E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২২ জুলাই, ২০২২ / ৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

মনের আয়নাখানা

বনবাণী ভট্টাচার্য


অতীত মৌন। তবু অতীত বাঙ্‌ময়। কথা বলে। সোচ্চার তার ব্যঞ্জনায় - কথা বলে তার অনড় অস্তিত্বে।

১৪ জুলাই পতন ঘ‍‌টেছিল বিশালকার দৈত্যের মতো বীভৎস, অন্ধকার এক জান্তবসৌধ যার সর্বাঙ্গে অসহায় অত্যাচারিত নিরীহ বন্দির দীর্ঘ নিঃশ্বাস আর রক্ত ছড়ানো - সেই ভয়ঙ্কর বাস্তিল দুর্গের। সমাজ বিপ্লবের বর্ণমালা লেখার প্রথম ভূর্জপত্র। আজও, চিলিই হোক, কলম্বিয়াই হোক আর শ্রীলঙ্কাই হোক, বিদ্রোহ-বিপ্লব, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, যে কোনো পরিবর্তন ফিরে ফিরে তাকায়, প্রথম-আদি সেই শক্তির দিকে।

তাই, সে অতীত আতঙ্ক ছড়ায় অনেকের মনে। এধার-ওধার সামান্য পরিবর্তন বা ভেঙে গুঁড়িয়ে, অতীত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায়। বহুজন, না হলে তা দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায় অনেক সময়।

এ কারণেই হয়তো তিন-চার বছর যেতে না যেতেই বাংলার রাইটার্স বিল্ডিং হয়ে উঠল গঙ্গার ওপারের নবান্ন। পুরনো মহাকরণে বর্ষীয়ান শ্রদ্ধেয় মুখ্যমন্ত্রী জাতীয় কংগ্রেস নেতা ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় আর তরুণ, বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার, প্রবল কমিউনিস্ট জ্যোতি বসুর সশব্দ হাসি-মস্করার হয়তো শব্দ ভেসে ওঠে। হয়তো, অলিন্দে অলিন্দে রাজ্যের দীর্ঘতম সময়ের মুখ্যমন্ত্রী জননেতা জ্যোতি বসু আর তাঁর একান্নবর্তী পরিবার বামফ্রন্টের নেতা-মন্ত্রী থেকে কমিউনিস্ট বিরোধী, কট্টর প্রতিপক্ষদের সাথে সৌহার্দ্য-সৌজন্য আর গণতন্ত্রের বর্ণলিপি ভেসে ওঠে। যাদের কাছে নিজের সরকারি কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনার দাবিকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ বলতে সৌজন্যে বাঁধে না, যারা পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভাকে বিরোধী-শূন্য করাকেই গণতন্ত্র বলে প্রতিষ্ঠা দিতে উন্মত্ত, তাদের ওই অতীতের গণতান্ত্রিক সৌজন্য-সৌহার্দ্য আর উদার গণতান্ত্রিকতার মহৎ ঐতিহ্য তাড়া করে - তাই রেহাইয়ের পথ, রাজ্যবাসীর ধরা-ছোঁওয়ার বাইরের সুরক্ষিত দুর্গ নবান্ন।

ওই একই তো তাগিদ, ভাঙাচোরা রাস্তার একটা কালভার্ট থেকে বাম-আমলের করা একটা জীর্ণ সেতু, এশিয়ার বৃহত্তম স্টেডিয়াম থে‍‌কে গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভিত্তি নির্মাণ বা দ্বারোদ্ঘাটনের ফলক সরিয়ে নতুন নামের নতুন ফলক বসানোর হুড়োহুড়িতে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের বাম সরকার ও তার সমর্থক বিশাল নির্বাচকমণ্ডলীর কখনও তো সল্টলেককে বিধাননগর বলে উচ্চারণ করতে জিভ আড়ষ্ট হয়নি - কখনও তো দাবি ওঠেনি বাম মন্ত্রীসভায়, ডাঃ বিধান রায়ের মানস কন্যা ‘কল্যাণীর’ নাম বদল করতেই হবে নব্যগঠিত শহর, জ্যোতি বসু নগরের মতো?

