৫৮ বর্ষ ২৩শ সংখ্যা / ২২ জানুয়ারি ২০২১ / ৮ মাঘ ১৪২৭
কলকাতায় বিশাল কৃষক সমাবেশে কেন্দ্রের তিন কালা কানুন প্রত্যাহারের দাবি
কলকাতায় কৃষক সমাবেশে বলছেন সারা ভারত কৃষক সভার নেতা অশোক ধাওয়ালে।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কেন্দ্রের কৃষিবিরোধী এবং কৃষকবিরোধী তিনটি কালা আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত লড়াই চলবে। এই লড়াই কেবল কৃষকদের স্বার্থরক্ষার লড়াই নয়, দেশ বাঁচানোরও লড়াই। এ লড়াইয়ে দেশের যত নীতি-আদর্শনিষ্ঠ শক্তি আছে, তাদের ঐক্যবদ্ধ করে শামিল করতে হবে। ২০ জানুয়ারি কলকাতার রানি রাসমণি রোডে এক বিশাল কৃষক সমাবেশে এই দৃপ্ত ঘোষণা করেছেন কৃষক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। কৃষি বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও স্লোগানকে সামনে রেখে কর্পোরেট স্বার্থবাহী তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ২০-২২ জানুয়ারি তিনদিনের অবস্থান-কর্মসূচি উপলক্ষে সারা ভারত কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি (এআইকেএসসিসি) এই সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। এই সমাবেশে সারা ভারত কৃষক সভার সভাপতি অশোক ধাওয়ালে বলেছেন, দেশের সবচেয়ে বড়ো শত্রু বিজেপি। এদের মতো পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জির সরকারও কৃষক বিরোধী ভূমিকা নিয়ে চলেছে। এই দুই শক্তিকেই বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দিতে হবে। এআইকেএসসিসি নেতা যোগেন্দ্র যাদব বলেছেন, কেন্দ্রের বর্তমান সরকার দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে ধ্বংস করছে। তাই কৃষকদের আন্দোলন কেবল তিনটি আইন রোখার আন্দোলন নয়। কৃষক আন্দোলন জয়ী হলে দেশে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই জয়যুক্ত হবে।
এদিন দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত এই সমাবেশের পর ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে শুরু হয় তিনদিনের অবস্থান-কর্মসূচি। এদিনের সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে - ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে কিষান প্যারেডের পাশাপাশি এরাজ্যেও জেলায় জেলায় হাজার হাজার কৃষক ট্রাক্টর, মোটরসাইকেল মিছিল করবেন।
সমাবেশে অশোক ধাওয়ালে বলেছেন, ২৬ জানুয়ারি ১০ লক্ষ কৃষক হাজার হাজার ট্রাক্টর নিয়ে দিল্লিতে প্যারেড করবেন। আমরা নরেন্দ্র মোদী এবং সুপ্রিম কোর্টকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি যে, এই কিষান প্যারেড বন্ধ করে দেখান। এই প্যারেড রোখার সাধ্য কারও নেই। এদিন লাখো লাখো কৃষক রাস্তায় নামবেন। তিনি বলেন, ২৩ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র বসু’র ১২৫তম জন্মদিনে মহারাষ্ট্রের সমস্ত জেলা থেকে হাজার হাজার কৃষক মুম্বাই অভিমুখে যাত্রা করবেন। এখানে আজাদ ময়দানে সমাবেশের পর রাজভবন অভিযান হবে। নাসিকে ৩০-৪০ হাজার কৃষকের জমায়েত হবে। তিনি বলেন, এর আগে সাতদিন সাত রাত ধরে নাসিক থেকে মুম্বাই - কৃষকদের ঐতিহাসিক লঙ মার্চের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এবারের কর্মসূচিতে শ্রমিক সংগঠন সহ অন্যান্য গণসংগঠন যেমন থাকবে, তেমনি মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ভব ঠাকরে, এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ারের মতো নেতৃবৃন্দও উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি দিল্লির সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে ৫৬দিন ধরে চলতে থাকা কৃষকদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান-বিক্ষোভ আন্দোলনের উল্লেখ করে বলেন, পাঞ্জাব, হরিয়ানা সহ বিভিন্ন স্থানের কৃষকরা পুলিশের লাঠিচার্জ, জলকামানকে রুখে দিয়েই দিল্লি সীমান্তে উপস্থিত হয়েছেন। এখানে এসেও তাঁরা অমিত শাহ’র পুলিশের অত্যাচারের মুখে পড়েছেন। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের হাজার হাজার কৃষক। এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকরা আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। দেশের স্বাধীনতার ৭৩ বছরে এতবড়ো কৃষক আন্দোলন হয়নি।
