৫৮ বর্ষ ২৩শ সংখ্যা / ২২ জানুয়ারি ২০২১ / ৮ মাঘ ১৪২৭
আশা আশঙ্কার মধ্য দিয়ে দেশে শুরু করোনার টিকাকরণ
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ১৬ জানুয়ারি থেকে দেশজুড়ে শুরু হয়ে গেল করোনা সংক্রমণরোধী টিকাকরণ কর্মসূচি। প্রাথমিকভাবে গণটিকাকরণের কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক দেশের ফ্রন্ট রানার সরকারি স্বাস্থ্য কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রায় তিন কোটি লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে। যেখানে গত তিন দিনে প্রায় ৩ লক্ষ কর্মীকে ভ্যাকসিন দেওয়া গেছে। টিকাকরণের পর ৪৪৭ টি ক্ষেত্রে গ্রহীতার শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কিন্তু যে দু’রকম ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হচ্ছে সে দু’টি সম্পর্কে চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী মহলের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন। টিকার মান সংক্রান্ত এই সব প্রশ্নকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও বিতর্ক এবং টিকা দু’টির কার্যকারিতা নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিক রুটিন প্রশ্নগুলির নিস্পত্তি হচ্ছে না তাতে। এর পাশাপাশি সরকারের বিরুদ্ধে উঠে এসেছে দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে টিকা বাণিজ্যে মদত দেবার অভিযোগ। দেশে এই মুহূর্তে ২০২০ সালের মধ্য জুনের পর প্রথম নতুন করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা গত দশ দিনে গড়ে ১৫ হাজারের নিচে নেমেছে। কমছে মৃত্যুর হারও। শুধু ১৭ জানুয়ারিতেই মৃতের সংখ্যা ১৪৫ জন। দেশে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১.৫২ লক্ষ।
এদিন টিকাকরণ কর্মসূচির উদ্বোধনী ভাষণে করোনা মোকাবিলায় অংশ নিয়ে মৃত স্বাস্থ্যকর্মীদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গলা বুঁজে আসে প্রধানমন্ত্রীর। সমালোচকদের একাংশের বক্তব্য, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রসঙ্গে মোদীর এই নাটকীয়তায় তাঁদের বেতনের প্রশ্ন আড়াল করা যাচ্ছে না। গত প্রায় এক বছরে বিভিন্ন জায়গায় স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসকদের বেতনের দাবিতে সোচ্চার হতে হয়েছে। চুক্তিতে নিযুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্কট বেশি হলেও সেদিকে নজর নেই সরকারের।
সারা ভারত জনবিজ্ঞান নেটওয়ার্ক কোভ্যাক্সিনের প্রয়োগ আপাতত স্থগিত রাখার দাবি তুলেছে। বিজ্ঞান আন্দোলনে অগ্রণী এই সংগঠনের দাবি, যতক্ষণ পর্যন্ত এই টিকা পরীক্ষার তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে - তা প্রয়োগ করা উচিত নয়। এই সংগঠন মনে করিয়ে দিয়েছে যে, ভারত বায়োটেকও (কোভ্যাকসিনের নির্মাতা) কিছুদিনের মধ্যে পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই তথ্য প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত জনসাধারণের ওপর প্রয়োগ করা যায় না, বলেছে নেটওয়ার্ক। সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির বক্তব্য, বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা বিবেচনায় না রাখার অবস্থান বিপজ্জনক। কোভ্যাকসিনের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করে প্রয়োগ করা উচিত।
কেন্দ্র এপ্রসঙ্গে অনড় ফের বুঝিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী হর্ষবর্ধন। বর্ধন বলেছেন, ‘‘কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাকসিন দুইই তৈরি হয়েছে ভারতে। প্রমাণিত যে, দু’টিই সুরক্ষিত এবং প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলতে সক্ষম’’।
দুই টিকার ছাড়পত্রেই দেশের ওষুধ নিয়ামক প্রতিষ্ঠান ডিসিজিআই মহামারীর কারণে জরুরি প্রয়োগের উল্লেখ করেছে। তবে কোভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ‘মানবদেহে পরীক্ষামূলক হিসাবে’ অনুমতি দেওয়ার বিশেষ অংশটি যুক্ত করেছে। কেন্দ্রীয় দুই প্রতিষ্ঠান আইসিএমআর এবং এনআইভি’র সহায়তায় করোনার টিকা কোভ্যাকসিন তৈরি করেছে বেসরকারি সংস্থা ভারত বায়োটেক। মানবদেহে তিনটি স্তরে টিকার পরীক্ষা হয়। জানা গিয়েছে, এই টিকার দ্বিতীয় স্তরের পরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে মাত্র ৮০০ স্বেচ্ছাসেবকের ওপর। সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য, এই দ্বিতীয় স্তরে পরীক্ষার বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ এবং ফলাফল প্রকাশ হয়নি। টিকা সুস্থ মানুষকে দেওয়া হয়। ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা খতিয়ে না দেখে প্রয়োগ করা যায় না। পরীক্ষাধীন টিকা অনুমোদনের পিছনে সরকারের শীর্ষস্তর থেকে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দেখছেন অনেকেই। দেশের বিজ্ঞানীদের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখেই তথ্যের অস্বচ্ছতা দূর করার দাবি উঠেছে। কোভ্যাকসিনের তৃতীয় স্তরের পরীক্ষা চলছে তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে। এই স্তরেই টিকার কার্যকারিতা এবং সুরক্ষার মান সংক্রান্ত বিশদ পরীক্ষা হয়।
