E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২২ জুলাই, ২০২২ / ৫ শ্রাবণ, ১৪২৯

‘রক্তের এপার ওপার’-এর কবি অমল চক্রবর্তী

সৌমিত্র লাহিড়ী


বেশ কিছুদিন ধরেই মৃত্যুর দূত তাঁর চারপাশে পোষা বিড়ালের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল। গত প্রা‌য় এক বছর যাবত চার দেওয়ালের সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁর জীবন ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেছিল। করোনাকালে অনেক প্রবীণই গৃহবন্দি হয়েছেন, কেউ কেউ শয্যাবন্দিও। কবি অমল চক্রবর্তীর স্মৃতিশক্তিও একটু একটু করে শিথিল হয়ে পড়ছিল। ৫ জুলাই, ২০২২, সকাল‍‌ পৌনে সাতটায় এক বেসরকারি নার্সিং হোমে চিরকালের জন্য তাঁর হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেল। এই নার্সিং হোমেই কাছাকাছি আরও একটি বেডে ভেন্টিলেশনে শুয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষছিলেন তাঁর প্রায় ৫০ বছরের জীবনসঙ্গিনী ও প্রিয়তমা নারী নী‍‌লিমা চক্রবর্তী। তিনি জানতেও পারলেন না যে, তাঁর প্রিয় মানুষটি আর নেই। বিপজ্জনক পারকিনসন রোগ, ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতি এবং হৃদযন্ত্রের দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ার সঙ্গে বয়সের কিছুটা ভার মিলেমিশে মৃত্যু তরান্বিত করল অমলদার। ১৯৪৫ সালের ৬ অক্টোবর তাঁর জন্ম (১৯ আশ্বিন, ১৩৫২)। জন্ম তাঁর বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে।

দেশ ভাগের পর শিশু অমল পরিবারের এক খুদে সদস্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে আসেন। প্রথমে কালিয়াগঞ্জ, পরে রায়গঞ্জ থেকে স্কুল ও কলেজের পাঠ শেষ করেছিলেন। বাংলা সাম্মানিক সহ স্নাতক হওয়ার পর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন এমএ পড়তে। প‍‌রে ইংরেজিতেও এমএ করেন।

গত শতকের ষাট-সত্তরের দশক এখন ইতিহাস। সেই সময় বাংলার রাজ‍‌নৈতিক প্রাঙ্গণ ছিল আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তপ্ত। দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ ওপার থেকে এপারে এসে নতুন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ ভারতীয় অর্থনী‍‌তি ও রাজনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। দারিদ্র্য, কর্মহীনতা, খাদ্য সংকট, মাথা গুঁজে বসবাসের সমস্যা, চরম নৈতিকতার পতন ডেকে আনছিল। এই সময়েই মতাদর্শের প্রশ্নে ভেঙে দু’ টুকরো হয়ে গেল ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন। সংশোধনবাদ ও সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ নিতে নিতে নতুন কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হলো। মতাদর্শের সংগ্রাম অবশ্য চলছিল পৃথিবীর অনেক দেশেই। বিশেষত, ছাত্র আন্দোলন উত্তাল হয়ে আছড়ে পড়ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে। তার আঁচ ভারতের ছাত্র জীবনকেও উদ্বেল করে তুলছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক জীবনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল। শাসক কংগ্রেস দলের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে চুর চুর হয়ে যেতে শুরু করে সেই সময়।

