E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২২ জুলাই, ২০২২ / ৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতির বিরুদ্ধে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মিছিল-সমাবেশ


কালিয়াগঞ্জের সুবিশাল সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন মহম্মদ সেলিম।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের অপশাসন, গণতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপ, আকাশ‍‌ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, তীব্র বেকারি, কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য, খেতমজুরের মজুরি বৃদ্ধি, রেগায় কাজ, পঞ্চায়েতে দুর্নীতি সহ জনজীবনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দাবি ও ইস্যু নিয়ে জেলায় জেলায় সভা-সমাবেশ সংগঠিত হচ্ছে। সিপিআই (এম) সহ ছাত্র, যুব, মহিলা, কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের ডাকে এই সমস্ত কর্মসূচিতে অগণিত মানুষ অংশ নিয়ে তাঁদের অধিকার ও দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন।

এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জে। ১৭ জুলাই সারা ভারত কৃষক সভার উত্তর দিনাজপুর জেলা ২৪তম সম্মেলন উপলক্ষে সুবিশাল প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিন প্রচণ্ড রোদ ও উত্তাপকে উপেক্ষা করে কালিয়াগঞ্জের তরঙ্গপুর নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের মাঠে মানুষের ঢল নামে। এদিনের সমাবেশ মঞ্চ নামাঙ্কিত হয়েছিল রমণীকান্ত দেবশর্মা, আলমগীরের নামে।

এই সমাবেশে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, জোতদার বা জমিদার, মস্তান বা লেঠেলবাহিনী হোক, আর পুলিশ হোক - তাদের মোকাবিলা করেই শক্ত ডাণ্ডায় লাল ঝান্ডাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ফসল নিজে তুলতে হবে। সব সময় সঙ্গে থাকবে কৃষকসভা। তেভাগা থেকে তেলাঙ্গানা জমির দাবিতে, মানুষের হকের দাবিতে, কৃষক নিজের ফসল নিজের করে তুলতে পুলিশের কোনও বাধাই মানেনি। মানুষ ছিলেন জোটবদ্ধ। গত ১১ বছরের রাজ্যের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কৃষকের কাস্তের ধার যদি কমে গিয়ে থাকে তবে কাস্তেটাকে ধার দিয়ে নিজের জান, মান বাঁচাতে হবে।

তিনি বলেন, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের নানা জনবিরোধী পদক্ষেপ, অপশাসনে মানুষের জীবন যন্ত্রণার অবসানে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার তেভাগার ইতিহাস স্মরণ করে পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় লালঝান্ডার মাটিকে শক্ত করতে হবে।

সমাবেশে সারা ভারত কৃষকসভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার বলেন, মমতা ব্যানার্জি রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজ্যে ২৬৪ জন কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। চাষযোগ্য জমি এখন চুক্তির ভিত্তিতে চলছে। নিজের জমি নিজের লাঙ্গল থাকা সত্ত্বেও নিজে চাষ করতে পারছে না। বিপুল সংখ্যক মানুষ রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। রাজ্যে কলকারখানা হবে না। মানুষের বাঁচার রাস্তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির আম্বানি-আদানিরা দিদিমণির হাত ধরে চলে যাচ্ছে বাজার ব্যবস্থায়। দি‍‌দি আর মোদি মানুষকে ভিক্ষুকে পরিণত করবে - এটাই ওদের কৌশল। এসবের বিরুদ্ধে মানুষ যখন জোটবদ্ধ হচ্ছেন, তখন মানুষে মানুষে বিভাজন, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে গণআন্দোলনই হাতিয়ার।

কৃষকসভার রাজ্য সভাপতি বিপ্লব মজুমদার বলেন, দেশজুড়ে ৩৭৮ দিনের কৃষক আন্দোলনে ভারত সরকারের পিছু হটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আমাদের জেলা, ব্লক, গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে পৌঁছাতে হবে। পুলিশ, মস্তান, জোতদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দিনাজপুর জেলার তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাসকে স্মরণে রেখে লড়াইয়ের মাঠকে আরও প্রসারিত করার আহ্বান জানান তিনি।