কোনো বাম প্রতিনিধি, পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের নীতি ও শাসনের সমালোচনা ও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েও, রাজ্যের অগ্রগতিতে তাদের সামান্যতম অবদানকেও উপেক্ষা অসম্মান বা অস্বীকার করেনি। সকলেই জানে অতীতের ভিতেই বর্তমান গড়ে ওঠে। কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলায় এই সংকীর্ণতার দৃষ্টান্ত, স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রেলের শিয়ালদহ স্টেশনের দ্বারোদ্ঘাটন হয়েছে সেদিন। মেট্রো, কেন্দ্রীয় সরকার ও ভারতীয় রেলের অধীন। তারা উদ্বোধনের আয়োজক ও ব্যবস্থাপক। উদ্বোধন হয়েছে - মেট্রোর চাকা ঘুরেছে আগের তুলনায় আরও কত কিলোমিটার। কিছুই আটকে থাকেনি - সাংবিধানিক নিয়ম-অনিয়মের প্রশ্ন নেই ঠিকই, কিন্তু যে মা‍‌টিতে দাঁড়িয়ে, এই উৎসব আয়োজন, সেই রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক, মুখ্যমন্ত্রী অনুপস্থিত কেন? তাঁর উপস্থিতি সম্ভব কিনা, খোঁজ-খবর নেওয়া হয়েছিল কী? মুখ্যমন্ত্রী যখন, কেন্দ্র ছাড়া, তখনই কেন হলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ? হতে পারে, এ সমস্তটাই দুই শাসকের ‘মিউচুয়াল গেম’, কিন্তু অসৌজন্য ঢাকা পড়ে না তাতে। যে তাচ্ছিল্যে একখানা নিমন্ত্রণপত্র মুখ্যমন্ত্রীকে ছুঁড়ে মারা, তা অভদ্রতার চূড়ান্ত। এর নিন্দা তর্কাতীত।

কিন্তু কেন্দ্রে বিজেপি এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকার তো সব সময়েই ‘হাম কিসিসে কম নেহি’। মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতি, তাঁকে গুরুত্ব না দেওয়া নিয়ে তাঁর দলের ক্ষোভ, রাজ্যের বিরোধীদের সমালোচনা বিজেপি’র বিরুদ্ধে অত্যন্ত সঙ্গত। কিন্তু শাসকদলের, নিজেদের স্তুতিগান কি সমস্ত সঙ্গত সীমা অতিক্রম করেনি? তৃণমূল দল যেভাবে কলকাতা মেট্রো রেলকে শাস্ত্রীয় কায়দায় ‘আমা হইতে শুরু, আমাতেই শেষ’ বলে মেট্রো রেলের উত্থান-পতনের ইতিহাস রাজ্যবাসীকে শোনাতে লাগল মিথ্যার জারকে তার তুলনা তারাই। ২০০৯ সালে, বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে উদ্বোধনের অধ্যায় দায়িত্বশীল বর্তমান মন্ত্রী ও মেয়ররা উহ্য রেখে, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর আগাগোড়া, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর চিন্তার ফসল বলে উপস্থিত করায়, যে রাজনৈতিক দৈন্য প্রকট হয়ে পড়ল, তাকে কোন্‌ বৈভবে ওরা ঢাকবেন? মেট্রো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প ঠিকই, কিন্তু ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর পরিকল্পনা - আগাগোড়া বামফ্রন্টের। গঙ্গার তলা দিয়ে মেট্রোর গতিপথের মতো অসম্ভবের স্বপ্ন দেখানো সকলের ক্ষমতায় থাকে না - সে স্বপ্ন, সে অসম্ভবের পরিসর সেদিন দিয়েছিলেন জননেতা - জ্যোতি বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-সুভাষ চক্রবর্তীদের মতো স্বপ্ন ও বাস্তবের মেলবন্ধন ঘটাবার স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা। দিদির ভাইয়েরা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যেভাবে মিথ্যাচার করে ইতিহাস মুছে দিতে চেয়েছে, এই নির্লজ্জতা ক্ষমাহীন। কিন্তু ইতিহাস বাচ্চা ছেলের স্লেটে লেখা থাকে না যে, তা ইচ্ছে করলেই জল দিয়ে মুছে ফেলা যায়। তাই, সেদিন যেমন জ্যোতিবাবু-সুভাষ চক্রবর্তীদের স্মরণসভার শোক প্রস্তাবগুলিতে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর স্বপ্নকে শরীরী রূপ দেবার জন্য তাঁদের ভূমিকার কথা লেখা হয়েছিল, তেমনি আজকের টিভি’র ‌আলোচনা থেকে শুরু করে - সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্রকরণে তা ভেসে ভেসে উঠছে। অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হয়ে যায়?