অপর টিকা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড ঘিরেও বিজ্ঞানীমহলে প্রশ্ন রয়েছে। ভারতে এই টিকার পরীক্ষা করেছে সিরাম ইনস্টিটিউট। এ দেশে কোভিশিল্ডের তৃতীয় স্তরে পরীক্ষা শেষ হলেও ফলাফল প্রকাশিত নয়। ব্রিটেনে যদিও সেই কাজ হয়েছে এবং সেদেশের নিয়ামক প্রতিষ্ঠান এই টিকার ৭০ শতাংশের কিছু বেশি কার্যকারিতা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে।
ভারতে টিকাকরণ বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু সরকারি টিকা দেওয়ার ব্যবস্থাপনায় সম্ভবত কোনো টিকাগ্রহীতাকে বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়া হবে না ভারতে। চিকিৎসক, গবেষক এবং বিজ্ঞান আন্দোলনের বড়ো অংশই চাইছেন টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রেও টিকা কেন্দ্রে গিয়ে কোভ্যাকসিন নিতে না চাইলে সেই সুযোগ যেন থাকে। কাউকে যেন কোভ্যাকসিন নিতে বাধ্য না করা হয়।
গণটিকাকরণ পরিকল্পনা অনুযায়ী, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবেন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা। এই পর্বেই রাখা হয়েছে ২ কোটি টিকা। ২ কোটি টিকার পর দ্বিতীয় পর্বে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদেরও দেওয়া হবে। প্রথম পর্বে ‘ফ্রন্টলাইন’ কর্মীকে দেওয়া হবে টিকা। এই স্তরে পুলিশকর্মী থেকে সাফাই কর্মচারীর মতো অংশকে রাখা হয়েছে। পরের স্তরে পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং তার কমবয়সি কোমর্বিডিটি সম্পন্নদের দেওয়া হবে টিকা। কেন্দ্র প্রথম দু’টি পর্বে ৩ কোটি টিকার আর্থিক দায়ভার নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
টিকাকরণ শুরুর দিনেই বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, রাজধানীর ছ’টি কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতালেই কোভ্যাকসিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এইমস, সফদরজঙ, আরএমএল-ও তার মধ্যে রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে কোভিশিল্ড পাঠানো হয়েছে। এই বিভাজন কেন, তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।
দিল্লির অন্যতম বড়ো কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতাল রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে কোভিশিল্ডের বদলে কোভ্যাকসিন কেন দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন রেসিডেন্ট চিকিৎসকরা। তাঁরা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন, কোভ্যাকসিন তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় এখনও উত্তীর্ণ হয়নি। এই অবস্থায় এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। এদিকে কোভ্যাকসিনের সম্মতিপত্রেও একথা স্পষ্ট লেখা রয়েছে, এই ভ্যাকসিন এখনও পরীক্ষা সম্পূর্ণ করেনি। সম্মতিপত্রের পরিশিষ্ট ২এ লেখা রয়েছে ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিন জরুরি পরিস্থিতির জন্য নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের ক্লিনিক্যাল পরিক্ষায় কোভিড-১৯’র অ্যান্টিবডি তৈরিতে তা সক্ষম হয়েছে। কিন্তু কোভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল কার্যকারিতা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনও তৃতীয় পর্বের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। সুতরাং, এই ভ্যাকসিন নিলেই কোভিড-১৯’র মোকাবিলায় অন্য প্রতিবেষক ব্যবস্থা নিতে হবে না, এমন নয়। কোনও গুরুতর প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া হলে সরকার নির্ধারিত ও অনুমোদিত হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হবে। গুরুতর প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বায়োটেক সংস্থা ক্ষতিপূরণ দেবে। সম্মতিপত্রের এই অংশ প্রচারে আসেনি। যাঁরা নিচ্ছেন তাঁদের কাছেও যথাযথ ব্যাখ্যা করা হয়নি বলেই চিকিৎসকদের বক্তব্য।
আরএমএল হাসপাতালের চিকিৎসকরা এদিন তাঁদের চিঠিতে বলেছেন, কোভ্যাকসিনের পরীক্ষা সম্পূর্ণ না হওয়ায় চিকিৎসকরা তার কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দিহান। সুতরাং, তাঁদের বড়ো অংশই এই টিকাকরণে অংশ না নিতে পারেন। তামিলাডুর সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, আমরা কোনো ভ্যাকসিনের বিরোধিতা করছি না। কিন্তু কোভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে প্রমাণ কোথায়?
করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার একদিনের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশে সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু। ৪৬ বছরের মোরাদাবাদের এক সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় মনিপাল সিং শনিবার করোনার টিকা নেন। তারপর ১৭ জানুয়ারি বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ওইদিন রাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও মেডিক্যাল আধিকারিকের দাবি, টিকার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়নি।
টিকা দেওয়া হবে না যে অংশগুলিকে
১। ১৮ বছরের কমবয়সীরা।
২। গর্ভবতী এবং স্তন্যদায়ী মায়েরা।
৩। টিকা এবং ওষুধজাত দ্রব্যে অ্যালার্জি আছে যাদের, বা বিভিন্ন খাবারে অ্যালার্জি রয়েছে।
৪। অতীতে কোভিড-১৯ টিকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া থাকলে।
আপাতত যে অংশকে টিকা নয়
১। কোভিড-১৯ সংক্রমণের উপসর্গ থাকলে।
২। কোভিড-১৯ রোগী যাদের ওপর মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি প্রয়োগ হয়েছে বা প্লাজমা দেওয়া হয়েছে।
৩। কোনও রোগে গুরুতর অসুস্থ বা হাসপাতালে ভর্তি।
৪। রক্তপাত বন্ধ না হওয়ার মতো সমস্যা থাকলে সতর্কতা রেখে প্রয়োগ।
টিকা সম্পর্কে যথাযথ তথ্য না দিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করার জন্য গণটিকাকরণের কর্মসূচিতে মানুষের অংশগ্রহণ সেই মাত্রায় নেই। এই ত্রুটি থেকে নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলতে পারছে না সরকার। দেশে টিকাকরণের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকা সরবরাহের কথাও ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যে ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশ কিছু দেশে চূড়ান্ত হয়েছে সরবরাহের কথা। প্রশ্ন উঠেছে বিদেশে রপ্তানি মানে ব্যবসা। বেসরকারি সংস্থার বর্ধিত মুনাফার স্বার্থেই কি দেশের মানুষের টিকাকরণ বিলম্বিত করে বিদেশে টিকা পাঠানোর আয়োজন হচ্ছে? টিকার দাম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অক্সফোর্ডের লাইসেন্স নিয়ে ভারতে কোভিশিল্ড তৈরি করেছে সিরাম সংস্থা। প্রথম ধাপে সরকারি স্বাস্থ্য কর্মী, পুলিশ সহযোদ্ধাদের জন্য তিন কোটি টিকা কিনছে সরকার। সিরামের টিকার দেশে দাম ৪০০ টাকা। অথচ ভারতীয় মুদ্রা হিসেবে ইয়োরোপে দাম হচ্ছে ৩১৮ টাকা। অর্থাৎ ভারতে বেশি টাকায় বিক্রি করে বেশি মুনাফা করছে সিরাম। মনে রাখা দরকার ইয়োরোপ আমেরিকার তুলনায় ভারতে গবেষণা ব্যয় অনেক কম। পাশাপাশি সিরাম কর্তা আগে বলেছিলেন দেশের বাজারে একজনের টিকার দাম হবে ২,০০০ টাকা। অর্থাৎ সরকারকে ৪০০ টাকায় বেচলেও সাধারণ মানুষকে কিনতে হবে ২,০০০ টাকায়। সরকার অবশ্য দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৫০ কোটি মানুষের টিকার দায় নেবে এ কথা এখনো বলেনি। তাহলে যত বেশি মানুষ নিজের পয়সায় টিকা কিনতে বাধ্য হবেন তত বেশি মুনাফা হবে। তাই দেশের টিকাকরণের গতি শ্লথ করে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হলে সবচেয়ে বেশি মুনাফার সুযোগ আসবে টিকা সংস্থার কাছে। কর্পোরেট প্রেমিক ভারত সরকারের কাছে যা অস্বাভাবিক নয়।