E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২২ জুলাই, ২০২২ / ৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

জনজীবনের উপরে ভয়াবহ আক্রমণে উদ্বিগ্ন পলিট ব্যুরো

কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির তীব্র সমালোচনা


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বিজেপি’র শাসনকালে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন এবং জীবিকার ওপর অভূতপূর্ব আক্রমণ নেমে এসেছে। বেড়েছে বেকারত্ব, ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, চরম আকার নিয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের চেহারা। এই সমস্ত বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো। ১৭ জুলাই, রবিবার বৈঠকের পর দিল্লি থেকে প্রচারিত সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর বিবৃতিতে একই সঙ্গে বিজেপি আমলে নাগরিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, শিক্ষাক্ষেত্রের ওপর আক্রমণ, আদিবাসীদের অধিকার যেভাবে খর্ব করা হচ্ছে, তারও সমালোচনা করা হয়েছে কঠোর ভাষায়। এরই সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে আগামী ১-১৫ আগস্ট নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পালন করা হবে বলে জানিয়েছে সিপিআই(এম)।

জীবন-জীবিকার ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি

বিশ্ব ব্যাঙ্কই জানাচ্ছে, ২০২০-২২ সালের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতির বার্ষিক বিকাশের হার সাকুল্যে ০.৮ শতাংশ।

বেকারত্বঃ
সিএমআইই রিপোর্ট অনুসারে চলতি বছরের জানুয়ারি-এপ্রিল মাসে ২০-২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা ২ কোটিরও বেশি। বিস্ময়করভাবে বেকারত্বের হার ৪২ শতাংশ। ২৫-২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা ৬০ লক্ষের বেশি, বেকারত্বের হার ১২.৭২ শতাংশ। আবার একসঙ্গে ধরলে ২০-২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই বেকার। ১৫ বছরের বেশি বয়সি ৩ কোটি বেকার ভারতীয় ভীষণভাবে কর্মসংস্থানের দিকে তাকিয়ে আছে।

মোট জনসংখ্যার নিরিখে ভারতের কর্মক্ষম মানুষের হার ৩৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৬১.২ শতাংশ মানুষ কাজ খোঁজাই ছেড়ে দিয়েছেন কাজের বাজারের আকালের জন্য। শ্রমিক অংশীদারিত্বের হার সর্বকালীন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে ৩৮.৮ শতাংশে।

দ্রুত হারে মূল্যবৃদ্ধিঃ
চলতি বছরের মে মাসে বার্ষিক পাইকারি মূল্যসূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫.৮ শতাংশ, যা ১৯৯৮ সাল থেকে সর্বাধিক। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১৪.৪ শতাংশ, প্রাথমিক পণ্য ১৯.৭১ শতাংশ, জ্বালানি ও শক্তি ৪০.৬৩ শতাংশ এবং কারখানায় উৎপাদিত পণ্য ১০.১১ শতাংশ।

এই ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশবাসীর ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। যার ফলে অর্থনৈতিক চাহিদাও নিম্নগামী। অভ্যন্তরীণ চাহিদার এই ঘাটতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়া। ফলে আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে কাজের বাজার।

বৈষম্যের নির্লজ্জ চেহারাঃ
সাম্প্রদায়িক-কর্পোরেট আঁতাত, ধান্দার পুঁজিবাদ এবং জাতীয় সম্পদের অবাধ লুটের ফলে আয় এবং ধনসম্পত্তির ফারাক কার্যত অশ্লীল স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে। বোম্বে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলির ২০২১-২২ সালে সম্মিলিত মুনাফার পরিমাণ ৯.৩ লক্ষ কোটি, যা তার আগের আর্থিক বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি। এমনকি অতিমারীর আগের এক দশকের বার্ষিক গড় মুনাফা আয়ের চেয়েও তিনগুণ বেশি।

একারণেই পলিট ব্যুরো মনে করে, অতি ধনীদের ওপর অবিলম্বে কর চাপানো উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের এবং তার থেকে আদায়কৃত রাজস্বে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার পরিকাঠামো গড়তে, কর্মসংস্থান বিকাশে এবং একই সঙ্গে অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধিতে।

রেগা

রেগায় যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের বকেয়া মজুরি দেওয়ার জন্য অবিলম্বে অর্থ বরাদ্দ করা উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের।

একই সঙ্গে রেগায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা উচিত কারণ কোটি কোটি গ্রামীণ যুবকের এটাই একমাত্র কর্মসংস্থান তথা জীবিকা।

বাধ্যতামূলক আধার প্রত্যাহার

শিশুদের পরিপূরক পুষ্টি কর্মসূচির ক্ষেত্রে বাধ্যতমূলক আধারের নির্দেশিকা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। ভুয়ো সুবিধাভোগী হটানোর অজুহাতে তৈরি এই নির্দেশিকায় ৬ মাস থেকে ৬ বছর বয়সি লক্ষ লক্ষ শিশুর বৈধ অধিকারকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। অথচ ২০১৩ সালে গৃহীত জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

