৫৮ বর্ষ ২৩শ সংখ্যা / ২২ জানুয়ারি ২০২১ / ৮ মাঘ ১৪২৭
মমতার সংখ্যালঘু প্রীতির স্বরূপ - কিছু তথ্য
গৌতম রায়
সময়টা আটের দশকের শেষ ভাগ। বাংলাদেশে তখন স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। এইরকম একটা সময়ে কলকাতাতে একটি সভায় যাওয়ার পথে অন্নদাশঙ্কর রায় ও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সহযাত্রী হওয়ার সুযোগ বর্তমান নিবন্ধকারের হয়েছিল। সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পটভূমি আলোচনা প্রসঙ্গে এরশাদ কিভাবে মাদ্রাসার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতরে আধুনিক বিজ্ঞানমুখী ধারাকে অবরুদ্ধ করে দিচ্ছেন, যার জেরে আগামীদিনে বাংলাদেশ একটা গভীর সঙ্কটে পড়বে - এই নিয়ে অন্নদাশঙ্কর এবং কবি সুভাষের কথোপকথন শোনার সুযোগ ঘটেছিল।
এই প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্কর অবতারণা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসঙ্গ। সেই সময়েই কিভাবে ধীরে ধীরে মাদ্রাসা শিক্ষাতে ইসলামের ধ্যানধারণা, যেগুলি একজন বিশ্বাসীর যাপনচিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেটি বজায় রেখেও, আধুনিক বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার দিকে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার গতিমুখ পরিচালিত হচ্ছে, মাদ্রাসার শিক্ষকেরাও বেতন ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাধারণ ইস্কুল শিক্ষকদের সমমর্যাদা পেতে শুরু করেছেন, সেই প্রসঙ্গে সপ্রশংস অবতারণা করেন অন্নদাশঙ্কর। বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে নীতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও সেইদিন পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে যে আধুনিক বিজ্ঞানমুখী ধারার প্রচলন হচ্ছে, তা মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নতির ক্ষেত্রে বিশেষ ইতিবাচক হবে, অন্নদাশঙ্করের কাছে এই কথা স্বীকার করেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ঘিরে আলাপ-আলোচনা আবার সংবাদ মাধ্যমে ঠাঁই করে নিতে শুরু করেছে।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেহেতু নিজেকে সংখ্যালঘুদের পরিত্রাতা হিসেবে দেখাবার অদক্ষ অভিনয় করে চলেছেন গত দশ বছর ধরে, তাই সংবাদমাধ্যমগুলি এখন মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকতার কথা এমনভাবে উপস্থাপিত করছে, যাতে সাধারণ মানুষের মনে হবে, মাদ্রাসা শিক্ষাতে এই বিজ্ঞানমুখী শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্তনের যাবতীয় কৃতিত্ব মমতার। সেইসব সন্দর্ভে একটিবারের জন্যেও উল্লিখিত হচ্ছে না মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক, বিজ্ঞানমুখী করে তুলতে বামফ্রন্ট সরকারের নিরলস, ধারাবাহিক ভূমিকার কথা। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রে চিঠি দিলে সেই চিঠি তারা প্রকাশ পর্যন্ত করে না। এভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে বামফ্রন্ট সরকারের আমলের মাদ্রাসা শিক্ষার যাবতীয় সংস্কারের কৃতিত্ব তারা দিতে চায় মমতাকে।
বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেই ’৭৭ সালে অনুভব করেছিলেন মুসলমান সমাজকে আধুনিক, বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার দিকে প্রভাবিত না করলে, তাঁদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বামফ্রন্ট সরকার তাদের প্রথম বাজেটেই মাদ্রাসা শিক্ষার জন্যে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি করে।