এই অগ্নিগর্ভ সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মফস্‌সল বাংলা থেকে পড়তে এসেছিলেন কবি অমল চক্রবর্তী। যৌবনের শুরুতেই খাতার পাতা কবিতায় কবিতায় ভরা বর্ষার নদীর ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল। দীর্ঘদেহী নরম স্বভাবের কবিমানুষ অমল চক্রবর্তীর কলম ঝলমল করে ওঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে কবি হিসাবে। পোস্টারের বুকে নতুন নতুন শব্দ, ভাষা ও ছন্দ ব্যবহার করতে করতেই মিছিলের এক অবিচ্ছেদ্য মুখ হয়ে ওঠেন কবি অমল চক্রবর্তী। বামপন্থীদের নেতৃত্বে খাদ্যের দাবিতে বাংলা জুড়ে হরতাল-ধর্মঘট, কৃষক ও শ্রমজীবীদের আন্দোলন, মধ্যবিত্ত কর্মচারী, শিক্ষক-অধ্যাপকদের অবিরাম লড়াই বাংলার রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। বস্তুত বাংলা হয়ে উঠেছিল আন্দোলন সংগ্রামের নতুন বারুদভূমি। কবি-জীবনের সূচনালগ্নে গণআন্দোলনের এই তীব্রতপ্ত পরিমণ্ডল কবি অমল চক্রবর্তীকে কত গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তার অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে আছে তাঁর সেই সময়ের কবিতা ও ছড়াগু‍‌লিতে। রোমান্টিক জীবনানন্দপ্রেমী আকণ্ঠ ভালোবাসার কবি অমল চক্রবর্তী বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে লিখতে লাগলেন একের পর এক কবিতা।

১৯৭১ সাল। ওপার বাংলায় মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামি লিগের আন্দোলন নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সংহত হয়ে উঠেছিল। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে অস্ত্রহাতে লড়াই করার প্রস্তুতি গড়ে উঠেছিল ওপার বাংলায়। আর বাঙালির সেই উত্তাল জাগরণের দিনগুলিতেও এপার বাংলায় আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস ও হিংস্র বর্বর অভিযান গণ আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করতে উদ্যত হয়েছিল। একাত্তরের মে মাসে কবি অমল চক্রবর্তীর প্রথম এক চিলতে কবিতা সংকলন ‘রক্তের এপার ওপার’ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশ করেছিলেন অরুণ মজুমদার, ১৬/১ রানি রোড, কলকাতা-২ থেকে। মাত্র ১৬ পৃষ্ঠার পাতলা ফিনফিনে একটি সংকলন, কয়েকটি মাত্র কবিতা। নবীন পাঠকদের চমকে দিয়েছিল সেই সংকলন। দুই রঙের মলাট। রক্ত গড়িয়ে পরার দুটি রেখা যেন। রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। আর আশ্চর্য অনেকটা ঝুলন্ত মই-এর মতো ষোলো লাইনের একটি ছন্দোময় কবিতা যা ছাত্র-যুব-গণনাট্য কর্মীরা নিজেদের মতো করে সুর দিয়ে গান তৈরি করে নিয়েছিল, পথে প্রান্তরে গাইবার জন্য। একটু উদ্ধৃত করি -
জংগীশাহীর মৃত্যু কামড়
ব্যর্থ করেছে যে কোনো দেশ
রক্ত ঝরেছে রক্ত কেড়েছে
আগুন জ্বেলেছে বাংলাদেশ।

প্রতিরোধ শুরু পথে পথে আজ
ফুঁসছে তিতাস পদ্মার ঢেউ
সাড়ে সাত কোটি তুলেছে আওয়াজ
জান দেবো তবু হারবো না কেউ।

মুক্ত দিনের গান ভেসে আসে
লাখো শহীদের রক্তদানে
ফুটবে কুসুম হাসবে মানুষ
জ্বলবে সূর্য আসমানে।

জালিম শাহীর অস্ত্রের মুখে
লড়ছে বাংলা তুলকালাম
ভিয়েতনামের স্বপ্ন চোখে
বাংলাদেশ লাল সেলাম।