এখন এই কর্মসূচির সুবিধাভোগ করে ৭.৯ কোটি শিশু। কিন্তু সরকারি তথ্য অনুযায়ী পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের মধ্যে মাত্র ২৩ শতাংশের আধার আছে। এমনিতে বিশ্বের মধ্যে ভারতের শিশুদের অপুষ্টির হার লজ্জাজনক।

শিক্ষার ওপর আঘাত

জাতীয় শিক্ষানীতির আগ্রাসী রূপায়ণের পাশাপাশি অতিমারীর সময়ে নানা ধরনের বিধিনিষেধের জেরে অনলাইন শিক্ষার রমরমা বেড়েছে। লক্ষ লক্ষ স্কুল বন্ধ ছিল এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ড্রপ আউটের হার বেড়েছে উদ্বেগজনক ভাবে। একইভাবে শিক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়বস্তুর ওপর মারাত্মক আক্রমণ নেমে এসেছে।

আদিবাসীদের অধিকারের ওপর আক্রমণ

বনাঞ্চল সংরক্ষণ আইনের সংশোধন করে আদিবাসীদের অধিকারের ওপর নানা দিক থেকে আক্রমণ নামিয়ে এনেছে মোদী সরকার। এই সংশোধনের লক্ষ্যই হলো বেসরকারি কর্পোরেটদের বনাঞ্চলের ওপর হস্তক্ষেপ এবং নিয়ন্ত্রণের সুবিধা করে দেওয়া যাতে তারা মুনাফা আরও বাড়াতে পারে। এই বিধিতে বনাঞ্চলের জমি রূপান্তরের জন্য গ্রামসভার অধিকার, আদিবাসী সমাজ সহ ঐতিহ্যবাহী অরণ্যবাসীদের আগাম সম্মতি নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল, তা সম্পূর্ণ নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। আদিবাসী সমাজের জন্য সংবিধানে বর্ণিত যে অধিকারের কথা বলা আছে তাও স্পষ্ট লঙ্ঘন করা হয়েছে ওই সংশোধনের মাধ্যমে। এই আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।

নাগরিক অধিকারের ওপর ক্রমাগত আঘাত

তিস্তা শীতলবাদ, জুবেইর মহম্মদ সহ অন্যদের যাবতীয় মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। এঁদের গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যই হলো বিরোধী স্বরের কন্ঠরোধ করা। যাঁরা জনগণের সামনে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির তৈরি করা ভুয়ো সংবাদ খণ্ডন করে সত্য তুলে ধরেন, তাঁদেরকেই আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিচ্ছে বিজেপি সরকার। যাঁরা বিদ্বেষ ভাষণ দিচ্ছেন তাঁরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন। উলটে যাঁরা এর বিরোধিতা করছে তাঁদেরই আইনের জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। ওই বিদ্বেষ বিষ ছড়ানোর প্রতি সরকারি পৃষ্টপোষকতা বন্ধ করা হোক।

বিধ্বংসী বন্যা

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বন্যার কারণে ধ্বংসের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পলিট ব্যুরো। আসামে ভয়াবহ বন্যায় বহু প্রাণহানি হয়েছে, ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সম্পত্তির, গৃহহীন হয়ে পড়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। একই ভাবে বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট সহ অন্যান্য অঞ্চলে। ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যগুলির ত্রাণ ও পুনর্বাসনে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় সম্পদ এবং সামগ্রী বরাদ্দ করা উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের।

ভিত্তিহীন অভিযোগের নিন্দা

ভারতের প্রাক্তন উপ রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির বিরুদ্ধে প্রমাণহীন এবং ভিত্তিহীন যে অভিযোগ এনেছে শাসক বিজেপি, তার তীব্র ভাষায় নিন্দা করছে পলিট ব্যুরো। আনসারি আন্তর্জাতিক স্তরে শ্রদ্ধেয় একজন কূটনীতিক, বিদ্বান এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে যে দায়িত্ব দিয়েছে তিনি সর্বদা তা দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন। একই সঙ্গে তাঁর দেশপ্রেমও প্রশ্নাতীত। আনসারিকে আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নেওয়ার কারণ তাঁর পরিচিতি, ভারতীয় সংবিধান এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের প্রতি অবিচল দায়বদ্ধতা।

কেরালার ঘটনা

কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে কেরালার এলডিএফ সরকারের স্থিতিশীলতা নষ্টের উদ্যোগের তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছে পলিট ব্যুরো। বিরোধী কংগ্রেস আংশিকভাবে এবং বিজেপি একসঙ্গে এলডিএফ সরকারকে হেনস্তায় নেমেছে।

ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর

পলিট ব্যুরো পার্টির সমস্ত ইউনিটকে ১-১৫ আগস্ট নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনের আহ্বান জানিয়েছে। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানিক সাধারণতন্ত্র, ভারতীয় সংবিধান, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষায় দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো।