E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৩শ সংখ্যা / ২২ জানুয়ারি ২০২১ / ৮ মাঘ ১৪২৭

কৃষি আইন প্রত্যাহার সহ জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে জেলায় জেলায় লালঝান্ডার মিছিল ও সমাবেশ


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের সর্বনাশা কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এখন সংগঠিত হচ্ছে বামপন্থীদের অসংখ্য মিছিল-সমাবেশ-অবস্থান ইত্যাদি। এছাড়াও বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার, শ্রমকোড বাতিল সহ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে তৃণমূল সরকারের অপশাসন-দুর্নীতি এবং বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে লালঝান্ডার প্রতিবাদ-কর্মসূচিতে উত্তাল হচ্ছে রাজ্য। এই সমস্ত কর্মসূচিতেই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বিকল্প কর্মসূচি তুলে ধরছেন বামপন্থীরা।

গত ১৬ জানুয়ারি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পানিহাটিতে সিপিআই (এম)’র এক কর্মসূচিতে রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, মানুষের স্বার্থে যে বিকল্পের দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি, রাজ্যে বাম-কংগ্রেসের সরকার তৈরি হলে সেই বিকল্প রূপায়ণ করে দেখানো হবে। এদিন পার্টির সংগ্রাম তহবিলের জন্য অর্থসংগ্রহের কর্মসূচিতে এসে তিনি বলেছেন, শেষপর্যন্ত মানুষই ইতিহাস গড়েন। মানুষের স্বার্থরক্ষার সংগ্রাম করতে আমরা রাজ্যের মানুষের কাছে অর্থ সাহায্য চাইছি। আমরা যেসব দাবিতে আন্দোলন করছি, তার সবই রূপায়ণ সম্ভব হবে রাজ্যে বাম-কংগ্রেসের বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে।

এদিন পানিহাটির ঘোলা এবং স্টেশন রোডে দু’টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সভা দু’টিতে বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি সূর্য মিশ্র বলেন, দিল্লির সরকারে বসে বিজেপি দেশজোড়া লুণ্ঠন চালাচ্ছে। তৃণমূল সরকারে আসার পরে অনেক চেষ্টা করেও বামফ্রন্ট সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের জেলে ঢোকাতে পারেনি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর হাত মাথার উপরে না থাকলে এতদিনে তৃণমূলের অনেককেই জেলে থাকতে হতো। তৃণমূল না থাকলে পশ্চিমবাংলাতে বিজেপি’র কোনো শক্তি থাকত না। তিনি আরও বলেন, জ্যোতি বসু বলতেন মমতা ব্যানার্জির সবচেয়ে বড়ো অপরাধ হলো বিজেপি’কে পশ্চিমবাংলায় নিয়ে আসা। কেন্দ্রের জনবিরোধী লুটেরাদের সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সংগ্রামের অঙ্গ হিসাবে পশ্চিমবাংলায় নবান্ন থেকে তৃণমূল সরকারকে উৎখাত করতে বাম গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির লড়াইকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি প্রবল ঠান্ডার মধ্যে কেন্দ্রের কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লির সীমান্তবর্তী এলাকায় কৃষকদের যে অবস্থান-বিক্ষোভ আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলনের সমর্থনে এরাজ্যের আন্দোলন কর্মসূচিতে সবাইকে শামিল হবার আবেদন জানান।

শ্রীরামপুরে মহামিছিল

দিল্লি সহ দেশজোড়া কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে, বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে লালঝান্ডার দৃপ্ত মিছিলে উত্তাল হলো শ্রীরামপুরের অমূল্যকানন থেকে আরএমএস ময়দান। ১৬ জানুয়ারি দীর্ঘ পাঁচ কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে লাল পতাকার স্রোত সাম্প্রতিককালের দীর্ঘতম মিছিলের সাক্ষ্য দিলো। সিপিআই (এম)’র হুগলি জেলা কমিটির আহ্বানে এদিনের মহামিছিল প্রতিবাদী চেহারায় নতুন লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়েছে। দীর্ঘ দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মিছিল জানান দিয়েছে অগণিত মানুষের সমর্থন নিয়েই আন্দোলন-সংগ্রাম প্রসারিত ও অগ্রসর হবে।