এভাবেই চলছে, আজকের ভারত। অতীতকে ক্ষতবিক্ষত করা, ফালাফালা করার কুটিল আগ্রহ, যখন তখন মাথাচারা দিয়ে, বেরিয়ে আসতে চাইছে। ইন্ডিয়া গেটের জওয়ান জ্যোতি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে - দেশের মানুষের অনুভূতিতে তা কতটা আঘাত করেছে, তার হিসেব কষার প্রয়োজনবোধ করেনি ‘মন কি বাত’-এর সরকার।

সেদিন নতুন নির্মীয়মাণ সংসদ ভবন সেন্ট্রাল ভিস্তায় জাতীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভ উন্মোচন করলেন প্রধানমন্ত্রী। এই মুহূর্তে দেশ বহির্শত্রুর আক্রমণে, বা অভ্যন্তরীণ কোনো মরিয়া সন্ত্রাসে উত্তপ্ত নয়, জরুরি অবস্থার বেড়াজাল থেকেও মুক্ত। তবু সরকারি এই অনুষ্ঠানের খুব একটা ঢাকঢোল পেটানো হলো না যেমন, তেমনি উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না, প্রধানমন্ত্রী, দু’জন অন্য মন্ত্রী, স্পিকার ছাড়া ওই অনুষ্ঠানে বাকিরা অনুপস্থিত কেন। বিরোধীদের কথা বাদ দিলেও অন্যান্য বিশিষ্টরা সহ রাজ্যসভার চেয়ারম্যান কেন যাননি? কোটি কোটি টাকার কোটের ঝলকানি যার শরীরে থাকে, তাঁর অনুষ্ঠান এমন ম্যাড়মেড়ে - জাঁকজমকহীন হঠাৎ কেন?

ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতির প্রধানমন্ত্রী ৫.৬ মিটার আর ৯৫০০ কিলোগ্রাম ব্রোঞ্জের অ‍‌শোক স্তম্ভের আবরণ উন্মোচন করলেন, নিশ্চয়ই শ্লাঘার বিষয়। কিন্তু গলদ রয়ে গেল আসলটাতে - সিংহভাগ বদল হলো চার সিংহের। মাটির তলার চার শান্ত-নিরীহ-সিংহ সেন্ট্রাল ভিস্তার মাথায় চেপে, একেবারে বন্য-হিংস্র-মানুষ খেকো হয়ে উঠল। বিশিষ্টরা বলছেন আহত মনে, জাতীয় প্রতীকের বদল ঘটেছে। জাতীয় প্রতীক ছেলের হাতের খেলনা নয়, যে পছন্দ না হলে তা পাল্টে দেওয়া যায়।

ভারতের জাতীয় প্রতীক, সারনাথের মাটির তলায় থাকা, মৌর্যযুগের অশোক স্তম্ভের রেপ্লিকা, ১৯৫০ সালে যা ভারতের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় প্রতীকের নকশা করেছিলেন রবীন্দ্র স্নেহধন্য, স্বয়ং নন্দলাল বসু। তিনি তাঁর ছাত্রদল নিয়ে, চিড়িয়াখানায় পর্যবেক্ষণ করেছেন, সিংহের স্বাভাবিক রাজকীয় শৌর্যময় শরীরী প্রকাশ। বর্তমান বিকৃতি আহত করল বিশ্বকবির শান্তি নিকেতনের অন্তর্লোককেও। এই অশোক স্তম্ভের সিংহরা, ক্ষমতা-শৌর্য-আত্মবিশ্বাস ও সাহসের প্রতিরূপ হয়ে থেকেছে। শান্ত-মহিমান্বিত সিংহরা তাদের কেশর বদল নিয়ে ভয়ানক ক্রুদ্ধ এবং ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে। এমন উগ্র এবং আগ্রাসী চেহারার মধ্যে রাজা অশোক বা ভারতের শান্তির বাণী খুঁজে পাওয়া যায় না।