অতীতে যে শম্বুক হারে মাদ্রাসা শিক্ষার জন্যে অর্থ বরাদ্দ করত তৎকালীন রাজ্য সরকারগুলি, বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে সেখানে একটা গতি আনে। বামফ্রন্টের সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে যে বাজেট বরাদ্দ হতো, সেই গতির ধারাবাহিকতা প্রথম ব্যাহত হয় মমতা বন্দোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর। মমতার গত দশ বছরের শাসনকালে অতীতে যেমন শম্বুক গতিতে মাদ্রাসা শিক্ষাতে অর্থ বরাদ্দ হতো বাজেটে, সেই ধারাবাহিকতাই আবার ফিরে এসেছে। বস্তুত মমতার শাসনকালে মাদ্রাসার জন্যে যে অর্থের সংস্থান বাজেটে রাখা হচ্ছে, সেই টাকা মাদ্রাসার শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের বেতন দিতেই প্রায় চলে যাচ্ছে। মাদ্রাসার বাড়ি সংস্কার, ছাত্রদের বিজ্ঞান মনষ্ক করবার জন্যে মাদ্রাসার ভিতরেই ছোটো ছোটো ল্যাবরেটরি, যেগুলি বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তৈরি হয়েছিল, সেগুলির উন্নতি তো দূরের কথা,সেইসব ছোটো ল্যাবরেটরিগুলি মাদ্রাসাতে টাকার অভাবে প্রায় অবলুপ্ত হতে বসেছে। অথচ, যেসব সংবাদপত্র মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকতা নিয়ে সন্দর্ভ রচনা করে, সেই আধুনিকতা প্রচলনের পিছনে বামফ্রন্ট সরকারের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে একদম গোপন করে যাবতীয় কৃতিত্ব মমতাকে দিতে চান, তারা কিন্তু মমতার শাসনকালে মাদ্রাসাগুলির এই পরিকাঠামোগত দুর্দশার কথা ভুলেও উচ্চারণ করে না।
বামফ্রন্ট ’৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কারের লক্ষ্যে মোস্তাফা বিন কাশেমের নেতৃত্বে যে কমিটি তৈরি করেছিল, সেখান থেকে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, সৈয়দ মনসুর হবিবুল্লাহ, মহম্মদ আমিন, মহম্মদ সেলিম প্রমুখের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফল হিসেবে গঠিত হয়েছিল প্রাক্তন রাজ্যপাল, তথা ভারতের বিশিষ্ট্য শিক্ষাবিদ এ আর কিদোয়াইয়ের নেতৃত্বাধীন কমিশন। সাচার কমিটি তৈরিরও আগে এই কিদোয়াই কমিশন গঠন এবং কমিশনের পরামর্শ মতো মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার, বামফ্রন্ট সরকারের এই ঐতিহাসিক ভূমিকা কেবল জাতীয়স্তরেই প্রশংসিত হয় নি। আরব দেশের প্রশাসনিক কর্তা থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদেরা পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষার এই আধুনিক, বিজ্ঞানমনষ্ক পদসঞ্চারকে প্রশংসা করে, অনেকক্ষেত্রে তাদের দেশে পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষার আদলকে মডেল করেছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে মমতাকে মাদ্রাসার কৃতিত্ব প্রকারান্তে দিতে গিয়ে এইসব খবরের কাগজের সন্দর্ভে কিদোয়াই কমিশনের নামটি পর্যন্ত অনুচ্চারিত থেকে যায়।
মমতার প্রশাসন যেভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের নামফলকগুলি পর্যন্ত মুছে দিয়ে সেখানে উদ্বোধক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতার নামের পাথরের ট্যাবলেট বসিয়ে দেন, মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও তার কিছু অন্যথা হয়নি। মহম্মদ সেলিম রাজ্যের মাদ্রাসা শিক্ষার মন্ত্রী থাকাকালীন মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের দ্রুত পঠনের জন্যে বেগম রোকেয়ার একটি জীবনির প্রচলন করেন। সেই জীবনি গ্রন্থটি বামফ্রন্ট যতদিন ক্ষমতায় ছিল, ততদিন মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের অবিকৃতভাবেই পড়ানো হতো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসা মাত্রই মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের দ্রুত পঠনের জন্যে রোকেয়ার জীবনিটি থেকে লেখকের নামটি উধাও হয়ে গেল। মূল বইটিকে মমতার প্রশাসন অস্বীকার করতে পারল না। অথচ লেখকের নামটিকে তাঁরা তুলে দিল। এখন সেই বামফ্রন্টের সময়কালের রোকেয়া জীবনিই তারা পড়াচ্ছে। কিন্তু সেই বইটিতে লেখকের কোনো নাম নেই। এ বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর আজ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট লেখকের সঙ্গে ন্যূনতম সৌজন্যমূলক কথাটিও বলেনি। এটাই হচ্ছে মমতার আমলে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নতি!
সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে হাজিবিবি সেজে ফটোশ্যুট করা ছাড়া মমতার সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্যে প্রকৃত উন্নতিকামী ভূমিকা কোথায়? হাজিবিবি সেজে মোনাজাতের ভুল ভঙ্গিমায়, হাতের আঙুলগুলো আলগা রেখে ছবি তুলিয়ে শহর, গ্রাম ভরিয়ে দিয়েছিলেন মমতা। তাঁর এই অভিনয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য যে মুসলমান সমাজের উন্নতি নয়, মুসলমানদের সম্পর্কে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ভিতর একটা ঈর্ষার মানসিকতাকে চাগিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ যা উন্নতি তা মমতা করছেন, কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্যে, বঞ্চিত হচ্ছেন হিন্দুরা - এই মানসিকতাকে উস্কে দিয়ে মমতা এই রাজ্যে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি-কে পশ্চিমবঙ্গে পা শক্ত করবার সবরকম সুযোগ করে দিয়েছেন। যে বিজেপি-কে তিনি গত শতকের নয়ের দশকে এই রাজ্যে পা রাখার জায়গা করে দিয়েছিলেন কেবলমাত্র নিজের ব্যক্তিস্বার্থের খাতিরে, সেই বিজেপি’রই পা শক্ত তিনি করেছেন এই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে।
মমতার গত দশ বছরের শাসনকালই হলো স্বাধীনতার পর থেকে বাংলার মুসলমানদের সবথেকে দুঃস্বপ্নের সময়। এইসময়কালে এই রাজ্যের মুসলমানদের ভিতর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, কোনো কিছুর ক্ষেত্রেই এতটুকু উন্নতি ঘটেনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমুখী শিক্ষার ক্ষেত্রে মমতার গত দশ বছরের শাসনকালে মুসলমান সমাজ কেবল পিছিয়েই পড়েছে। মুর্শিদাবাদের মানুষদের দীর্ঘদিনের দাবি, তাঁদের জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের। মুর্শিদাবাদের মতো যে জেলায় মুসলমান জনবসতির সংখ্যাধিক্য রয়েছে, সেই জেলার মানুষদের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবির প্রতি আজ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কর্ণপাতই করেননি। এই তো হলো মমতার সংখ্যালঘু প্রেমের প্রকৃত স্বরূপ।
মমতার শাসনকালে কর্মসংস্থানের হার সবক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক নিম্নমুখী। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গত দশ বছরে সবথেকে বঞ্চিত হয়েছেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ২০০৮ সালে কলকাতা পুলিশে কর্মরত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের হার ছিল ৯.১৩ শতাংশ। ২,২৬৭ জন মুসলমান তখন কলকাতা পুলিশে কর্মরত ছিলেন। মুসলমান মহিলা সেইসময়ে কলকাতা পুলিশে কর্মরত ছিলেন ১২জন। ২০১৫ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজে যেখানে একজন মহিলা, সেখানে সেই সময়ে কলকাতা পুলিশে একজনও মুসলমান মহিলা কর্মরত ছিলেন না। এরপরেও কি বলতে হবে মমতার শাসনকালে এই রাজ্যে মুসলমানদের প্রভূত উন্নতি হয়েছে? এই সময়ে কলকাতা পুলিশে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্বের হার কমে দাঁড়ায় ৯.৪ শতাংশে। মমতা যদি সত্যিই সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্যে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে থাকেন, তাহলে বামফ্রন্টের সময়কালে ২০০৮ সালের নিরিখে, ২০১৫ সালে কলকাতা পুলিশে মুসলমান প্রতিনিধিত্বের হার .২৭ শতাংশ কমলো কি করে? মমতা কর্মসংস্থানের অনেক ঢক্কানিনাদ জনসভাগুলিতে দিয়ে থাকেন। সেইসব প্রচারের যদি এতটুকু বাস্তবতা থাকে, তাহলে এই প্রশ্ন তুলতেই হয় যে, এই সময়কালে কলকাতা পুলিশে কি কোনো নিয়োগ হয়নি? আর যদি তর্কের খাতিরে মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসংস্থানের দাবিকে মান্যতা দিতেই হয়, তাহলেও এই প্রশ্ন ওঠে যে, সেই নিয়োগে কি মুসলিম সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল? নাকি, মুসলমান সমাজে কেবল ধর্মীয় শিক্ষাকেই এতো গুরুত্ব মমতা তাঁর শাসনকালে দিয়েছেন যে, তার জেরে মুসলমান সমাজ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলিতে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছে, যার ফলশ্রুতি ২০১৫ সালে কলকাতা পুলিশে মুসলমান প্রতিনিধিত্বের দুরবস্থার ভিতর দিয়ে ফুটে উঠছে।
সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে মমতার এই মিথ্যাচার ঘিরে রাজনৈতিক মহলে বহু কথাবার্তার পর ২০১৯ সালে, লোকসভা ভোটের সময়কালে কলকাতা পুলিশে কিছু কর্মসংস্থান হয়। এইসময়ে কলকাতা পুলিশে মোট ২৫,৯৯৪ জন কর্মরত ছিলেন। তাঁদের ভিতর ২,৮৯৭ জন ছিলেন মুসলমান। মোট কর্মীসংখ্যার শতাংশের হিসেবে ১১.১৪ শতাংশ। বামফ্রন্টের আমলে ২০০৮ সালের প্রতিনিধিত্বের নিরিখে মাত্র ২.০১ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এই ২০১৯ সালে। এই সময়ে কলকাতা পুলিশে মুসলমান মহিলার সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৮ জন। এই হলো মমতার সংখ্যালঘু উন্নয়নের স্বরূপ।
মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্যে মমতা তাঁর দশ বছরের শাসনকালে কি করেছেন? তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মহাকরণ বা পরে নবান্নতে মনীষীদের জন্মদিনে তাঁদের ছবি দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সেই শ্রদ্ধার্পণে গত দশ বছরে কেন একবারের জন্যেও নারী শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার জন্ম-মৃত্যুদিন ৯ই ডিসেম্বর পালিত হয়নি? মুসলমান সমাজকে আলো দেখাতে, মুসলমান মেয়েদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে এই কলকাতা শহরের বুকে প্রাণপাত করেছিলেন রোকেয়া। মমতা নিজে একজন নারী হয়ে, একটিবারের জন্যেও তাঁর দশ বছরের শাসনকালে রোকেয়াকে ঘিরে একটি অনুষ্ঠান করবারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না? একবারও তাগিদ অনুভব করলেন না, সরকার বা বাংলা আকাদেমির মাধ্যমে রোকেয়ার ঐতিহাসিক রচনাগুলি প্রকাশ করবার, যাতে কেবল মুসলমান সমাজের ভিতরেই নয়, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গোটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভিতর থেকেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ দূর হয়, লিঙ্গবৈষম্য দূর হয়।
সংখ্যালঘু উন্নয়ন মানে কি কেবলমাত্র ধর্মীয় আবরণের ভিতরে থাকা সামান্য কিছু মানুষকে ঘিরে আবেগ? ধর্মের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও যে বিপুল জনগোষ্ঠী সমাজ, সভ্যতার সার্বিক কর্মযজ্ঞের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে দিয়েছেন, তাঁদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে আরও ইতিবাচক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া কি সংখ্যালঘু উন্নয়নের ভাবনার সঙ্গে একাত্ম নয়? সেই ভাবনা কি গত দশ বছরে একটিবারের জন্যেও মমতা ভেবেছেন? কাজী আবদুল ওদুদ, যিনি বিভক্ত বাংলাকে মেনে নিতে পারেননি, স্বজনদের কার্যত পরিত্যাগ করে একা নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছিলেন কলকাতার পার্ক সার্কাসের তারক দত্ত রোডে, ‘শাশ্বত বঙ্গে’র সেই উপাসক মনীষী কাজী আবদুল ওদুদ, যাঁর চিন্তার ভিতর দিয়ে আজ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিহত করবার অনেক রাস্তা আমরা খুঁজে পেতে পারতাম, তাঁকে ঘিরে কোনো ভাবনা, তাঁর মতো মানুষদের ঘিরে কোনো ভাবনা কি গত দশ বছরে একটিবারের জন্যে মমতা ভেবেছেন? কথায় কথায় উদ্ভূতুরে শব্দ দিয়ে রাস্তার নামকরণ করেন মমতা। উদাহরণ হিসেবে ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’র কথা বলা যায়। সেই মমতা কি কলকাতার একটি রাস্তাও তাঁর গত দশ বছরের শাসনকালে কাজী আবদুল ওদুদ, বেগম রোকেয়া, রেজাউল করিমদের মতো মানবপ্রকৃতিবেত্তাদের নামে করেছেন?
এটাই হলো তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর সংখ্যালঘু প্রীতির স্বরূপ।
(কৃতজ্ঞতা - সাবির আমেদ, প্রতীচী ট্রাস্ট।)