৫৯ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২২ এপ্রিল, ২০২২ / ৮ বৈশাখ, ১৪২৯
জলাভূমি রক্ষায় লড়াই করছে জলাভূমি রক্ষা কমিটি
বিশেষ প্রতিনিধিঃ গত ২৭ অক্টোবর জলাভূমি রক্ষার দাবিতে বহরমপুর শহরে অনশনে বসা পরিবেশ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বহরমপুরে ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর এই তিনদিনের রিলে অনশনের ঘোষণা এবং প্রশাসনের অনুমতি ছিল আগে থেকেই। অতিমারীকে অজুহাত করে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের সুযোগ নিয়ে সরকার অনশন আন্দোলনের প্রথম দিনই গ্রেপ্তার করে অনেক প্রবীণ মানুষসহ পরিবেশ কর্মীদের।
রাজ্য সরকার ২০১১-১২ সালে একটি স্লোগান বার বার প্রচারে আনছিল। এখন তা খুব একটা চোখে পড়েনা। স্লোগানটি ছিল ‘জল ধরো-জল ভরো’। যদি জলাভূমি না থাকে তাহলে জল ধরে জল ভরবেন কোথায়? জলাভূমি না থাকলে মাটির নিচের জলস্তর শুকিয়ে ব্যবহারযোগ্য জলের টান পড়তে বাধ্য। প্রশাসনের নাকের ডগায় বুজিয়ে ফেলা জলাভূমি রক্ষার আন্দোলনকে প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে থামিয়ে দিয়ে যে বার্তা সরকার দিল তা জল সংরক্ষণ বিরোধী।
জলাভূমি কমছে। খবরটা আজ আর নতুন নয়। ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য, বিনষ্ট হচ্ছে মৎস্যসহ জলজ উদ্ভিদের উৎস। বর্ষার জল সংরক্ষণের জায়গা কমছে, মাটির নিচের জলস্তর নেমে যাচ্ছে হু-হু করে। এর পরিণতি যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে বার বার অবহিত করার যে প্রয়াস তাতে ঘাটতি আছে। সরকার নির্বিকার। এমনকী চাষবাসের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা সেচ ও প্রাত্যহিক কাজকর্ম নিয়ে যতটা আগ্রহী জলাভূমি এবং তার সংরক্ষণ নিয়ে ততটা ভাবিত নন। এর কারণ জলাভূমি কাকে বলে এবং পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তৈরি করার জন্য মুর্শিদাবাদ জলাভূমি রক্ষা কমিটি শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন শুরু করে।
মুর্শিদাবাদের আক্রান্ত জলাধারগুলির মধ্যে বহরমপুর শহরের কাছে চালতিয়া বিল এবং বিষ্ণুপুর বিল এখন গভীর সংকটে। জল নিকাশির ক্ষেত্রে চালতিয়া বিলের গুরুত্ব অপরিসীম। সুবিশাল এই চালতিয়া বিলের আয়তন প্রায় ৩৫ একর। কতটা গায়েরজোরে জমি মাফিয়ারা দখল করে রেখেছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া ভার। একদিকে জলাভূমি ভরাট এবং অন্যদিকে সরকারি তথ্য সংরক্ষণের ঘাটতি এই সম্পর্কে মানুষকে অন্ধকারে রেখেছে। সরকারি আমলারা মনে করেন এই বিল যেন তাদের সম্পত্তি এবং সে ব্যাপারে মানুষকে জানানোর দায়িত্ব তাদের নয়। এই ক’দিন আগেও প্রতিদিন চালতিয়া বিলের তিন কুইন্টাল মাছ বাজারে পাঠান হতো। প্রায় ৩০০ মৎস্যজীবী পরিবারের জীবন-জীবিকা এই বিলের সঙ্গে যুক্ত। একাধিকবার এই বিল ভরাটের অভিযোগ উঠেছে। গত ২৩ অক্টোবর সর্বসমক্ষে ফের এই বিলের একাংশ ভরাটের অভিযোগ ওঠে। ট্রাক্টর করে মাটি এনে বিলের একাংশে মাটি ফেলে ভরাট করা হয়। ফলে সরব হয়েছিলেন জলাভূমি রক্ষা কমিটির সদস্যরা। সঙ্গে প্রতিবাদে নামেন স্থানীয় ভাকুড়ি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্যরা।
বিষ্ণুপুর বিল আয়তনে প্রায় ৮৩ একর। বহরমপুর শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের এই জলাশয়টি থেকে কম করে প্রতিদিন ৫/৬ কুইন্টাল মাছ বাজারজাত হয়। এর উত্তর-পূর্বে কাটিগঙ্গা। এখানেও একইভাবে জলাভূমি দখল চক্র সক্রিয়।
মুর্শিদাবাদ জেলায় বছরে গড় বৃষ্টিপাত হয় প্রায় ১৩৭ সেন্টিমিটার। রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের তুলনায় কিছুটা বেশি। এই অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত ৯০-১২০ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি। সেই অর্থে গঙ্গা পাড়ের এই জেলা একটু স্বস্তিতে। কেবল মাটির নিচে জল সংরক্ষণ নয়, প্রাকৃতিক জল নিকাশি ব্যবস্থায় এক বড়ো ভূমিকা পালন করে জলাভূমিগুলি। জলাভূমিগুলির বায়ুমণ্ডলের কার্বন (গ্রিন হাউস গ্যাস) শোষণ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। এর একটা বিশেষ কারণ হলো এই সমস্ত পুরনো জলাধারগুলিতে ভাসমান এককোষী উদ্ভিদ যে সালোকসংশ্লেষ করে তার পরিমাণ যেকোনো অরণ্যের তুলনায় কম নয়। তাছাড়া রয়েছে ভাসমান অনেক গাছপালা। জলজীবী প্রাণীদের এটাই খাদ্যের মূল উৎস।
মুর্শিদাবাদ জেলার প্রায় ৪০টা জলাধারের সংকোচনের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করছে জলাভূমি রক্ষা কমিটি। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ সহ আরও কয়েকটি সংগঠন, সংস্কৃতি জগতের মানুষ, বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তি মিলে ২০১৭ সালে গড়ে ওঠে এই সংগঠন। লাগাতারভাবে জলাভূমি দখলের প্রতিবাদে চলে আন্দোলন। এবারে এই আন্দোলন ভাঙার খেলায় নেমেছে সরকার। এর প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে বিজ্ঞান এবং পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেন। আশার বিষয় যে, এই আন্দোলনের ফলে বেশকিছু জলাভূমি রক্ষা করাও সম্ভব হয়েছে।