দু’মাসের মধ্যে পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়েছিল। এবার হলো ২৪ পৃষ্ঠা এবং প্রচ্ছদের কবিতা চলে গেল শেষ পৃষ্ঠায়। মনে রাখা প্রয়োজন ‘রক্তের এপার ওপার’ কবিতাটি ১৯৭০ সালের শারদীয়া নন্দনে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংখ্যাতেই ছিল তপোবিজয় ঘোষের ‘সামনে লড়াই’ উপন্যাস। ‘রক্তের এপার ওপার’ সংকলনের ভূমিকাটি ছিল স্পষ্ট কিন্তু একটু দীর্ঘ। কবি স্পষ্ট লিখেছিলেনঃ ‘‘একটা পরিবর্তন হচ্ছে। জামানা পালটে যাচ্ছে। রক্তের মূল্যে মানুষ তাকে অনুভব করছে পৃথিবীর সবখানে- সবদেশে। ওপার বাংলার সর্বস্তরের মানুষ শোষণের বিরুদ্ধে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধিকার অর্জনের জন্য আজ সংগ্রাম করছে, ইতিহাস তৈরি করছে বুকের রক্ত ঢেলে। এ লড়াই ক’দিনেই শেষ হবার নয়। দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য এ লড়াই। ভিয়েতনাম তার দৃষ্টান্ত। এপার বাংলার মানুষকেও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য মোকাবিলা করতে হচ্ছে আধা ফ্যাসিস্ত হামলাকে,...’’ তাই ‘রক্তের এপার ওপার’ কবিতায় কবি লেখেন -
‘‘তোমার আশায় ঘুম কেড়ে নেওয়া চোখে চেয়ে থাকি
তোমার রক্তের ডাকে এখানেও আমার লড়াই,
এক নীল আকাশের তলে
আমাদের শ্রেণির শিবিরে
ওপারে তোমার হাত উত্তোলিত মুক্তি আকাঙ্ক্ষায়
এপারে আমার বুকে রক্তের তুফান তোলে ডাক।
ওপারে রহিম আলি খুন হয়
এপারে বুলেটে মৃত হারান মণ্ডল;
এক রক্ত দুই পারে কালো হয়ে জমেছে লজ্জায়’’...


আশাবাদী কবি অমল চক্রবর্তী। সংগ্রামের উজ্জ্বল ভবিষ্যতে আস্থা রেখে তাই বলেন -
‘‘নতুন বাসর কবে পাতা হবে
ফুল নিয়ে বসে আছি নদীর দুপারে
মাঝে মাঝে শোনা যায়
পরিচিত মাঝির গলায়ঃ
জোয়ারে ও ভাই বল কারা যাবি লাল দরিয়ায়।’’


ওপার থেকে পরিবার-পরিজন, বিষয়-সম্পত্তি, মান-ইজ্জৎ সব খুইয়ে কাতারে কাতারে শরণার্থী আতঙ্ক আর ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসছিলেন। সেই জনস্রোত দেখে কবি বললেন -
‘‘সোনা মন, কাঁদিস নে বোন।
বাংলাকে কান্না মানায়?
স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে
অশ্রু নয়, বুক ভরে কিছু ক্রোধ ঘৃণা নিয়ে আয়।’’


পঞ্চাশ-বাহান্ন বছর আগে এক ঝটকায় বেশ কয়েকটি মূল্যবান কবিতা আমাদের উপহার দিয়েছিলেন কবি। সেই সময়ের তীব্র আবেগ ও পরিবেশ পরিস্থিতি বদলে গেছে অনেক, কিন্তু বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ও পশ্চিমবঙ্গের আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের পটভূমিতে রচিত কবিতাগুলি আমরা এক সঙ্গে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে ফেলতে পারি। মনে পড়ছে, ১৯৭০ সালের ক‍‌‍‌লেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘রক্তের এপার ওপার’ কবিতাটি আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে আরও কবিতা বিকল্প ছিল। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী এই কবিতাটাই বেছে নিয়ে আবৃত্তি করেছিলেন। বারবার শুনেও শ্রোতাদের মন ভরছিল না। প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পরেও অনেক ছাত্রছাত্রীকে আবার কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনাতে হয়েছিল। কবি অমল চক্রবর্তী ষাট-সত্তর দশকে আবেগ ও অনুভূতিকে নির্ভর করে অনেক বেশি স্বচ্ছ, স্পষ্ট এবং দৃপ্ত কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় কাব্য সংকলন ‘আকালের কবিতা’ ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। রাজনীতির প্রকট উপস্থিতিতে কবিতাগুলি ঝাঁঝালো, তীক্ষ্ণ এবং স্পষ্টভাষী হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সংকলনেও অনেক কবিতাই ছিল যা প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধানেও ঔজ্জ্বল্য হারায়নি। যেমন ‘ঠিকানা’ কবিতাটিতে কবি বলছেন -
‘‘শেষ হোক ভিক্ষাবৃত্তি হতাশার ক্লান্তি অবসাদ
খাদ্য চাই খাদ্য দাও - নাভির কুণ্ডলী থেকে ক্রুদ্ধ রুদ্রনাদ
ভেঙে দিক দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভীরুতার খিল
আমার রাত্রির ঘুম কেড়ে নিক নিরন্নের স্পর্ধিত মিছিল।’’


