৫৯ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২২ জুলাই, ২০২২ / ৫ শ্রাবণ, ১৪২৯
পিএসি’র চেয়ারম্যান নির্বাচন ও রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষ
কৌশিক মুখোপাধ্যায়
ভারতীয় গণতন্ত্রের মৌলিক তিনটি আধারের অন্যতম আইনসভা। আর এই আইনসভার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে স্পিকার বা অধ্যক্ষের পদটির গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশের সংসদীয় আইন অনুসারে নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে থেকে লোকসভা বা রাজ্য বিধানসভায় স্পিকার মনোনীত হন মূলত শাসকদলের সদস্যদের মধ্যে থেকেই। তথাপি স্পিকারের পদটি সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে এবং নীতিগতভাবে স্পিকারই কার্যত আইনসভার অভিভাবক। ফলত সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক ভাবাবেগ বা দৃষ্টিকোণ স্পিকারের কার্যপদ্ধতিকে প্রভাবিত করবে না এটাই সাধারণভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রে আদর্শগতভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাই আইনসভায় স্পিকার পদের নিরপেক্ষতাকে মর্যাদা দিয়েই স্পিকারের ভোটদানের অধিকারকেও সংকুচিত করে নিতান্ত প্রয়োজনে কেবলমাত্র কাস্টিং ভোটের জন্যই (অর্থাৎ যখন কোনো বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দু’পক্ষের ভোটই সমান হয়ে যায়) নির্ধারণ করা আছে। তথাপি একথা অনস্বীকার্য যে, লোকসভা, রাজ্যসভা বা নানা রাজ্যের বিধানসভায় স্পিকারের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নানা সময়ে নানা বিতর্কের অবকাশ তৈরি হয়েছে। সেই বিতর্কের কেন্দ্রভূমিতে শাসকদলের পক্ষে দাঁড়িয়ে দলীয় রাজনীতির গণ্ডির বাইরে বেরোতে না পারাই মূলত চিহ্নিত হয়েছে।
আবার এই বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে স্পিকার পদটিকে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির আঙিনার বাইরে রেখে নিকট অতীতে দু’জন বাঙালি সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র অবস্থানে নিজেদের আসীন করেছেন। লোকসভার স্পিকার রূপে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং রাজ্য বিধানসভার স্পিকার রূপে হাসিম আবদুল হালিম দু’জনেই এই পদের মর্যাদা রক্ষায় এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন। স্পিকার রূপে নীতিবলিষ্ঠতার প্রশ্নে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নজিরবিহীন দৃষ্টান্তের পাশাপাশি দেশের ইতিহাসে সুদীর্ঘ ২৯ বছর (১৯৮২-২০১১) রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষ পদে আসীন হয়ে হাসিম আবদুল হালিমের দল-নিরপেক্ষ আইনসভা পরিচালনাও একইরকমভাবে আমাদের গৌরবান্বিত করে। যতদিন রাজ্য বিধানসভায় স্পিকার পদে আসীন ছিলেন হালিম সাহেব, নির্বাচনী সভা ব্যতীত কখনও কোনো প্রকাশ্য দলীয় রাজনৈতিক সভায় অংশগ্রহণ করেননি। ২০০৭ সালে স্ট্রিং অপারেশনে নন্দীগ্রামের সিপিআই বিধায়ক ইলিয়াস মহম্মদ অর্থকেন্দ্রিক অভিযোগে অভিযুক্ত হলে বিধানসভার মর্যাদা ও নিরপেক্ষ তদন্তের প্রশ্নে অধ্যক্ষ হাসিম আবদুল হালিম কালবিলম্ব না করেই তাঁকে বিধায়ক পদ থেকে সাসপেন্ড করেন (যদিও পরবর্তীকালে এই স্ট্রিং অপারেশন ভুয়ো বলে চিহ্নিত হয়)। অধ্যক্ষ রূপে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় দল, মতের ঊর্ধ্বে উঠে দৃঢ়তার সঙ্গে নানা সময়ে এমন নানা সিদ্ধান্ত হাসিম আবদুল হালিম গ্রহণ করেছেন। স্পিকার পদে তাঁর অনন্য কৃতিত্বকে মান্যতা দিয়েই কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন হালিম সাহেব। সভাপতি হয়েছিলেন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশনেরও।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ইতিহাসে স্পিকার রূপে হাসিম আবদুল হালিমের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার পাশাপাশি বর্তমান সময়কালে অর্থাৎ ২০১১ পরবর্তী সময়ে অধ্যক্ষ রূপে বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা যেন আরও বেশি করে হতাশার উদ্রেক ঘটায়। বিধানসভা পরিচালনায় তাঁর ভূমিকা স্পিকার পদের নিরপেক্ষতা ও মর্যাদাকে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক সভায় শাসকদলের পক্ষে ধারাবাহিক অংশগ্রহণ শুধুমাত্র নয়, অধ্যক্ষ রূপে বিধানসভার গরিমাকে ভূলুণ্ঠিত করে বারুইপুর পশ্চিম বিধানসভা ক্ষেত্রের অন্তর্গত একটি পঞ্চায়েতের বিরোধী দলের সদস্যদের সিপিআই(এম) শাসকদলের পতাকা হাতে যোগদান পর্ব পরিচালনাতেও তাঁর সাবলীল উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। বিধানসভার অধ্যক্ষ হয়ে আপন দলের এমন রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাতেও যখন তিনি নিঃসঙ্কোচে নেতৃত্ব দিতে পারেন তখন বিধানসভা পরিচালনায় ন্যূনতম ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতার পথ যে তাঁর অভিধানে ব্রাত্যই থাকবে তা বোধহয় অনেকাংশে স্বাভাবিক। ফলত বিধানসভায় নিত্য সভা পরিচালনার ক্ষেত্রে বা নিয়মিত দল পরিবর্তন করা বিধায়ককুলকে শায়েস্তা করতে দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রয়োগের প্রশ্নে যে বিমানবাবু কোনো ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবেন না, তাও ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বিধাসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অধ্যক্ষ রূপে বিগত ২০১৬ সাল থেকেই যে ভূমিকা তিনি গ্রহণ করছেন তা শুধুমাত্র লজ্জাজনকই নয়, কার্যত তা চূড়ান্ত অন্যায়। সংসদীয় ব্যবস্থায় পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান রূপে বিরোধী দলনেতা বা বিরোধীদলেরই কাউকে মনোনয়ন করা স্বাভাবিক রীতি। আইনগত এমন কোনো নিশ্চয়তা না থাকলেও নীতিগত অবস্থানের নিরিখে এই রীতিকেই সংসদে বা দেশের নানা রাজ্যের বিধানসভাতেও মান্যতা প্রদান করা হয়। আর সেই রীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই আইনসভার স্পিকাররাও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
বিরোধী দলের কাউকে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির প্রধান পদে মনোনয়নের পশ্চাতে প্রকৃত পক্ষে সরকারি অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে যাতে একটা বাফারিং ব্যবস্থা থাকে, সচেতনভাবে তাকে মান্যতা দিয়েই এই ধারা গড়ে উঠেছে। অন্তত প্রকাশ্যে ন্যূনতম স্বচ্ছতা নিয়ে আগ্রহী কোনো সরকারও এই ধারার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে অভ্যস্ত থাকে না। আইনসভার স্পিকারও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ন্যায়ের নিরিখে এই রীতিকে প্রাধান্য দিয়েই বিরোধীপক্ষের প্রধান বা অন্য কাউকে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির প্রধান পদে মনোনীত করেন। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন প্রশ্নে বিতর্কের অবকাশ সেভাবে কখনোই তাই উত্থাপিত হয়নি। কিন্তু ন্যায়, নীতি, নৈতিকতার চূড়ান্ত অবনমনের প্রশ্নে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল ও তার সরকার যে পথে পরিচালিত হচ্ছে, দুর্ভাগ্যক্রমে রাজ্য বিধানসভার স্পিকারের দ্বারা পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সেই ধারাই যেন উৎকটভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। ২০১৬ সালে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের দ্বারা তৎকালীন বাম পরিষদীয় দলের প্রধান সুজন চক্রবর্তীকে পিএসি’র চেয়ারম্যানের প্রস্তাবকে ন্যূনতম গুরুত্ব না দিয়ে শাসকদলের নাম লেখাতে উদ্যত মানস ভুঁইয়াকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করেছিলেন বিমানবাবু। আবার শাসক তৃণমূলের টিকিটে মানস ভুঁইয়া যখন রাজ্যসভার সাংসদ হবার জন্য বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করলেন তারপরেও পিএসি’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় খাতায়-কলমে কংগ্রেস কিন্তু প্রকাশ্যে তৃণমূলে যোগদানকারী শংকর সিংহকে। ঠিক একই ধারাতেই ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র প্রতীকে নির্বাচিত মুকুল রায় মাস তিনেকের মধ্যেই সাংবাদিক সম্মেলন করে তৃণমূলে যোগদান করলেও বিধানসভার মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়ের কাছে কিন্তু কোনো খবর পৌঁছানো সম্ভবপর হয়নি। মুকুল রায়কেই পিএসি’র চেয়ারম্যান নির্বাচিত করলেন স্পিকার সাহেব। নির্বাচিত হবার পর থেকে বিধানসভার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই কমিটির প্রতিটি সভায় অনুপস্থিত রইলেন স্বয়ং চেয়ারম্যান মুকুল রায়। অসুস্থতার কারণ জানিয়ে অবশেষে তাঁকে পদত্যাগ করানো হলো, কিন্তু চেয়ারম্যান নির্বাচনের ক্ষেত্রে এবারেও ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ন্যায়, মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আর এক দলবদলু বিজেপি বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণীকে পিএসি’র চেয়ারম্যান মনোনীত করলেন অধ্যক্ষ বিমান ব্যানার্জি।
আইনসভার অধ্যক্ষ রূপে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বা হাসিম আবদুল হালিমের ন্যায় ভূমিকা গ্রহণ বা তাঁদের মতো দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব বা মতাদর্শগত অবস্থান যে সকলের কাছেই কাম্য হবে তা মনে করা বাতুলতা হতেই পারে। কিন্তু পেশাগত জীবনে একজন আইনজীবী হয়েও বিমানবাবু যেভাবে বিগত ১১ বছরে বিধানসভার অধ্যক্ষ পদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যাবোধকে ন্যূনতম গুরুত্ব না দিয়ে সরাসরি শাসকের পক্ষে নির্লজ্জ প্রকাশ্য আত্মসমর্পণের ধারাকে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টায় রত থাকলেন, বিধানসভার মর্যাদার প্রশ্নে তা কিন্তু এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রূপেই চিহ্নিত হতে বাধ্য। এ রাজ্যে অনৈতিক দলত্যাগকে প্রাতিষ্ঠানিকতায় পরিণত করতে শাসকদলের পাশাপাশি বিধানসভার অধ্যক্ষ রূপে বিমানবাবু যেভাবে তাকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন সময়ে ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছেন, তাও নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী। অসততা, অনৈতিকতা আর নিয়মতান্ত্রিকতার চূড়ান্ত স্খলন যে রাজ্যের শাসকদল ও প্রশাসনের অলঙ্কার তার প্রভাব থেকে এ রাজ্যের আইনসভাও যে মুক্ত থাকতে পারছে না, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক সুস্থতার সাপেক্ষে প্রকৃত অর্থেই তা এক অতি ভয়ংকর প্রবণতা।