৫৮ বর্ষ ২৩শ সংখ্যা / ২২ জানুয়ারি ২০২১ / ৮ মাঘ ১৪২৭
কেন কৃষকরা আজও পথে
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
কেন কৃষকরা শতকষ্টেও আজও পথে? আলোচনার টেবিলে ডেকেও সমাধানসূত্র মিলছে না। সরকার ও সরকারের বাজনদাররা এর উত্তর খুঁজে পাবেন না। অথচ কয়েক মাস আগেই তো এই সরকারের কথায় মোমবাতি জ্বেলেছে মানুষ, থালা বাটি বাজিয়েছে, মুখ ঢাকতে বলেছে ঢেকেছে, ঘরে থাকতে বলেছে - থেকেছে। আর্থিকভাবে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের দুর্দিনে সরকারের কাজ পরিবারের দায়িত্ববান অভিভাবকের মতো, নিরপেক্ষভাবে সবটা তার নজরদারিতে চলবে। আর চোখ বুজে মানুষ সরকারের পরামর্শ মেনে চলে অতিমারীর দুঃসময় পার করবে।
ইতিহাসের অভিজ্ঞতা এটাই যে, এইরকমের বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার ও সাধারণ মানুষের ভাবনা-চিন্তা-চলন-বলন সবটাই সরকার নির্দিষ্ট সুর-তাল-ছন্দ মিলিয়ে হয়েছে যত বেশি, তত দ্রুত মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছে। সরকারের দিক থেকে কোনোরকম অসততা, চালাকি দেশকে বিপদে ফেলে দিতে পারে, মানুষকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলতে পারে। মাসের পর মাস ঘরবন্দি, বিধ্বস্ত, স্বজনহারা মানুষকে আশ্বস্ততার ও পারস্পরিক বিশ্বাসের জাদুতেই পরিচালনা করা সম্ভব। তাই সারাবিশ্বের কোনো দায়িত্ববান সরকারকে দেখা যায় নি এই সময়ে দেশের নতুন ‘‘শিক্ষানীতি’’ প্রচলন করতে, কৃষিনির্ভর দেশে নতুন কৃষি নীতি প্রবর্তন করতে। মানুষের উপরে বিশ্বাস, আস্থা হারিয়ে গেলেই সবাইকে ঘরে আটকে রেখে এমন বিতর্কিত, ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার ইচ্ছা জাগে সরকারের। মানুষ অবাক চোখে বিস্ময়ের সাথে দেখেছে সরকার মানুষের এই অসহায় অবস্থায় রেল, ব্যাঙ্ক, এলআইসি, লাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠান বেচে দেওয়া শুরু করেছে তাদের হাতে, যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় তারা ক্ষমতায় এসেছে। বাসে উঠলে কন্ডাক্টর অনেক সময়েই বলেন ‘‘পিছনের দিকে এগিয়ে যান’’। দেশেও একই অবস্থা। চারদিকে মানুষের টাকা লুঠের পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করা হচ্ছে।
ব্যাঙ্কের টাকা শোধ না করলেও চলে কাদের? উত্তরটা সবাই জানে - বড়ো ব্যবসায়ীদের, শিল্পপতিদের। যোগ্যতা একটাই - ছলেবলে কৌশলে শাসকদলের লোক হয়ে উঠতে হবে। তাহলে সব বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। কয়েক বছর অন্তর ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণকে কুঋণ হিসাবে দেখিয়ে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে সেই ঋণের হিসাব কেটে দেওয়া হবে। তবে এই পরিষেবা প্রদানের জন্যে সরকারের কোনো লাভ না হলেও, এটা সকলেই বোঝে যে মুফতে এ সুবিধা মেলে না। যারা সুবিধা পাইয়ে দেবার নেপথ্য কারিগর তাদের সুবিধা-অসুবিধা, নির্বাচনের খরচ, নানা বিজ্ঞাপনের দায়দায়িত্ব পালন করতে হয় বৈকি। দেশে যে সব বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীর ধার মকুব হয়, তাদের বাড়ির ছাদে হেলিকপ্টার নামে। ২০১৯ সালে কর্পোরেট ঋণ মকুব করা হয় ১,৭৫,০০০ কোটি টাকা। ঋণ পেতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাদের তারা গরিব, সাধারণ মানুষ, ছোটো ব্যবসায়ী আর কৃষক। আর ঋণ নিয়ে শোধ করতে দুদিন দেরি হলে হয়রানির শিকার হতে হতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় গরিব, সাধারণ মানুষ, ছোটো ব্যবসায়ী আর কৃষককে। গত ২১ বছরে চার লাখ কৃষক সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে চাষের খরচ তুলতে না পেরে। এদের ঋণ মকুব করতে সরকারের কলম সরে না। কিন্তু কোটি কোটি টাকা মেরে পালিয়ে গেলে বিদেশে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে দেশে অনাদায়ী ঋণ মকুবের ব্যবস্থা করে দিতে পারে বন্ধু সরকার।
