E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৩শ সংখ্যা / ২২ জানুয়ারি ২০২১ / ৮ মাঘ ১৪২৭

আলো আছে আবডালে - পর্ব ৩

বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়


অন্ধকারের মাঝে আলো খুঁজতে খুঁজতে ইতিমধ্যেই দুটো পর্ব পেরিয়েছে। সব কথা বলতে না পারলেও অনেক কথাই বলা হয়ে গেছে। যদিও সবেমাত্র ২০২০ সালের মাঝামাঝি পৌঁছেছি। এখনও অনেকটা বাকি। যে ধারাবিবরণী ছাড়া আলো খোঁজা শেষ হবেনা। হতাশার শুরু দিয়ে শুরু হওয়া ২০২০-র বছরভর অন্ধকারের পাশাপাশি যে নতুন আশার আলো জাগিয়েছে তাকে ছোঁয়া যাবেনা।

রাজকাপুর অভিনীত ১৯৫৯ সালের ‘আনাড়ি’ সিনেমাটা অনেকেই দেখেছেন। আবার অনেকেরই হয়তো দেখা হয়ে ওঠেনি। যে সিনেমার এক দৃশ্যে অফিসের বড়বাবু ‘আনাড়ি’ রাজ কাপুরকে জানান - আগামীকাল থেকে অফিসে ওভারটাইম শুরু হবে। কারণ ‘শহরে ফ্লু আসছে এবং মালিকরা বলেছেন ভগবানের দয়া যদি হয় তাহলে ফ্লু খুব বেড়ে যাবে এবং প্রচুর মুনাফা হবে’। ‘আনাড়ি’র প্রশ্ন ছিল - ‘ভগবানের দয়ায় ফ্লু বাড়ে? নাকি কমে?’ উত্তর মেলেনি। ওই সিনেমাতেই এক দৃশ্যে সিগারেট পান সহযোগে মালা জপতে জপতে জনৈক ব্যবসায়ী জানিয়েছিলেন - ফ্লু রোজ রোজ আসেনা। ভগবানের দয়ায় ৪০ বছর পরে এসেছে। আমাদের ওষুধ ছাড়া গরিবরা যাবে কোথায়? আর অন্য এক দৃশ্যে কিছু ব্যবসায়ীর কথোপকথন আছে। যেখানে তাঁরা আলোচনা করছেন - ফ্লু-র পরেও আরও এক বড়ো ফ্লু আসছে। তাতে আরও বেশি মানুষের মৃত্যু হবার কথা। এক ব্যবসায়ী বলেন - কোম্পানি যেন তার পরে বোনাস ঘোষণা করে। কারণ ফ্লুতে প্রচুর মানুষ মরবে এবং কোম্পানির কর্মী সংখ্যাও কমবে। তাহলে বোনাস দিতে কোম্পানির কম টাকা খরচ হবে।

এটা হয়তো নিছকই গল্প ছিল। তবে ২০২০তে দেশজুড়ে ভরা করোনা সংক্রমণের সময় যা দেখা গেছে তা কিন্তু সিনেমা নয়। গত বছরেই বাস্তবের ছবিতে দেশের মানুষ দেখেছে - দেশে করোনা সংক্রমণজনিত পরিস্থিতি যাই হোক না কেন সামনে রাম ঝোলানো থাকলে মন্দিরের ইট পোঁতা আটকায় না। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি, ব্যাঙ্কের সংযুক্তি আটকায় না। এম এল এ কেনাবেচা, সরকার ফেলে দেওয়া আটকায় না। রেলের আংশিক বেসরকারিকরণ, মব লিঞ্চিং আটকায় না। লকডাউনের অজুহাত দিয়ে শ্রমিক, কর্মচারীদের বেতন কাটা আটকায় না। ছাঁটাই আটকায় না। কর্পোরেট হাউসের লাভের অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়া আটকায় না। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি আটকায় না। আর সবশেষে থালা বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে করোনা সংক্রমণ বা মৃত্যুও আটকায় না।

২০২০-র আগস্ট মাসের ৬ তারিখে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ। তখনও পর্যন্ত মৃত্যু প্রায় ৪০ হাজার। জুলাই মাসের শেষে মালেগাঁও বিস্ফোরণের অন্যতম অভিযুক্ত, বর্তমানে বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর জানিয়েছিলেন - ২৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যে ৭ টায় নিজের বাড়িতে পাঁচবার করে হনুমান চালিশা পাঠ করুন। ৫ আগস্ট ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে রামের উদ্দেশে আরতি করে এই অনুষ্ঠান শেষ করুন। হ্যাঁ। করোনার ভরা বাজারে লকডাউন আর আনলকের গল্পের মাঝেই ৫ আগস্ট ২০২০-তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অয্যোধ্যায় দু’হাজার ফিট নিচে রূপোর ইট পুঁতে রামমন্দিরের ভূমিপুজো সমাপ্ত করে ফেলেছেন। মহামারীর কারণে দেশ স্তব্ধ থাকলেও তাতে মন্দিরের ভূমিপুজো আটকে থাকেনি। একে বোধহয় মহামারী মাহাত্ম্য বলা যেতেই পারে।

