৫৯ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২২ জুলাই, ২০২২ / ৫ শ্রাবণ, ১৪২৯
পণ্য পরিষেবা করের হার পরিবর্তন দেশের আর্থিক নীতির অঙ্গ
ঈশিতা মুখার্জি
সম্প্রতি পণ্য পরিষেবা কমিটির বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত কার্যকরী হয়েছে সারা দেশে। এর ফলে বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নতুন করের হার সহ দাম বেড়ে গেছে। কর বেড়েছে এক লাফে অনেকটা। যে পণ্য এই করের আওতার বাইরে ছিল, সেই পণ্যও এবার করের আওতার মধ্যে চলে এল। এমনভাবে এই কর মানুষের নিত্যব্যবহারিক পণ্যের উপরে চেপে গেল যে আমজনতার নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। দেশে এমনিতেই মুদ্রাস্ফীতির চাপ, বেকারি বাড়ছে রেকর্ড পরিমাণে, মানুষের আয় ক্রমাগত কমে আসছে, দেশের জণকল্যাণ খাতে ব্যয় কমছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশে অনাহার, অপুষ্টি বাড়ছে। দেশে আর্থিক বৈষম্য চরমে উঠেছে। এই অবস্থায় এই নতুন করের বোঝা মানুষের খাবার থালা থেকে খাবার তুলে নিচ্ছে বলা যায়। অথচ পেট্রোল-ডিজেল এই করের আওতা থেকে বাইরে। কিন্তু পেট্রোল ডিজেলের উপর কেন্দ্র, রাজ্য উভয় সরকার কর না চাপিয়ে যদি পণ্য পরিষেবা কর বসাত, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে তেলের দাম কমে আসত। সাধারণ মানুষের উপর কর চাপাতে বিজেপি-আর এস এস সরকার এক মুহূর্ত দ্বিধা করে না। কিন্তু ক্রমাগতই নানা ক্ষেত্র থেকে বলা হলেও ধনী এবং অতি ধনীদের উপর সরকার করের বোঝা চাপাবে না। কোটিপতিদের কার্যত করের বোঝা লাঘব করে আমজনতার উপর বোঝা চাপাল সরকার। এটা কি সরাসরিভাবে অতি ধনী কর্পোরেটকে সুবিধা করে দেওয়া নয় সাধারণ মানুষের স্বার্থে আঘাত হেনে? এই সরকার প্রচ্ছন্নভাবে কোটিপতি, ধনী থেকে অতি ধনীদের মদত দিয়ে চলেছে কারণ এরাই সরকারকে ক্ষমতাসীন রেখেছে তাঁদের অর্থবলে।
সরকার দেশের মানুষকে জানিয়েছে যে, রাজস্ব আয়ের জন্য তাদের এই নীতি গ্রহণ করতে হচ্ছে। পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ানোর সময়েও তাদের একই কথা ছিলঃ রাজস্ব নীতি। সরকার আয়ের পথ সুগম চায়। সব সরকারই চায়। সব সরকারের আয়ও প্রয়োজন। কিন্তু যদি সব আয়ের পথ হয় সাধারণ মানুষের সর্বনাশ আর ধনী-কুবেরদের পৌষমাস তাহলে সরকারের আর্থিক রাজনীতি স্পষ্ট হয়ে যায়। এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় সরকার কার স্বার্থে নীতি নিচ্ছে এবং কাদের বঞ্চিত করছে। বিশ্বের কোনো দেশের কোনো সরকার এই ধরণের কর-কাঠামো পরিবর্তনের সাহস পায় না যা সাধারণ মানুষের খাবার পাতের খাবার ছিনিয়ে নেবে।
প্যাকেট করা চাল, গম, আটা, চিনি সব কিছুর উপর বসে গেল ৫ শতাংশ কর! আবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলছেন যে প্যাকেট ছাড়া খোলা থাকলে এই কর দিতে হবে না! এই তফাত কীসের স্বার্থে? এক, এর ফলে আমজনতা কম খাবার কিনতে বাধ্য হবেন। অনাহারে থাকতে বাধ্য হবেন। তার কারণ বোঝা সহজ। ছোটো দোকানে প্যাকেট করা আটা, মুড়ি, দই, লস্যি, দানাশস্য, ডাল এরকম সবকিছুই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অর্থাৎ কোম্পানি থেকে উৎপন্ন খাদ্যপণ্যের মতো সমান হারে কর চালু হয়ে গেল। ছোটো ব্যবসায়ীদের সাথে কোম্পানিজাত প্যাকেটের খাদ্যপণ্যের তফাত তো হলোই না, উলটে আমজনতা এই ছোটো ছোটো দোকান থেকেই এই খাবার সংগ্রহ করে থাকেন কারণ দেশে রেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ২০২২ সালে খোলা খাবার থেকে ধীরে ধীরে দেশের মানুষ তো স্বাস্থ্যবিধিমতো পরিশুদ্ধ প্যাকেট জাত খাবারের অভ্যাসে চলে এসেছে, এই সামান্য সত্যটাও সরকার অস্বীকার করছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিও এই প্যাকেটজাত খাদ্য প্রস্তুত করে বিক্রি করে, যার ফলে দেশের মানুষ অনেক জায়গায় এই খাদ্যপণ্যগুলি তাঁদের থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। সেই গোষ্ঠীগুলিও এক্ষেত্রে লোকসানের পথে চলে গেল কারণ তাদের থেকে মানুষের কেনা এই বেশি দামের জন্য কমে যাবে। ইতিমধ্যেই কেরালা সরকার বিকল্প পথে হেঁটে ঘোষণা করেছে যে এই সব পণ্যের উপর কেরালায় পণ্য পরিষেবা কর নেওয়া হবে না। পাইকারি এবং খুচরো খাদ্যপণ্যের বাজার আক্রান্ত হল। আক্রান্ত হল দেশের খাদ্য সুরক্ষা।