সমাবেশে সিপিআই(এম)’র জেলা সম্পাদক আনোয়ারুল হক বলেন, বাপ-ঠাকুরদার আমলের জমির চরিত্র বদল হচ্ছে, পাট্টা বদল হচ্ছে। বিএলআরও অফিস বাস্তুঘুঘুর বাসায় পরিণত হয়েছে। অধিকারের লড়াইকে প্রতিষ্ঠিত করতে গণআন্দোলনই একমাত্র হাতিগার।

এদিনের সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের জেলা সভাপতি পরিতোষ রায়। সভায় এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সংগঠনের জেলা সম্পাদক সুরজিত কর্মকার।

দুর্গাপুরে বক্তব্য রাখছেন সুশান্ত ঘোষ।

দুর্গাপুরে সমাবেশঃ সিপিআই(এম) দুর্গাপুর পূর্ব-৩ নম্বর এরিয়া কমিটির ডাকে ১৯ জুলাই বিধানগর হাসপাতাল সংলগ্ন ময়দানে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৬৫টি বুথ এলাকার অগণিত মানুষ এদিনের সমাবেশে শামিল হয়েছিলেন। মানুষ এসেছিলেন লালঝান্ডা নিয়ে স্লোগান মুখরিত মিছিল করে। সমাবেশে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত এম এ এম সি, বি ও জি এল, এইচ এফ সি কারখানার কাজ হারানো শ্রমিকরাও উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন কাজ না পাওয়া অসংখ্য বেকার যুবক-যুবতী। ছিলেন ২০১৭ সালে পৌর কর্পোরেশন নির্বাচনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারা নাগরিকরা। ওই নির্বাচনে শাসক দলের সশস্ত্র বহিরাগত দুষ্কৃতী বাহিনী নাগরিকদের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল। চলতি বছরের ৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পৌর কর্পোরেশন নির্বাচন হবার কথা। পার্টি ডাক দিয়েছে - এবার আর লুটের পৌর বোর্ড নয়, জনগণের পৌর বোর্ড গঠন করো।

এদিনের সমাবেশে পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য সুশান্ত ঘোষ বলেন, ভয়ের আবহ তৈরি করে এরাজ্যে সরকার চলছে। কিন্তু সব সময় মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখা যায় না, যাবেও না। মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেই। মানুষ যেদিন ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাধারী‍দের তাড়াবে, সেদিন পিছন ফি‍‌রে তাকানোর সুযোগ পাবে না। শ্রীলঙ্কার ঘটনা তারই তাজা উদাহরণ।

সমাবেশে এছাড়া বক্তব্য রাখেন পার্টি নেতা পঙ্কজ রায়সরকার। সভাপতিত্ব করেন রাকেশ শর্মা।


মল্লারপুরে কৃষক খেতমজুরদের ‍‌বিক্ষোভ সভাঃ ১৮ জুলাই বীরভূম জেলার মল্লারপুরে সারা ভারত কৃষকসভা ও সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের ময়ূরেশ্বর ১ ব্লকের উদ্যোগে ৯ দফা দাবিতে মিছিল, বিক্ষোভ সভা এবং বি এল আর ও-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে কৃষক-খেতমজুর ও আদিবাসী মহিলারা প্রচণ্ড দাবদাহকে উপেক্ষা করে মিছিলে অংশ নেন। মিছিলে অংশ নেন গণআন্দোলনের নেত্রী দেবলীনা হেমব্রম, শ্যামলী প্রধান সহ কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ‘বি এল আর ও অফিসে বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙো, কৃষক উচ্ছেদ বন্ধ করো’ - এই স্লোগানে সোচ্চার হয়ে কৃষক খেতমজুররা মল্লারপুর শহর মিছিলে পরিক্রমা করে সমবেত হন বিএলআরও অফিস চত্বরে। সেখানে তারা দাবিগুলি নিয়ে বিক্ষোভ দেখান।