সরকারের পর সরকার বদলে যায়, কিন্তু কৃষকের সমস্যার মৌলিক সমাধানের কথা কেউ ভাবে না। কৃষকরা চাপ তৈরি করলে মেলে কখনো প্যাকেজ, কখনো কিছুই মেলে না। কৃষকরা সমস্ত জিনিস সস্তায় বেচতে বাধ্য হয়, সেই জিনিসই বাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হয় সাধারণ মানুষকে। কৃষকরা ফড়ের হাতের পুতুল। সংসার চালানোর জন্য, চাষ করার খরচ জোগাড়ের জন্য, আগের ঋণ শোধ করার জন্য অধিকাংশ কৃষককেই ফসল ওঠার সাথে সাথেই মরিয়া হয়ে ফসল বিক্রি করতে হয়। তাদের কোমরে সেই জোর নেই যে অপেক্ষা করে ফসল বিক্রি করবে। হাজার একটা উদ্বেগ নিয়েই তো কৃষকের জীবন। ব্যাঙ্কের, মহাজনের ঋণ শোধ হবে কী করে, সারা বছর সংসার চলবে কী করে এই ভাবনা নিয়েই তো তার দিনযাপন।
১২ জানুয়ারি আদালত আইন রূপায়ণ স্থগিত করেছে (পরবর্তী আদেশ পর্যন্ত) ও চারজনের কমিটি তৈরি করে ২ মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলেছে। আদালতের রায়ে সন্দেহ বা নিযুক্ত কমিটিতে অনাস্থা কেন এ প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সরকার ও তার আস্থাভাজনদের পক্ষ থেকে। এককথায় বলা যায় - প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। সমস্যা সমাধানের পথে আর একটা অন্তরায় হয়ে উঠেছে এই কমিটি। কারণ এই কমিটির প্রত্যেকেই কৃষি আইনের সমর্থক হিসাবে নিয়মিতভাবে লিখে গেছেন বা টিভিতে মতামত রেখেছেন। উদাহরণ উল্লেখ করছি - ৯ জানুয়ারি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকাতে ‘‘নিড টু থিংক বিয়ন্ড এমএসপি’’ প্রবন্ধে প্রমোদ জোশী ও অনিল ঘানোয়াত ২৮ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাতে কী লিখেছেন দেখুন। কৃষিমন্ত্রীর কাছে ডিসেম্বরে প্রতিনিধিদলের সাথে গিয়ে আইন রূপায়ণের দাবি জানানোর জন্য ভি এস মান ইতিমধ্যেই পরিচিত। অর্থনীতিবিদ অশোক গুলাটিও টিভি ও সংবাদমাধ্যমে কৃষি আইনের পক্ষে বিখ্যাত সওয়ালকারী হিসাবে পরিচিত। এই চার মুখ নিয়ে আদালত কমিটি গঠন করার পর ‘‘আদালতের নিরপেক্ষতা’’ ও কৃষকদের আস্থায় ধাক্কা দেবার প্রবল সম্ভাবনা থেকেই যায়। সমস্যাটা এখানেই। সমস্যাটা আস্থায়, সমস্যাটা বিশ্বাসে, সমস্যাটা অভিজ্ঞতায়, সমস্যাটা সরকারের আন্তরিকতায়। শিল্পপতিদের ঋণমকুবে ক্লান্তি নেই, যত ধানাইপানাই কৃষকের ঋণমকুব করার সময়। যত দিন যাবে বঞ্চিত শ্রমিক, মেহনতি মানুষের ঢল নামবে কৃষকদের সাথে। গুটিকয়েক শিল্পপতি ও বড়ো ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষাই এই সরকারের একমাত্র অ্যাজেন্ডা এটা দিনে দিনে সকলের চোখেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে। ২৬ নভেম্বর থেকে কৃষকের ধরনা চলছে। আন্দোলন আন্দোলন বা ঝগড়া ঝগড়া বা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা করে বা খেলা দেখে বা খেলা দেখিয়ে যারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাদের তো আর ভালো লাগছে না। যারা আন্দোলনের খবর বা ছবি দেখাতে সময় পাননি, তারাও কৃষকদের এই অবাধ্যতা, নাছোড় মনোভাবে বিরক্তি প্রকাশে পাঁচ পা এগিয়ে রেখেছেন দিব্যি নির্লজ্জের মতো। সরকারের সাথে রাউন্ডের পর রাউন্ড আলোচনা শেষ হয়ে যাচ্ছে, সমাধান হচ্ছে না। কৃষকের এই ঔদ্ধত্য অবাক করে দিচ্ছে সরকারকে ও তার অনুগ্রহভাজনদের। মামলা, ভয়, কষ্ট উপেক্ষা করে পথে বসে আছে কৃষক। তাই ন্যায্য দাবি না মিটিয়ে এবার কৃষকদের রাস্তা থেকে তোলা কঠিন কাজ।