অবশ্য রূপোর ইট পোঁতার পাশাপাশি এই সময়েই ফিকি’র এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব কে কে রাজারাজন জানিয়েছিলেন, ১ লক্ষ কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রির একটি পরিকল্পনা রয়েছে নীতি আয়োগের। এরপর আগামী ৫ বছরের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করার কথাও নীতি আয়োগকে বলা হয়েছে। এই পরিকল্পনার সঙ্গেই সরকার ঠিক কোন্‌ কোন্‌ সেক্টরকে বিক্রি করতে চায় তা ঠিক করা হবে। আর সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্কগুলোকে আরও পেশাদারি পদ্ধতিতে চালানোর জন্য সরকারি অংশীদারিত্বের পরিমাণ ২৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রস্তাবও এই সময়েই।

করোনা সংক্রমণ দেশের অধিকাংশ মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনলেও অন্তত ৮২৮ জন ভারতীয়র জন্য তা অবশ্যই পৌষমাস ছিলো। যারা এই সময়েই ১,০০০ কোটি বা তার থেকে বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। ৮২৮ জনের এই তালিকায় ২০২০-তে নতুন সংযোজন ১৬২ জন। আইআইএফএল ওয়েলথ হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্ট-২০২০ অনুসারে তালিকার শীর্ষে মুকেশ আম্বানি। যার মোট সম্পদের পরিমাণ ৬ লক্ষ ৫৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই সময়ে যার সম্পদ বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে গত মার্চ থেকে প্রতি ঘণ্টায় মুকেশ আম্বানির রোজগার ৯০ কোটি টাকা।

২০২০-র আরও এক ‘আত্মনির্ভর’তা খুঁজে পাওয়া যায় পি এম কেয়ারস ফান্ডে। প্রাইম মিনিস্টারস ন্যাশনাল রিলিফ ফান্ড থাকা সত্ত্বেও তাকে এড়িয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভাকে এড়িয়ে প্রাইম মিনিস্টারস সিটিজেন অ্যাসিস্টেন্স অ্যান্ড রিলিফ ইন ইমারজেন্সি সিচুয়েশনস বা পি এম কেয়ারস ফান্ড। যে ফান্ডে দেশের মন্ত্রীসভার কোনো অনুমোদন নেই (২৯ জুন দেওয়া এক আরটিআই-এর উত্তর তাই জানিয়েছে)। যে ফান্ড কোনো পাবলিক অথরিটি নয়। তাই সে ফান্ড আরটিআই ভুক্ত নয়। অথচ এই ফান্ডেই গত বছরের জুলাই পর্যন্ত দেশের ৩৮টি পিএসইউ ২,১০৫ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। যার মধ্যে সবথেকে বেশি টাকা দিয়েছে ওএনজিসি। ৩০০ কোটি। এনটিপিসি দিয়েছে ২৫০ কোটি, ইন্ডিয়ান অয়েল ২২৫ কোটি, পাওয়ার ফিনান্স এবং পাওয়ার গ্রিড ২০০ কোটি করে, এনএমডিসি ১৫৫ কোটি, আরইসি ১৫০ কোটি, বিপিসিএল ১২৫ কোটি, এইচপিসিএল ১২০ কোটি, কোল ইন্ডিয়া ১০০ কোটি, হাডকো এবং গেইল ৫০ কোটি করে। এছাড়াও এমপি ল্যাডের টাকা সাংসদদের না দিয়ে সরাসরি এই ফান্ডে দেবার কথা জানানো হয়েছে। বহু সংস্থা, ব্যক্তি সরাসরি এই ফান্ডে টাকা জমা দিয়েছে। কিন্তু কোনো জমা বা খরচের হিসেব ফান্ডের ওয়েবসাইটে নেই। ‘তিনি’ ‘হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ স্লোগান কি আর এমনি এমনি এত জনপ্রিয়!

