E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৩শ সংখ্যা / ২২ জানুয়ারি ২০২১ / ৮ মাঘ ১৪২৭

নিলামে বিকোচ্ছে পঞ্চায়েত

অমিতাভ রায়


নিলামে উঠেছে দেশ। রেল তেল টেল (টেলিফোন) থেকে শুরু করে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, খনি, জঙ্গল, পাহাড়, নদী এককথায় দেশের যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উৎপাদন ও পরিষেবাব্যবস্থা নিলামে চড়িয়ে বেচে দেওয়ার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। বাদ যায়নি ব্যাঙ্ক, বিমা ইত্যাদি পরিষেবা। তালিকায় সবই আছে। নেহাত খদ্দের পাওয়া যাচ্ছে না বলে রাষ্ট্রীয় বিমান পরিষেবা এয়ার ইন্ডিয়া এখনও কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া যায়নি।

এমনকি দেশের কৃষিব্যবস্থাও কর্পোরেটের কর্তৃত্বে তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে। কৃষকের জীবন এবং জীবিকার প্রশ্ন জড়িয়ে যাওয়ায় জবরদস্তিতে তৈরি করা আইন কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। দেশের কৃষিজীবী মানুষ সঙ্ঘবদ্ধভাবে একজোট হয়ে নতুন তিনটি কৃষি আইন বাতিল করার জন্য রাজপথে সমবেত হয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ফলে সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশে আপাতত আইন কার্যকর করা স্থগিত রয়েছে।

সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলেছে স্বয়ংশাসিত বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার উপর প্রভাব বিস্তার। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে অভিহিত সংবাদমাধ্যম তো প্রায় করায়ত্ত। অন্য স্তম্ভগুলিতেও খবরদারি নজরদারির শেষ নেই। পাশাপাশি হয়ে চলেছে কর্পোরেটের হাতে নিত্যনতুন উপহার তুলে দেওয়ার ফন্দিফিকিরের অনুসন্ধান।

ছোটো আকারে হলেও গ্রামস্তরের স্থানীয় প্রশাসন অর্থাৎ পঞ্চায়েতে কর্পোরেটের অংশগ্রহণ করার পরিকল্পনা সফল হয়েছে। কেরলের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ২০১৫-য় বপন করা এই প্রকল্পের বীজ ২০২০-র নির্বাচনে পল্লবিত হয়েছে।

কেরলের পরীক্ষাগারে সাফল্য লাভ করেই নতুন মতলব ভাঁজা শুরু হয়ে গেছে। এবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই নিলামে চড়ানোর পরীক্ষা শুরু হলো। ২০২১-এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত মহারাষ্ট্রের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই নতুন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে অভিযোগ আসে যে,বেশ কয়েকটি জেলার অনেক গ্রাম পঞ্চায়েতের জন্য মাত্র একজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। খোঁজ করতেই পুরো ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে চলে আসে। পুনে জেলার ৭৪৬-টি গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে ৮১-টিতে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী। নন্দরবার জেলায় ৮৭-টির মধ্যে ২২-টিতে এমন ঘটনা ঘটেছে। বিড় জেলার ১২৯-টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৮-টিতে একজনের বেশি মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি। কোলাপুর জেলায় মোট ৪৩৩-টি গ্রাম পঞ্চায়েত। তারমধ্যে ৪৭-টি আসনে একজন প্রার্থী। আর লাতুর জেলায় ৪০১-টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ২৫-টিতে একজনের বেশি প্রার্থী নেই।

রাজ্য নির্বাচন কমিশন এখনও পর্যন্ত মাত্র দুটি গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচন বাতিল করেছে। নাসিক ও নন্দরবার জেলার একটি করে গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচন একজন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিলের কারণে বাতিল করা হয়েছে। অভিযোগ অনেক এলেও এই দুটি গ্রামের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের আসন নিলাম প্রক্রিয়ার ভিডিয়ো ফুটেজ পাওয়া গেছে। অন্যগুলোর জন্য সরকারিস্তরে তদন্ত চলছে।

নিলাম প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ। গ্রামের মাতব্বর ব্যক্তিরা সমবেত হয়ে স্থির করেন যে, পরের পাঁচবছরে গ্রামের কোন্‌ বাসিন্দা গ্রামের জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। যে ব্যক্তি সর্বোচ্চ দর দেওয়ার কথা বলেন তিনিই পেয়ে যান গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ছাড়পত্র। এর বিরোধিতা করার সাহস এবং ক্ষমতা কোনো গ্রামবাসীর নেই। বিরোধিতা করলে প্রথমে সামাজিক বর্জন। প্রতিবাদকারী এবং তাঁর পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

নিলামের দর কেমন চলছে? সবগুলো জানা যায়নি। যে দুটো গ্রামের নির্বাচন বাতিল হয়েছে তার একটির জন্য সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ২ কোটি টাকা। অন্যটির ৪৬ লক্ষ।

মজার ব্যাপার হলো যিনি নিলামে সর্বোচ্চ দর হাঁকেন তিনি কিন্তু মাতব্বরদের সমাবেশে অনুপস্থিত। তবে কথার নড়চড় নেই। কোনো কারণে নিলামে জয়ী ব্যক্তি মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারলে তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। মোদ্দা কথা একবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলে তা কার্যকর হবেই হবে।

নিলামে যিনি গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্বাচিত হবেন বা হলেন তিনি তো আর ঘরের টাকায় গ্রামের সেবা করবেন না! নিলামে জমা দেওয়া টাকা বা বিনিয়োগ ঘরে ফিরিয়ে আনাই হবে তাঁর প্রথম কাজ। যাঁরা এমন নিলামের আয়োজক তাঁরাও সেটা ভালো করে জানেন। দুর্নীতি ছাড়া এই কাজ সম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রথমেই দুর্নীতিকে সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অধোনমন এবং প্রাতিষ্ঠানিক তথা সামাজিক দুর্নীতির স্বীকৃতি দেওয়ার এই পরীক্ষা নিঃসন্দেহে একেবারেই নতুন। কেরলের কর্পোরেট পঞ্চায়েতের সাফল্য এবং মহারাষ্ট্রের পঞ্চায়েতের নিলামে বিক্রি কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই বিপজ্জনক প্রবণতা বন্ধ করার জন্য এখনই সোচ্চার না হলে ভবিষ্যতে কিন্তু সারাদেশে সমস্তস্তরেই গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে।


তথ্যসূত্রঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৪ জানুয়ারি, ২০২১