এই অশোক স্তম্ভের ভাস্কর ঔরঙ্গাবাদের সুনীল দেওরে ও রোমিয়েল মোজেস ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, আসল অশোক স্তম্ভের বিশেষ কোনো বদল হয়নি, তবে সারনাথের স্তম্ভ মাটিতে আর এখানে মাটি থেকে ৩৩ মিটার উপরে যা রয়েছে তার রূপ একদম এক হয় না। নিচ থেকে দেখলে সিংহের হা-করা মুখের দাঁত ইত্যাদিই প্রধানভাবে দেখা যায় বলে এই সিংহ ক’টিকে হিংস্র দেখাচ্ছে। তবে ভাস্কররা এবং তাদের উপদেষ্টারা তো জানতেনই এই উচ্চতার কথা, জানতেনই তো যে, সেন্ট্রাল ভিস্তার মাথায় চেপে তো মানুষ সিংহদের দেখবেন না - দূর থেকেই তো দেখবেন, শিল্পশৈলীতে সেই সতর্কতা নেওয়া হলো না কেন?

নৃতত্ববিদ্‌-ইতিহাসবিদ-মনস্তাত্বিকরা মনে করেন সঠিকভাবেই - মডেল থেকে মডেলের সামান্য পরিবর্তন হয় বা হয়ে থাকে - তা বলে মূলগত হয় কি? গৌতম বুদ্ধ-গান্ধীজি-বিবেকানন্দ-নেতাজির বিভিন্ন মূর্তি ভারতের প্রান্ত থেকে প্রান্তে ছড়িয়ে আছে, তাতে বদল আছে - কিন্তু এঁরা যে তাঁরাই, সে পরিচয় দেওয়ার জন্য ঘোষক দাঁড় করাতে হয় না। নতুন এই প্রতীকের চরিত্র এবং প্রকৃতিগত বদল ঘটেছে। গৌতম বুদ্ধের মূর্তিগুলিতে যে বদলই ঘটুক, তাঁর অহিংসা-প্রেম ও শান্তির লালিত্যের বিভার অভাব ঘটে না।

বিশিষ্ট সাংসদ এক হালকা সুরে বললেও কথাটা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। প্রশ্ন তুলেছেন, ওই সিংহরা সারনাথের না গির অরণ্যের। ভারতকে ছেয়ে ফেলা হচ্ছে তো সব বিষয়েই গুজরাট মডেলে। তেমনিই হয়তো, সারনাথের রাজকীয় সাহসী সিংহদের স্থান নিয়েছে তেড়ে আসা হিংস্র নরখাদক সিংহরা। এই বিকৃত প্রতিরূপ সংবিধান ও জাতীয় প্রতীকের অস্বীকার ও অবমাননা, যা প্রতিবাদ ও প্রত্যাহারযোগ্য। উগ্র হিন্দুত্বের ঔদ্ধত্যপূর্ণ এই মডেল, বহুত্ববাদী ভারতকে আঘাত করে।

শুধু সিংহদের চরিত্র ও প্রকৃতির বদল নয়, পরিবর্তন যথেষ্ট মৌলিক জাতীয় প্রতীকে। এতকালের অশোক স্তম্ভের তলায় লিপিবদ্ধ ছিল, উপনিষদের চিরকালীন বাণী - ‘সত্যমেব জয়তে’, সেন্ট্রাল ভিস্তায় তা খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই।

আসলে মানুষের মুখ যেমন, তার কাজ যেমন, তার হাতের লেখা যেমন, তার মনের আয়না, তেমনি সেন্ট্রাল ভিস্তার নবনির্মিত অশোক স্তম্ভ বর্তমান শাসকের দর্শন-নীতি ও শাসনের দর্পণ। ঠাট্টা করে কেউ কেউ বলেছেন - এ সঙ্ঘীদের প্রতীক, জাতীয় প্রতীক নয়। সিপিএম নেতা টমাস আইজ্যাক বোধ হয় একেবারে ভিতরের কথাটাকে উপরে টেনে এনেছেন যে, এই সিংহমূর্তি উগ্র হিন্দুত্বের প্রতীক।