এই সংকলনে কবি সরাসরি কথা বলছেন, শাসকশ্রেণিকে সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, গর্বের সঙ্গে লাল পতাকা উড্ডীন রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন এমন অনেকগুলি কবিতা আছে। বিশেষ করে ‘ভুখ মিছিল’-এর ঐতিহাসিক দিনগুলির চমৎকার ছবি মনে করিয়ে দেয় তাঁর এইসব কবিতা। ষাট-সত্তরের বহু কবিতা দীর্ঘদিন অগ্রন্থিত ছিল। সম্প্রতি কবির পাওয়া যাচ্ছে এমন সব কবিতা খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছিল। লক্ষ করার বিষয় কবির সৃষ্টির পরিমাণ বিপুল। ‘আকালের কবিতা’র পর ‘স্বদেশের প্রতিমা ভাসানে’ (১৯৭৯), ‘নী‍‌লিমার কাছে’ (১৯৭৯), ‘মাও সে তুঙের কবিতা’ (১৯৮০), ‘চৌ এন লাইয়ের কবিতা’ (১৯৮০), ‘এলিয়টের ফোর কোয়াট্রেটস’ (১৯৮৪), ‘কচ্ছপী ও কণ্ডোলী’ (১৯৮৪) কবিতা গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হওয়ার পর দীর্ঘ ২৩ বছর নতুন কোনো কবিতা সংকলন তাঁর প্রকাশিত হয়নি। এই সময় দ্রুত তিনি তাঁর কাব্যভাষার বদল ঘটান। পত্রপত্রিকায় অজস্র ধারায় কবিতাও প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি মূলত বামপন্থী পত্রপত্রিকা এবং লিটল ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক ছি‍‌লেন। ‘দেশ’ ও ‘অমৃত’-র মতো বাণিজ্যিক পত্রিকায় কিছু কবিতা লিখলেও, তাঁর মূল ভিত ছিল ছোটো অবাণিজ্যিক পত্রিকা। এক সময় নন্দন, লেখা ও রেখা, গণনাট্য, জোয়ার, চতুষ্কোন, সত্যযুগ, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, মাসিক বাংলাদেশ, পর্যবেক্ষক, উত্তরযুগ, শরিক সেই সব পরিচিত পরিসর থেকে সরে গিয়েছিলেন তিনি রাজনৈতিক বিরোধে। কিন্তু বিরোধী শিবিরে যাননি কখনও। সরকারি চাকরি ছেড়ে আশুতোষ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন মনোযোগ দিয়ে এবং সাহিত্যচর্চা করে গেছেন অবিরত। এক সময় অজস্র বিদেশি কবিতা ইংরেজির মাধ্যমে নানা ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন।

‘নন্দীগ্রাম’ জমি অধিগ্রহণ কেন্দ্র করে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল এবং মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে শিল্পবিরোধী মহাবিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা শুরু হয়েছিল, কবি অমল চক্রবর্তী তাঁর সুহৃদ ও ঘনিষ্ঠ কবি রথীন্দ্রনাথ ভৌমিকের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই তিন তিনটি কবিতা সংকলন করেন। দুটি কবির যুগলবন্দির ‘নন্দীগ্রাম’ মূল শিরোনামে প্রকাশ করেন (২০০৭-০৮)। ‘রক্তের এপার ওপার’ কবিতা সংকলনের তীব্র ঝাঁঝ বা সরল বিশ্বাসের প্রতিলিপি এই সংকলনগুলিতে ছিল না, চল্লিশ বছরের ব্যবধানে তা বাস্তবসম্মতও হতো না, তবু যুবমানস, গল্পগুচ্ছ ইত্যাদি পত্রপত্রিকার লেখক অমল চক্রবর্তী কবিতা ও ছড়ার পাশাপাশি গল্প, প্রবন্ধ সমালোচনামূলক প্রবন্ধ, নাটকও লিখতেন। ভাষা বদল করে ক্রমশই তিনি সরল স্বচ্ছতা ছেড়ে জটিল ভাবনার প্রকাশে আড়াল খুঁজতে থাকেন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর সিপিআই(এম)-এর সঙ্গেও সম্পর্কহীন হয়েছিলেন। কিন্তু লক্ষণীয়, কোনো দিন শিবির বদল করেননি। বাহাত্তরের জাল নির্বাচনের পর বীভৎস সন্ত্রাসের হিংস্রতার মুখে দাঁড়িয়েও গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সম্মিলনী গড়ে উঠেছিল, যার মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধিকার রক্ষা ও গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার। লেখকশিল্পী, কবি ও বুদ্ধিজীবী সমাজের সংবেদনশীল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন স্রষ্টাদের সমবেত করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সৃষ্টির জোয়ার তৈরি করার সংগ্রামেও কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক অমল চক্রবর্তী ছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রমী সংগঠক। এক সময় নন্দন পত্রিকার সংগঠক ও নিয়মিত লেখক নতুন কাব্য শৈলীতেও তীব্র ক্রোধ ঘৃণা ও ক্ষোভের অভাব ছিল না।