করোনা আবহেই গত ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষের চাকরির জন্য ঘটা করে এক পোর্টাল উদ্বোধন করেছিলেন। যাতে জুলাই মাসেই আবেদন জমা পড়েছিল ৬৯ লাখ, যার বেশিরভাগটাই পরিযায়ী শ্রমিক। চাকরি পেয়েছিলেন ৭,৭০০ জন। এই সময়েই ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিমে এবছর মহিলাদের অংশীদারিত্ব কমে হয়েছে ৫২.৪৬ শতাংশ। গত আট বছরের মধ্যে যা সবথেকে কম। মহিলাদের কাজ পাওয়া সবথেকে বেশি কমে পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় প্রভৃতি রাজ্যে। যদিও এই সময়েই মহিলারা সবথেকে বেশি কাজে যুক্ত হয়েছেন বামশাসিত কেরলে। পরিসংখ্যান অনুসারে যার হার ৯১.৩৮ শতাংশ।

করোনা সংক্রমণ দেশের অধিকাংশ মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনলেও অন্তত ৮২৮ জন ভারতীয়র জন্য তা অবশ্যই পৌষমাস ছিলো। যারা এই সময়েই ১,০০০ কোটি বা তার থেকে বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। ৮২৮ জনের এই তালিকায় ২০২০-তে নতুন সংযোজন ১৬২ জন। আইআইএফএল ওয়েলথ হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্ট-২০২০ অনুসারে তালিকার শীর্ষে মুকেশ আম্বানি। যার মোট সম্পদের পরিমাণ ৬ লক্ষ ৫৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই সময়ে যার সম্পদ বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে গত মার্চ থেকে প্রতি ঘণ্টায় মুকেশ আম্বানির রোজগার ৯০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যে কথাটা না বললেই নয় তা হলো - এই আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে, অর্থাৎ দেশে ভরা লকডাউনের বাজারে বিভিন্ন পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কে ১৯,৯৬৪ কোটি টাকার ব্যাঙ্ক জালিয়াতি হয়েছে। দেশের ১২টা পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কে মোট ২,৮৬৭টি ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনা। যার মধ্যে জালিয়াতির ঘটনার সংখ্যায় শীর্ষে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। আর জালিয়াতির অঙ্কে শীর্ষে ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া।

অক্টোবর মাসে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত হয় আইএমএফ-এর ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক। যে সমীক্ষা রিপোর্ট অনুসারে, চলতি আর্থিক বছরে - অর্থাৎ ১ এপ্রিল ২০২০ থেকে ৩১ মার্চ ২০২১ সময়ে ভারতের জিডিপি’র হার কমতে পারে ১০.৩ শতাংশ। যা কমে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের নিচে চলে যেতে পারে। ভারতের মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন দাঁড়াবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। ৯ অক্টোবর, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে গভর্নর শক্তিকান্ত দাস জানান - বর্তমান আর্থিক বছরে দেশের অর্থনীতিতে ৯.৫ শতাংশ ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এরও আগে বর্তমান আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি-তে ২৩.৯ শতাংশ ঘাটতির কথা জানিয়েছিল সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিকাল অফিস বা সিএসও।

গত অক্টোবরেই অক্সফ্যাম কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইনইক্যুয়ালিটি ইনডেক্স প্রকাশ করে। যে সূচক অনুসারে - বিশ্বের ১৫৮ টা দেশের মধ্যে শ্রমিক অধিকার রক্ষার নিরিখে ভারতের স্থান ১৫১ নম্বরে। আগের ১৪১তম স্থান থেকে আরও দশ ধাপ পেছনে। গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ-সহ একের পর এক বিজেপি শাসিত রাজ্য করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই শ্রমআইন হয় বাতিল, না-হয় সংশোধনের কাজে হাত দেয়। শ্রমআইনের ৪৪টা বিধি কমিয়ে ৪টে করার পরিকল্পনা নিয়েছিল কেন্দ্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা মালিকপক্ষকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের। যে বিবাদের জল গড়ায় আইএলও পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় সরকার যতই সাফল্যের দাবি করুক, এই রিপোর্ট অনুসারে - সরকারি নীতি, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা, করব্যবস্থা ও শ্রমিক অধিকার - সবমিলিয়ে ভারত ১২৯তম স্থানে। স্বাস্থ্যখাতে সরকারি খরচের নিরিখে ভারত শেষের দিক থেকে ৪ নম্বরে। রিপোর্ট অনুসারে, ৭০ শতাংশ মানুষই চিকিৎসা খরচ নিজেরাই দেন।