এখন তো ভারতজুড়ে, ডিজে থেকে ব্যান্ড একই সুর বাজে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান। প্রধানমন্ত্রী, নানা ধর্মের মানুষের দেশ ভারতের জাতীয় প্রতীক উন্মোচন হিন্দু মতের পূজা উপাচার প্রার্থনা দিয়ে। ভারত রাষ্ট্রের ধর্ম হিন্দু, এ কে ঠিক করল, কোথায় ঠিক হলো? ভারত রাষ্ট্রের তো নিজের কোনো ধর্ম নেই। সে তো ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মীয় আচার উদ্‌যাপনে তার ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় থাকে না। এই পূজাপাঠ মোদি সরকারের সচেতন ও পরিকল্পিত প্রয়াস - জাতীয় প্রতীক উন্মোচনে নির্দিষ্ট ধর্মীয় অনুষ্ঠানের স্পষ্ট বার্তা - ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় সম্প্রীতি নস্যাৎ করা। সংঘ পরিবারের চিরলালিত ইচ্ছার সম্মান দিলেন সংঘের প্রচারক - প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

এই সঙ্ঘীদের বরাবরের আক্ষেপ, বৌদ্ধ ধর্ম ভারতকে নিবীর্য করেছে অহিংসা অহিংসা করে। তাদের খুবই অপছন্দের রক্তপিপাসু চণ্ডাশোকের ধর্মাশোকে পরিণত হওয়া। তাই, ওই চণ্ড চেহারার আগ্রাসী সিংহরা সংঘ পরিবার ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বড়ো আদরের - যাদের কেশর হাত বুলোতে বুলোতে সারনাথের সিংহদের কেশর থেকে অনেক কর্কশ ও অমসৃণ হয়ে গেছে।

গুজরাট মডেল তো হিংস্রতার মডেল - তরোয়ালের ডগায়, রক্তাক্ত ভ্রূণের মডেল। ধর্মীয় বিদ্বেষের বার্তা-গুজরাট ২০০২। কমনীয় সিংহরা তাই হয়ে উঠেছে রুক্ষ্ম এবং উগ্র। হিন্দু সংস্কৃতির সম্প্রীতি উদারতা-মিলনের সুর ‘বসুধৈবকুটুম্বকম্‌’ তাড়িয়ে ‘মুসলমানকা দোনো স্থান, পাকিস্তান ও কবরস্থান’-এর কালোয়াতি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশজুড়ে। আর ভারতকে মুসলিমদের কবরস্থানে পরিণত করতে চাই, গোরক্ষক থেকে শুরু করে লভ্‌জেহাদের বাহিনীর দীর্ঘ সারি - যা হয়তো একদিন ৪ বছরের অগ্নিপথের অগ্নিবীরদের দিয়ে আরও পুষ্ট করা সম্ভব হবে। হিটলারের আহ্বান ছিল আর্য নারীরা দ্রুত জার্মান যোদ্ধৃ সন্তানের জন্ম দিক - আর্য শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বীর যোদ্ধা চাই। হিটলারের জুতো মাথায় নেওয়া সঙ্ঘীদেরও আজ হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণে যুদ্ধ উন্মাদ ভারতীয় সন্তানের প্রয়োজন, তাই রাজকীয় বিক্রমের কমনীয় সিংহ নয়, জাতীয় প্রতীকে স্থান নিয়েছে ক্রুদ্ধ-অসহিষ্ণু-রক্তপিপাসু-হিংস্র-সিংহরা।

আর, ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’ - থাকেওনি। ‘সত্যমেব জয়তে’র অনুল্লেখ কোনো অসতর্কতা নয় - লক্ষ্য নির্দিষ্ট। হিন্দুরা হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ করবে রক্তের বিনিময়েও - শুধু ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় এরা থামবে না। তাই আগামী ভারত হলো হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণে অস্ত্রের ঝন্‌ঝনা আর রক্তধারা - আর তাই বীর্য ও বিক্রমের সংঘীদের জয়যাত্রা।

অশোক স্তম্ভের তলায় - ‘সত্যমেব জয়তে’ ভাস্বর হোক না হোক, সত্য তো চির ভাস্বর। সূর্যকে কে পারে বাক্সে বন্দী করে রাখতে? ভারতের বহুত্ববাদ ও সম্প্রীতির ঐতিহ্যের সত্য, মোদি চান বা না চান, জয়রথে উঠে যাত্রা করবেই। মিথ্যা ও বিকৃতি সত্যের চেয়ে শক্তিধর নয়। এই সত্যের ধারক ভারতীয় জনগণ।