‘নন্দীগ্রাম’ সিরিজ শুরু হওয়ার পরই কবি অমল চক্রবর্তী নিজের রচনাগুলিকে খণ্ডে খণ্ডে গেঁথে রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, তাঁর বিপুল রচনাবলীর অধিকাংশই ফিরে পাওয়া আর সম্ভব হবে না। ছড়ানো ছিটানো বহু লেখাই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বিশেষত, সন্ত্রাসের দিনগুলিতে, জরুরি অবস্থার সময় এবং পারিবারিক প্রয়োজনে বেশ কয়েকবার বাসা বদল করতে হয়েছিল তাঁকে। দমদম, মধ্যমগ্রাম, নৈহাটি ইত্যাদি করতে করতে অনেক পত্রপত্রিকা চোখের আড়ালে চলে গেছে। তাই তিনি কবিতা সমগ্রর আগে ‘প্রায়’ শব্দটি জুড়ে দিয়েছিলেন। পাঁচ-ছয় শত পৃষ্ঠার সীমানাও ছাড়িয়ে গেছে এক একটি ‘প্রায় সমগ্র কবিতা’র খণ্ড। এ পর্যন্ত দুটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে সুদৃশ্য কাগজে এবং সুন্দর মুদ্রণ ও দৃষ্টিনন্দন বাঁধাই ও অঙ্গসজ্জায়। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে এক খণ্ড ‘প্রায় গল্প সমগ্র’ এবং এক খণ্ড অন্যান্য গদ্য রচনা ও অনূদিত কবিতাগুচ্ছ সংকলন ‘ভাঙা কুলোয় চাঁদের পাথর’। এছাড়াও পুরী পূরবী পুরবৈয়া, আগুনের হরিণেরা, পোড়া মাটির চতুর্দশী, একা একাই ভিজি একা একা, সেদিন বুঝিনি আজও বুঝিনা, পুনরুত্থান, কথা আছে আর কিছু নেই, অসম্ভবের পরি, হারিয়ে খুঁজি সুরের ভাষা, আমার চিতার শেষ কাঠ ইত্যাদি দশ-বারোটি সুদৃশ্য চমৎকার ছাপা বাঁধাইসহ কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে গত পনেরো বছরে।

কবি অমল চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রী নীলিমা চক্রবর্তীর যুগলবন্দিতে একটি চিঠির সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল, যার নাম ‘নক্ষত্র ও নদীর কথা’।

তিনি বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় লেখেননি, কোনো গোষ্ঠীতেও তেমনভাবে যুক্ত থাকেননি। দীর্ঘ দু-আড়াই দশক কোনো গ্রন্থও প্রকাশিত হয়নি, প্রকাশিত গ্রন্থের সমালোচনাও বিশেষ দেখা যায়নি। ফলে বাঙালি কবিতা পাঠকের এক বড়ো অংশের কাছে তিনি অপরিচিতই থেকে গেছেন। কোনো পুরস্কার বা সম্মান তিনি পাননি কেন সেটাও কম বড়ো রহস্য নয় - সম্ভবত বিচ্ছিন্ন সৃষ্টি প্রয়াসই এর মূল কারণ।