তিনি বলেন, ২৬ নভেম্বর মোদী সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে, শ্রমিক-বিরোধী নীতির প্রতিবাদে, শ্রমকোড বাতিলের দাবিতে দেশের সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন দেশব্যাপী ধর্মঘট পালন করেছে। ওইদিন এআইকেএসসিসি’র আহ্বানে দেশের গ্রামীণ এলাকায় বন্ধ পালিত হয়েছে। আজ মজুর-কিষান - যাঁরা দেশ নির্মাণের কাজে যুক্ত, তাঁরা একসঙ্গে লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন।
অশোক ধাওয়ালে তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন কীভাবে শাসকদল বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াচ্ছে এবং একইসঙ্গে এনআইএ-র তরফে আন্দোলনকারীদের নোটিশ ধরাচ্ছে। কখনও বলা হচ্ছে, এই আন্দোলনের পিছনে খালিস্তানিরা রয়েছে, আবার কখনও বলছে পাকিস্তান ও চীন এই আন্দোলনকে মদত দিচ্ছে। আবার বলা হচ্ছে, নকশালপন্থীরা রয়েছেন এই আন্দোলনের পিছনে। এই সমস্ত অভিযোগই নস্যাৎ করে দিয়েছে, আন্দোলনকারীরা।
তিনি বলেন, মোদী যে তিনটি আইন এনেছেন, তা কৃষি ও কৃষক বিরোধী তো বটেই, এটা দেশের সমস্ত মানুষের বিরোধী। এই আইন গোটা মান্ডি ব্যবস্থা, কৃষিব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেবে। সরকার আদানি-আম্বানি সহ কর্পোরেটদের স্বার্থেই এই আইন এনেছে। এই আদানি-আম্বানিরা শুধু মুনাফা চায়। দেশকে লুঠ করতে চায়। লকডাউনের জন্য দেশের ১৫ কোটি মানুষের কাজ চলে গেছে। অন্যদিকে মুকেশ আম্বানির প্রতিঘণ্টায় ৯০ কোটি টাকা মুনাফা বেড়েছে। যখন দেশের কৃষক-মজুরদের জীবনে মারাত্মক আক্রমণ নেমে এসেছে, তখন আদানি-আম্বানিদের সংস্থাকে আরও মুনাফা করতে সুবিধা করে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদী।
কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিপজ্জনক দিক সম্পর্কে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই আইন কার্যকর হলে ধান, চাল, গম, ভোজ্যতেল, আলু প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। মজুতদারদের যথেচ্ছ মজুত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, এর ফলে আদানি-আম্বানিদেরও মুনাফা করতে সুবিধা হবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। কৃষকরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেন না। ধ্বংস হবে গণবণ্টন ব্যবস্থা। বিদ্যুতের মূল্য ব্যাপকভাবে বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু শিল্পপতিদের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের ওপর এই চাপ বাড়ানো হচ্ছে। তাই কৃষকরা আজ রাস্তায় নেমেছেন।
তিনি উল্লেখ করেন, কেন্দ্র পাঞ্জাব, হরিয়ানা ছাড়া অন্য রাজ্য থেকে ধান কেনে না। তাও কুইন্টাল প্রতি ঘোষিত ১,৮৮০ টাকার কমে। এরাজ্যের কৃষক ১,১০০-১,২০০ টাকায় ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে কুইন্টাল-প্রতি ৬০০-৭০০ টাকা লোকসান হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন। অথচ কেরালার পিনারাই বিজয়ন সরকার কেন্দ্রের নির্ধারিত ১,৮৮০ টাকাতো কুইন্টাল-প্রতি দিচ্ছেনই, বাড়তি আরও ৯০০ টাকা যুক্ত করে ২,৭০০ টাকা দিচ্ছে। কেরালার সরকার যদি এই মূল্য দিতে পারে, তবে বাংলার সরকার পারবে না কেন?