এই বিক্ষোভ সভায় দেবলীনা হেমব্রম বলেন, কেন্দ্রের বিজেপি, রাজ্যের তৃণমূল সরকারের আমলে কৃষক, খেতমজুর সহ সবাই আক্রান্ত। আমরা ৩৪ বছর সরকারে ছিলাম। তখন রাজ্যের মানুষ শান্তিতে বসবাস করেছেন। আর আজ মানুষ আতঙ্কে। মানুষ বাঁচার পথ খুঁজছেন। তৃণমূল-বিজেপি জাতির নামে বজ্জাতির খেলা খেলছে। মানুষের ক্ষোভকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে তারা এসব করছে। আমাদের লড়াই জাতি-ধর্মের নয়, ভাতের লড়াই। লড়াই করেই আমাদের অধিকার আদায় করতে হবে। পঞ্চায়েতে লুটেরাদের হটাতে হলে সমস্ত গরিব মানুষকে জোট বাঁধতে হবে। আপনারা সেই লড়াইয়ের জন্য তৈরি হোন।

এছাড়াও এদিনের সভায় বক্তব্য রাখেন জেলার গণআন্দোলনের নেতা সঞ্জীব বর্মণ, কৃষক নেতা অরূপ বাগ, খেতমজুর আন্দোলনের নেতা জুড়ান বাগদি প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন আশিস মণ্ডল। সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন বিধায়ক ধীরেন লেট, অশোক চ্যাটার্জি এবং শ্যামলী প্রধান। বিক্ষোভ সভার পরে কৃষক-খেতমজুর ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিএলআরও-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।


নন্দীগ্রামে যুবদের মিছিল-সমাবেশঃ ছাত্র নেতা আনিস খানের হত্যার বিচারের দাবি সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ১৯ জুলাই নন্দীগ্রামে মিছিল, সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিনের এই মিছিলে ছাত্র-যুবদের সঙ্গে অন্যান্য অংশের মানুষ অংশ নেন। এদিন উত্তাল যৌবনের ঢল জানান দিয়েছে আনিস হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত লড়াই জারি থাকবে। ডিওয়াইএফআই নন্দীগ্রাম ১ ও ২ লোকাল কমিটির ডাকে এদিন নন্দীগ্রাম বাজার ও রেয়াপাড়ায় সুবিশাল মিছিল হয়েছে।

এদিন নন্দীগ্রাম বাস স্ট্যান্ডের সভায় সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, এখন তৃণমূলের কিছু দুর্বৃত্ত বিজেপি-তে গিয়ে ভালো ভালো কথা শোনাচ্ছে। এই দুর্নীতিগ্রস্ত সন্ত্রাসকারীরা নন্দীগ্রাম জুড়ে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। প্রতিনিয়ত গণতন্ত্রকে হত্যা করছে। ধর্মের নামে বিভাজন করছে। বেকারদের কাজের কথা এদের মুখে শোনা যায় না। নন্দীগ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দাবিতে লড়াইয়ে বামপন্থীরা আগেও ছিলেন, এখনো রয়েছেন।

তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সমস্ত শহিদের রক্ত ঋণ শোধ করতে হবে। রাজ্য ও কেন্দ্রের সরকারের নীতির বিরুদ্ধে আমাদের নীতির লড়াই জারি রাখতে হবে।

এদিনের সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি সাহা, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক ইব্রাহিম আলি সহ সংগঠনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।


রাধামণিতে মিছিল সমাবেশঃ গত ১৮ জুলাই কেন্দ্র ও রাজ্যের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে, মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং বেকারদের চাকরির দাবিতে তমলুকের রাধামণিতে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশের আগে আনিস হত্যার সিবিআই তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিশাল মিছিল হয়েছে।

ডিওয়াইএফআই, এসএফআই, সারা ভারত কৃষক সভা, সিআইটিইউ, খেতমজুর ও মহিলা সংগঠনের ডাকে এদিনের সমাবেশ-মিছিল সংগঠিত হয়েছে।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মীনাক্ষী মুখার্জি, ধ্রুবজ্যোতি সাহা, ইব্রাহিম আলি, পরিতোষ পট্টনায়েক প্রমুখ। সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক নিরঞ্জন সিহি, রীতা দত্ত, চন্দ্রশেখর পাঁজা সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।