এদিনের মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন পার্টির পলিট ব্যু‍‌রোর সদস্য মহম্মদ সেলিম, পার্টির হুগলি জেলা কমিটির সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ, রাজ্য কমিটির সদস্য সুদর্শন রায়চৌধুরি, পার্টিনেতা জ্যোতিকৃষ্ণ চ্যাটার্জি, শ্রুতিনাথ প্রহরাজ, মনোদীপ ঘোষ, জয়দেব চ্যাটার্জি প্রমুখ।

এদিন বিকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা - সওয়া ঘণ্টার মিছিলে গোটা শ্রীরামপুর শহর স্তব্ধ হয়ে পড়ে। জিটি রোডে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারেনি। শ্রীরামপুরের মানুষ এদিন দীর্ঘ সময় ধরে প্রত্যক্ষ করেছেন লাল পতাকার উত্তাল মিছিল। এই মিছিলে শামিল হয়েছিলেন অনেকদিন ধরে বন্ধ হয়ে থাকা শ্রীরামপুরের ইন্ডিয়া জুটমিল, মাদুরা কোর্টস, ডানলপ, হিন্দমোটর কারখানার শ্রমিকরা। শ্রমিকদের পাশাপাশি এই মিছিলে অংশ নিয়েছেন আলুর দাম না পাওয়া জাঙ্গিপাড়া, খানাকুলের কৃষকরা। এক সময়ে সন্ত্রাস-কবলিত গোঘাট, খানাকুল, পুরশুড়া, তারকেশ্বরের প্রতিবাদী মানুষরাও আগামী লড়াইয়ের প্রস্তুতি মিছিলে হেঁটেছেন। এছাড়াও এদিনের মিছিলে পা মিলিয়েছেন নতুন প্রজন্মের সংগ্রামী সাথীরা।

মিছিল শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, আগামী বিধানসভা নির্বাচনের অ্যাজেন্ডা হবে মানুষের শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, চাকরির অধিকার প্রতিষ্ঠা। বাণিজ্যিক মিডিয়া যতই তৃণমূল-বিজেপি’র দলবদলের ঘটনা প্রচারে ব্যস্ত থাকুক, মানুষের লড়াই জারি রয়েছে কৃষি আইন বাতিল, শ্রম কোড বাতিলের দাবিতে। বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে এবং রাজ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাম গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ জোটই আগামী বিধানসভা নির্বাচনে নির্ণায়ক ভূমিকা নেবে।

সাগরদিঘিতে কৃষক সমাবেশ

সারা ভারত কৃষক সভার মুর্শিদাবাদ জেলা ২৯তম সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ১৬ জানুয়ারি বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় সাগরদিঘিতে। এই সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, অভিজ্ঞতার বিচারেই সরকার পরিবর্তন করবেন মানুষ। বিজেপি-তৃণমূল দুই শক্তিকেই ছুঁড়ে ফেলে দেবে রাজ্যের মানুষ। এই সমাবেশে দেশব্যাপী কৃষকদের যে লড়াই, তার প্রতি সংহতি জানিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে তীব্র করতে সমস্ত অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান নেতৃবৃন্দ।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সারা ভারত কৃষক সভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার, রাজ্য সভাপতি নৃপেন চৌধুরি, জেলা সম্পাদক আবু বক্কার, কৃষকনেতা রজব আলি মল্লিক। সভা পরিচালনা করেন সচ্চিদানন্দ কাণ্ডারি। এদিন সাগরদিঘি হাইস্কুল মাঠে সমাবেশ শুরুর আগে বিশাল মিছিল সাগরদিঘি পরিক্রমা করে।

সমাবেশে অমল হালদার দিল্লি সীমান্তে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনের উল্লেখ করে বলেন, এই আন্দোলন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই সরকার কর্পোরেটদের স্বার্থে কাজ করছে। মমতা ব্যানার্জির সরকারও কৃষক বিরোধী। এই সরকারের আমলে রাজ্যে ২২৪ জন কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। কৃষকদের সাথে প্রতারণা করছেন মমতা ব্যানার্জি। লড়াই-আন্দোলনকে তীব্র করেই এদের জবাব দিতে হবে।

নৃপেন চৌধুরি বলেন, গ্রামের অবস্থা খুবই খারাপ। জমির লড়াইয়ে জিতে সাগরদিঘির মানুষ একফসলা জমিকে বহুফসলা করেছিলেন। এখন মানুষের দুর্গতির শেষ নেই। এই অবস্থা থেকে মুক্তির লড়াইয়ে‌ সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

সমাবেশে সুজন চক্রবর্তী বলেন, রাজ্যে কেউ গোরুর দুধে সোনা আবিষ্কার করবে, কেউ থাইল্যান্ডে সোনা পাচার করবে। এদিকে রাজ্যে কোনো শিল্প নেই, দশ বছরে কোনো নিয়োগ নেই। কাজের সন্ধানে ভিনরাজ্যে মানুষকে যেতে হচ্ছে। গ্রাম-শহরের চেহারা বদলে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। তৃণমূল সরকারে এসে রাজ্যের সর্বনাশ করছে। ফসলের লাভজনক দাম নেই, ফসল কেনার সরকারি ব্যবস্থা নেই, নেই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি।

তিনি বলেন, রুটি-রুজির প্রশ্নে মানুষের লড়াইয়ে আছেন বামপন্থীরাই। সামনের নির্বাচনে বিজেপি-তৃণমূল - দুই দলকেই ছুঁড়ে ফেলবেন মানুষ। সমস্ত অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে। এদিনের সমাবেশে রাজ্যের কিষান মান্ডিতে ধান কেনা নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হন নেতৃবৃন্দ।

গোয়ালতোড়ে জাঠা মিছিল

দেশের অন্নদাতা কৃষকদের সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের গোয়ালতোড়ে লালঝান্ডার দৃপ্ত মিছিল সংগঠিত হয়েছে। গোয়ালতোড়ের দিয়াশালা থেকে দোলবাগান - এই বিস্তীর্ণ এলাকার সন্ত্রাস-কবলিত মানুষ দীর্ঘ ১০ বছর পর লালঝান্ডা নিয়ে মিছিল করেছেন। জেলার ক্ষীরপাই এলাকাতে ও মহাবালা থেকে কাসণ্ড গ্রাম থেকে গ্রামে কৃষক জাঠা হয়েছে। এছাড়া জেলার ঘাটাল ব্লকের মোহনপুর অঞ্চলের কামারগেড়া, চকলছিপুর, লছিপুর, বেলসর, দাঁড়িয়াড়ি, ঈশ্বরপুর, নতুক, মোহনপুর, হরেকৃষ্ণপুর এলাকার বিভিন্ন গ্রামে মিছিল হয়েছে।

এই সময়ে মাওবাদী-তৃণমূলীদের সন্ত্রাসবিদ্ধ গোয়ালতোড়ের ভালুকবাসা এলাকার গ্রামগুলিতে দলে দলে মানুষ লালঝান্ডা নিয়ে দিল্লির কৃষক আন্দোলন‍‌কে সমর্থন জানাচ্ছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন আগামী সংগ্রামের।

কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে পথে মহিলারা

দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে ১৮ জানুয়ারি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখান মহিলারা। তাঁরা কৃষি ও কৃষক-বিরোধী কেন্দ্রের নয়া আইন বাতিল, রাজ্যের কৃষকদের সহায়কমূল্য দেওয়ার দাবিতে জেলায় জেলায় বিক্ষোভসভা করেছেন। সর্বনাশা কৃষি আইনের প্রতিলিপি পুড়িয়েছেন। এদিন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ডাকে কলকাতা সহ উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গের জেলায় জেলায় এই কর্মসূচি পালিত হয়েছে। তাঁরা এই দিনটিকে মহিলা কিষান দিবস হিসাবে পালন করেছেন। এদিনের এই কর্মসূচি উপলক্ষে কলকাতার শ্যামবাজারে এক বিক্ষোভসভায় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের রাজ্য সম্পাদিকা কনীনিকা ঘোষ। পানিহাটির বিক্ষোভসভায় বক্তব্য রেখেছেন সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী অঞ্জু কর।