখনও আমেরিকা ন্যাটো’কে ভেঙে দিল না। সে সময়ে গরবাচভকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে ন্যাটো’র কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু আমেরিকা সে প্রতিশ্রুতি তো রাখেইনি উল্টে ন্যাটো’কে আরও পূর্বদিকে সম্প্রসারিত করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সময় ন্যাটো’র সদস্য সংখ্যা ছিল ১৬। এখন ইউক্রেন এবং জর্জিয়া বাদে পূর্ব ইয়োরোপের সব দেশ ন্যাটো’য় যোগ দিয়েছে। ইউক্রেন ন্যাটোয় যোগ না দিলেও সেখানে বিরাট সামরিক পরিকাঠামো তৈরি করেছিল ন্যাটো। সবদিক বিচার করলে এটা পরিষ্কার যে, ন্যাটো রাশিয়ার নিরাপত্তার সামনে বর্তমানে সবচেয়ে বড়ো বিপদ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। বারবার রাশিয়া সেব্যাপারে আমেরিকা ও ন্যাটোকে সতর্ক করলেও তারা এব্যপারে কর্ণপাত করেনি। যা সমগ্র পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে। আসলে এ-যুদ্ধ আমেরিকা/ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার; ইউক্রেন হলো রঙ্গমঞ্চ, যেখানে এ-যুদ্ধ হচ্ছে।

পাশাপাশি এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, বৃহৎ রাশিয়া পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন রয়েছে পুতিনেরও। সেই বৃহৎ রাশিয়া পুনরুদ্ধারের প্রকল্পের পক্ষে জমি শক্ত করতে পৃথক ইউক্রেন সৃষ্টির দায় পুতিন বলশেভিকদের ওপর চাপিয়েছেন, লেনিনের নীতির বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। কিন্তু গত শতকের বিশের দশকে যখন বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদীদের উপনিবেশ ব্যবস্থা কায়েম ছিল, সেই পরিস্থিতিতে সোভিয়েতের বিপ্লবী সরকার ফিনল্যান্ডের মতো জারের সাম্রাজ্যে থাকা দেশগুলিকে স্বাধীনতা দিয়েছে; রুশ প্রজাতন্ত্রগুলির জন্য এক অনুপম নীতি তৈরি করেছে। সোভিয়েত রাষ্ট্রের সমগ্র ভূখণ্ড বিদেশিদের ও দেশীয় প্রতিবিপ্লবী শক্তিদের কবলমুক্ত হওয়ার পর সমাজতান্ত্রিক গঠনকাজ ও দেশরক্ষার জন্য জনগণের ঐক্যকে আরও সুসংহত করার প্রয়োজন দেখা দিল। প্রয়োজন দেখা দিল একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলিকে গ্রথিত করার। জনগণের সমস্ত শক্তিকে সম্মিলিত করতে হবে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার কাজে। বিপ্লবের পরই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির হস্তক্ষেপ ঘটেছিল। তাই দরকার ছিল দেশকে একেবারে অভেদ্য করার। এই সবের জন্যই লেনিন বুঝেছিলেন, প্রত্যেক সোভিয়েত জাতিতে আরও নিবিড় ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ করার। ইউএসএসআর গড়ে ওঠার দুবছর আগে ওই চিঠিতে কেন এই ইউনিয়ন গড়ে তোলা দরকার, শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষকে তার জন্য কী দায়িত্ব পালন করতে হবে, রুশ ও ইউক্রেনের কমিউনিস্টদের কী ভূমিকা হবে তার সম্পূর্ণ ভাবনা লেনিনের ওই চিঠিতে ফুটে উঠেছিল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাফল্যের যে শিখরে উঠেছিল তাতে এই প্রজাতন্ত্রগুলির সম্মিলনের বিরাট অবদান ছিল। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই সমস্ত কিছুর বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ছাড়াই বলশেভিক পার্টি এবং লেনিনের প্রতি পুতিনের এই খেদোক্তি ইতিহাসের অপব্যখ্যা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যাবে!