দেশের মাননীয় সরকার অবশ্য এসবে বিশেষ গুরুত্ব দেননা। করোনা মোকাবিলায় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া এইসময় আর যা যা করা দরকার তার সবটুকুই ‘আচ্ছে দিন’ আনার লক্ষ্যে সরকার করেছে মন দিয়ে। মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে ঘোষিত অপরিকল্পিত লকডাউনে দেশে প্রায় ১৪ কোটির বেশি মানুষ কাজ হারালেও সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বার বার দাবি করেছেন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অবশ্য এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড অফিস জানিয়েছে - সেপ্টেম্বরে নথিবদ্ধ সংস্থার সংখ্যা ছিল ৫,৩৪,৮৬৯। যা অক্টোবরে হয় ৫,০৪,০৪৪। অর্থাৎ এক মাসে কমে ৩০,৮২৫ সংস্থা। গত সেপ্টেম্বরে ওই সংস্থায় প্রভিডেন্ট ফান্ড জমা পড়েছিল ৪ কোটি ৭৬ লক্ষ ৮০ হাজার কর্মীর। যা অক্টোবরে কমে হয় ৪ কোটি ৫৮ লক্ষ ২০ হাজার। অর্থাৎ গত এক মাসে শুধুমাত্র প্রভিডেন্ট ফান্ড জমা দেন এরকম কর্মী সংখ্যা কমে ১৮ লক্ষ ৬০ হাজার প্রায়। সরকারের দাবির সঙ্গে সরকারি পরিসংখ্যান - মিল খুঁজতে যাবেন না যেন!

২০২০-তে করোনা মহামারীকে ঢাল করে যেভাবে শ্রমজীবী মানুষের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ নেমে এসেছে তা এককথায় নজিরবিহীন। এই সময়েই যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়েছে তেমনই প্রায় চুপিসাড়ে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে কৃষিবিল। গত ২০ সেপ্টেম্বর সংসদে পাশ হয়েছে ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যাসন্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যারন্ড ফেসিলিটেশন) অডিন্যান্স, ২০২০; ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাান্ড প্রজেকশন) এগ্রিমেন্ট অন ‌প্রাইস অ্যাওসুরেন্স অ্যাশন্ড ফার্ম সার্ভিস অর্ডিন্যান্স, ২০২০। রাতারাতি তা আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর বিরোধীশূন্য রাজ্যসভায় ধ্বনিভোটে পাশ হয়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে নেবার সংযোজনী।

বিতর্কিত তিন কৃষি বিল নিয়ে প্রথম থেকেই শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ। রেল লাইনের ওপর বসে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করে দেন পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা। মোট ৩১টি কৃষক সংগঠন ১ অক্টোবর থেকে ধাবলান (পাতিয়ালা), সুনাম (সাঙ্গরুর), বুদ্ধলাদা (মনসা), গিদ্দেরবাহা (মুক্তসার), বর্নালা, ভাটিন্ডা, ফরিদকোট, গুরুদাসপুর, রূপনগর, ফিল্লোর, সামরালা, মোগা প্রভৃতি জায়গায় রেললাইনের ওপর বসে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করেন। অবরোধ শুরু হয় বিভিন্ন জায়গায় পেট্রোল পাম্পের বাইরে, টোল প্লাজায়, শপিং মলের সামনে, খাদ্যশস্যের গুদামে। এই বছরেরই শেষলগ্নে গত ১০ নভেম্বর প্রকাশিত হয় বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল। যেখানে মহাজোট, বিজেপি তথা এনডিএ জোটের রাতের ঘুম কেড়ে নিলেও সামান্য ব্যবধানে পরাজিত হয়। গত ২০১৯ লোকসভা ভোটের নিরিখে বিজেপি’র ভোট কমে ৪.৯৬ শতাংশ। এনডিএ-র ভোট কমে ১২.১ শতাংশ। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিহারে এনডিএ পেয়েছিল ৫০.৩ শতাংশ ভোট। মাত্র ১৭ মাসে তা কমে দাঁড়ায় ৩৮.২ শতাংশে।

আনাড়ি সিনেমার গল্পে সেই অর্থে কোনো সমাধান ছিল না। বাণিজ্যিক চিত্রে হয়তো দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন গোছের উপসংহার ছাড়া বিশেষ কিছু দেখানোও সম্ভব নয়। তবে স্বল্প পরিসরে মুনাফালোভীদের চরিত্রের মুখোশ খুলে দেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই প্রশংসার। এটা যদিও ১৯৫৯ নয়, ২০২১ - এই লেখায় আনাড়ির প্রসঙ্গ টেনে আনাও নেহাতই কাকতালীয়, কিন্তু এটা বোঝা যায় - দীর্ঘ ৫০-৫১ বছরেও তাদের মূলগত চরিত্রের কোনো বদল হয়নি। যা আরও একবার নতুনভাবে প্রমাণিত হয়েছে ২০২০-তে। আর এবারও আগাগোড়া দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ হাত দিয়েছে সংগ্রামের ইতিহাস লেখার কাজে। লড়াই জারি ছিল, আছে, থাকবে।