চামড়া, জুতো ইত্যাদির উপর করের হার ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ করা হলো। চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য আমাদের দেশের শিল্পের একটি বড়ো অংশ। চামড়াকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে অনেক ছোটো ও মাঝারি উদ্যোগী সারা দেশে পণ্য উৎপাদন করে। তাঁদের উৎপাদনের খরচ বাড়ল। এর ফলে চামড়া শিল্পের উপর বড়ো আঘাত এল। প্রসঙ্গত, যে এই শিল্পে প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষ নিযুক্ত। এই মুহূর্তে ভারত চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে দ্বিতীয় দেশ। অর্থাৎ আঘাতপ্রাপ্ত হবে আমাদের দেশের রপ্তানিও এই করের পরিবর্তিত হারে। দেশে শিল্পোন্নয়নে শ্লথগতি। এই পরিপ্রেক্ষিতে এই কর-কাঠামো আঘাত আনলো একটি চালু শিল্পের উপর। এলইডি আলো, লেখার কালি, পেন্সিল কাটার কল, ছুড়ি, চামচ, ধাতব পদার্থের ইলেকট্রিক সার্কিট এই সব কিছুর উপর করের হার ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ হল। এর ফলে যেমন ছোটো ছোটো শিশুদের লেখাপড়ার সামগ্রীর খরচ বাড়ল, তেমনই বিদ্যুদায়নের উপরে কোপ এসে পড়ল।
পরিবেশের দিকে সরকার যে তোয়াক্কা করে না তা এই কর কাঠামো থেকেই পরিষ্কার। যা কিছু পরিবেশ বান্ধব, তার দামই বাড়ানো হয়েছে। এলইডি আলো, সৌর চুল্লি, বায়ো মেডিক্যাল বর্জ্য নিরোধক প্রযুক্তি, এসব কিছুরই ১২ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ করের আওতায় নিয়ে আসা হল। যার উপর এই কর বসানো ছিল না, তার উপরেও বসে গেল এই কর। এই সরকারই গ্লাসগোতে পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক বৈঠকে যোগদান করেছে। মত প্রকাশ করেছে পরিবেশ বান্ধব নীতি গ্রহণের। ৫০০০ টাকার বেশি আই সি ইউ ছাড়া হাসপাতালের ঘরের উপর চেপে গেল ৫ শতাংশ কর, যা কিনা অতীতে করের আওতার বাইরে ছিল। এভাবেই জিএসটি’র আওতার বাইরে পণ্যগুলিকে একে একে ছাড়ের থেকে বাইরে নিয়ে এল সরকার এবং করের বোঝা চাপিয়ে দিল। কর বসল ১৮ শতাংশ হারে ব্যঙ্কের চেক বইয়ের উপর, চেকের পাতার উপর। অর্থাৎ জীবনযাত্রার মান আক্রান্ত হল এই কর ব্যবস্থার মাধ্যমে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, টাকা লেনদেন, সব কিছুর দাম বাড়ানো হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যা যা ব্যবহার করে, কোনো কিছুকেই ছাড় দেয়নি এই নতুন করের হারের পুনর্বিন্যাস। যে পরিষেবাগুলি এই করের আওতায় চলে এল,তা হলো রাস্তা, ব্রিজ, রেল, মেট্রো পরিবহণ এবং শ্মশানের চুল্লি। কর বসল ১৮ শতাংশ হারে। এও তো বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় পরিষেবা। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম ধরা ছোঁয়ার বাইরে, কীভাবে বাঁচবেন দেশের মানুষ? এ ঘটনা কি ঘটছে অন্য দেশে?
যে সব দেশে এই পণ্য পরিষেবা কর বা জিএস টি আছে, তার মধ্যে আমাদের দেশে করের হার সর্বোচ্চ। আমাদের দেশ নাকি কানাডার মডেল মেনে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারের ভাগ হিসেবে এই কর বসায়। উল্লেখ্য, মুদির দোকানের জিনিসের উপর, খাদ্যপণ্যের উপর কানাডা কোনোরকম কর চাপায় না। যদি কোনো প্যাকেট খাবারের উপর কর বসে তার সর্বোচ্চ হার ৫ শতাংশ। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। আমাদের দেশ এই করের বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে সারা পৃথিবীর সব দেশের চেয়ে এক ভিন্ন নীতি নিয়ে চলছে, তা স্পষ্ট। ৭ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি এবং এর উপর ১৮ শতাংশ পণ্য পরিষেবা কর - এই নীতি কার স্বার্থে এবং কেন?
উত্তর দেওয়ার দায় নেই সরকারের। এমনই দায় ছিল না নোটবন্দির সময়ে। কেন এই নীতি? কার লাভ হবে এই নীতিতে? দেশের উন্নয়নের কোনো কাজে লাগবে এই নীতি? আমজনতার উপর এই আঘাত মেটানোর জন্য সরকার কি কোন মেরামতি আর্থিক ব্যবস্থা করবে? বিজেপি-আরএসএস সরকার এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর কেন, কোনো উত্তর দেওয়ার দায় বোধ করে নি কোনদিন। তাই দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেই এই দায় তুলে নিতে হবে বাধ্য হয়ে। নিজেদের বাঁচার অধিকারের স্বার্থে এই সর্বনাশা কর্মনীতির বিরুদ্ধে দেশের মানুষের আন্দোলন ছাড়া দেশের উন্নয়নের স্বার্থের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।