তিনি বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে দেশে ৪ লক্ষের মতো কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করেছেন। বাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এভাবে একজন কৃষকেরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। অথচ বর্তমান সরকারের আমলে ২২৪ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। তাসত্ত্বেও মমতা ব্যানার্জি বলছেন, রাজ্যে একজন কৃষকেরও নাকি মৃত্যু হয়নি।
অশোক ধাওয়ালে বলেন, এই আন্দোলন সব জাতির, সব ভাষার, সব ধর্মের কৃষকের আন্দোলন। এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করতেই তিনদিনের অবস্থান-কর্মসূচি এবং ২৬ জানুয়ারি রাজ্যজুড়ে ট্রাক্টর র্যা্লি হবে। এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে আমাদের জয় ছিনিয়ে আনতেই হবে।
যোগেন্দ্র যাদব তাঁর ভাষণের শুরুতেই উদাত্ত কণ্ঠে সারা ভারতের কৃষক ঐক্য জিন্দাবাদ, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান ধ্বনিত করে বলেন, আজ সকালে এখানে আসার সময়ে দিল্লিতে খুব শীত ছিল। কিন্তু আমার শীত লাগেনি। কারণ দিল্লির সীমান্ত সিঙ্ঘু-টিকরিতে সংগ্রামের আগুনের উত্তাপ ছিল। আজ দিল্লির মানুষ ছুটির দিনে কুতুব মিনার, রেড ফোর্ড দেখতে যাচ্ছেন না। তাঁরা যাচ্ছেন দিল্লির সীমান্ত সিঙ্ঘ-টিকরিতে। তাঁরা কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদী ভেবেছিলেন কৃষকেরা আরও কতদিন বসে থাকবে? কিন্তু ২৬ জানুয়ারি ২ মাস পূর্ণ হবে। আজ আন্দোলনকারীরা বলছেন, প্রয়োজন হলে ২ বছর বসে থাকব। কিন্তু লড়াই জিতেই ফিরব।
তিনি বলেন, এই কৃষি আইন এনে মোদী বলেছেন তিনি নাকি কৃষকের জন্য উপহার নিয়ে এসেছেন। কিন্তু কৃষকেরা বলছেন, এই উপহার আমরা চাই না। বড়ো বড়ো নেতারা দেশের সমস্ত সম্ভাবনার রাস্তা খুলে দেয়। কিন্তু মোদী খোলা জিনিসকে বন্ধ করে দিচ্ছেন। তিনি নোটবন্দি করে বলেছিলেন, দুর্নীতি-কালোবাজারি বন্ধ করে দেবে - কিন্তু তা হয়নি। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য লকডাউন হলো। এখন তিনি কৃষকদের বন্দি করতে চাইছেন। তিনি মান্ডি, রেশন দোকান, বিদ্যুৎ সব কিছুই বন্ধ করতে চাইছেন, দিল্লির কৃষকদের খড় পোড়ানোর জন্য বন্দি করতে চাইছেন।
যোগেন্দ্র যাদব বলেন, মোদীকে আমরা ধন্যবাদ জানাতে চাই কারণ, এই তিন কৃষি আইনের মধ্য দিয়ে তিনি দেশের সমস্ত কৃষককে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছেন। সারা ভারত কিষান সংঘর্ষে সমন্বয় সমিতির ব্যানারে আজ ৪০০-র বেশি কৃষক সংগঠন সমবেত হয়েছে। কিন্তু একটি সংগঠনও সরে যায়নি।
তিনি বলেন, ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে গণতন্ত্রের প্যারেড দেখাবেন কৃষকেরা। এই কর্মসূচি হবে পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ। আমরা পুলিশকে বলেছি, আমরা দিল্লি জিততে আসিনি। আমরা দিল্লির মানুষের দিল জিততে এসেছি। দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষার এই লড়াইয়ে আমরাই জিতব।
এআইকেএসসিসি-র রাজ্য আহ্বায়ক অমল হালদার বলেন, হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় ৫৬ দিন ধরে দিল্লি সীমান্তে যে লড়াই চালাচ্ছেন কৃষকেরা - তার মধ্য দিয়ে গোটা দেশের মানুষকে নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে। এরাজ্যের কৃষকরাও বসে নেই। রাজ্যে ২৬ হাজার গ্রামে কৃষক জাঠা চলেছে। ২৬ জানুয়ারি রাজ্যে সর্বত্র সরকারি অনুষ্ঠান শেষে ট্রাক্টর মিছিল হবে।
তিনি বলেন, মমতা ব্যানার্জির শাসনে রাজ্যের কৃষকের চরম সর্বনাশ হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে হতাশা ফুটে উঠেছে। এ লড়াই শুধু ডেপুটেশন দিয়ে হবে না। শ্রমিক, ছাত্র, যুব, মহিলা সমস্ত অংশের মানুষকে আমাদের পাশে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এদিনের সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন অভীক সাহা (জয় কিষান আন্দোলন), তুষার ঘোষ (সারা ভারত খেত মজুর ইউনিয়ন) সুভাষ নস্কর (সংযুক্ত কিষান সভা), তপন গাঙ্গুলি (খেত মজুর ইউনিয়ন), প্রদীপ সিং ঠাকুর (সারা ভারত ক্রান্তিকারী কিষান সভা), তপন বটব্যাল (সারা ভারত কৃষক মহাসভা), হরিপদ বিশ্বাস (অগ্রগামী কিষান সভা), সুশান্ত ঝা (সারা ভারত কৃষক মজদুর সভা), সমীর পূততুণ্ড (পশ্চিমবঙ্গ কৃষক খেত মজুর সংহতি সমিতি) প্রমুখ।
এদিনের সভা পরিচালনা করেন অমল হালদার, কার্তিক পাল, হরিপদ বিশ্বাস, অজিত মুখোপাধ্যায়, শিবু গিরি, জানে আলম মিঞা এবং সুশান্ত ঝা-কে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী।