৫৯ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২২ অক্টোবর, ২০২১ / ৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
অস্বাভাবিক করই পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির একমাত্র কারণ
পরিণতিতে সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস
টোডর মল
পেট্রোপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবজিনিসের দাম বেড়ে চলেছে। তার ফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। কিছুদিন আগেও দেশের কোনো শহরে পেট্রোলের দাম লিটারে একশো টাকা ছুঁলে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় খবর হতো। এখন আর হয় না। আর হবেই বা কেন? এখন সারাদেশেই এক লিটার পেট্রোলের দাম একশো টাকার বেশি। বিষয়টা অনেকটা গাসওয়া হয়ে গেছে। আসলে গত কয়েক মাস ধরে দু-একবার বাদ দিলে পেট্রোল-ডিজেলের দাম একনাগাড়ে বেড়েই চলেছে। এখন আলোচনার বিষয় হচ্ছে, ডিজেলের দাম আর কত দিনের মধ্যে স্থায়ীভাবে লিটারে একশো টাকা হবে!
আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধিকেই এর জন্য দায়ী করে কেন্দ্রীয় সরকার। যদিও সরকারের এই বক্তব্য ধোপে টেকে না। দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমই ছিল। গত বছরে কোভিড মহামারীর সময়ে অপরিশোধিত তেলের দাম একেবারে রেকর্ড তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল। সম্প্রতি সময়ে সামান্য বেড়ে ব্যারেল পিছু তেলের দাম ৭৫ ডলারের আশেপাশে থাকছে। তবে এটা কখনোই সহনীয় সীমাকে অতিক্রম করা নয়। আসল কারণ হচ্ছে, গত ছ-সাত বছরে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কর এতো বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলস্বরূপ পেট্রোল-ডিজেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। কেন্দ্রের মোদি সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে পেট্রোপণ্যের ওপর বর্ধিত হারে কর, লেভি বসানোকেই একমাত্র পথ হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধনী ব্যবসায়ী, করপোরেটদের করছাড় কিংবা ব্যাংক ঋণ মকুবে কোনো ক্লান্তি নেই দেশের সরকারের। পেট্রোপণ্যের ওপর বর্ধিতহারে কর না বসিয়ে যদি মোদি সরকার ধনী ব্যবসায়ী, করপোরেটদের করছাড় দেওয়া বন্ধ রাখত তা হলে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর এই অসহনীয় বোঝা চাপত না।
চারটে মেট্রো শহর দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা ও চেন্নাই সহ দেশের প্রধান পনেরোটি শহরের পেট্রোল-ডিজেলের দামের দিকে নজর দিলেই ব্যাপারটা যে কী অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছতে চলেছে তা বোঝা যাবে। এই পনেরোটা শহরের অন্যান্যগুলি হলো - বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, আমেদাবাদ, ভুবনেশ্বর, জয়পুর, লক্ষ্মৌ, ত্রিবান্দম, পাটনা, চন্ডীগড়, গুরগাঁও এবং নয়ডা। এই পনেরোটা শহরের মধ্যে মুম্বাই, জয়পুর ও পাটনায় আবার গত ২০ ও ২১ অক্টোবর পেট্রোলের দাম লিটারে ১১০ টাকার ওপরে ছিল। সবচেয়ে বেশি জয়পুরে, যেখানে ২১ অক্টোবর এক লিটারের দাম হয় ১১৩ টাকা ৬৯ পয়সা। হয়তো বা আর কিছুদিনের মধ্যে এই পনেরোটা শহরেই পেট্রোলের দাম লিটারে ১১০ টাকা পেরিয়ে যাবে।
কিন্তু সবচেয়ে যেটা আশঙ্কার বিষয় তা হলো, পেট্রোলের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডিজেলের দামও রকেটের গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওই উল্লেখিত পনেরোটা শহরের মধ্যে আটটা শহরে - মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, ভুবনেশ্বর, হায়দরাবাদ, আমেদাবাদ, জয়পুর, পাটনা, ত্রিবান্দ্রমে ২০-২১ অক্টোবর এক লিটার ডিজেলের দাম একশো টাকার বেশি ছিল। আর ডিজেলের দামের ক্ষেত্রেও প্রথম স্থানে জয়পুর,সেখানে প্রতি লিটার প্রায় ১০৫ টাকা। চেন্নাই ও কলকাতায়ও ডিজেলের দাম একশো টাকা ছুঁইছুঁই। যে কোনো দিন একশো টাকা লিটার হয়ে যেতে পারে। ২১ অক্টোবর চেন্নাই ও কলকাতায় ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ছিল যথাক্রমে ৯৯.৬৮ টাকা এবং ৯৮.৩৮ টাকা।
পণ্য পরিবহণ ও যাত্রী পরিবহণে জ্বালানি হিসেবে মূলত ডিজেলই ব্যবহৃত হয়। প্রতিদিন ডিজেলের এই দাম বৃদ্ধি পণ্য ও যাত্রী উভয় পরিবহণেরই খরচ বৃদ্ধি করছে। এর সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে খাদ্যদ্রব্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে। চাল, ডাল, তেল, গম, চিনি সহ সমস্ত ধরনের সবজির দাম সারা দেশেই সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের একেবারে নাগালের বাইরে চলে গেছে। সরষের তেলের দাম কেজিতে দুশো টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যা একেবারেই নজিরবিহীন। প্রতিদিনের রান্নায় জরুরি সবজির দামও ঊর্ধ্বমুখী। এর বেশিরভাগেরই এক কেজির দাম দ্রুতগতিতে একশো টাকার দিকে এগোচ্ছে। বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে সারাদেশে যাত্রী পরিবহণের ভাড়া নির্ধারণ করা নিয়েও।
২০১৪ সালে পেট্রোলের খুচরো দামের ১৪ শতাংশ ছিল কেন্দ্রীয় কর এবং ১৭ শতাংশের মতো ছিল রাজ্য সরকারের কর। বর্তমানে কেন্দ্রীয় কর বেড়ে হয়েছে ৩২ শতাংশ। বেড়েছে রাজ্য সরকারগুলির করও, এর পরিমাণ হয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। একই জিনিস ঘটেছে ডিজেলের ক্ষেত্রেও। সেখানে কেন্দ্রীয় শুল্ক ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশ এবং রাজ্যের ১২ শতাংশ কর ১৫ শতাংশ হয়েছে। যদি পেট্রোপণ্যের ওপর কর ২০১৪ সালের সমহারে থাকত তাহলে আজ দেশের বাজারে পেট্রোল লিটার প্রতি ৬৬ টাকা এবং ডিজেল লিটার প্রতি ৫৫ টাকায় বেচা যেত।
গত ১৮-২০ মাসে কোভিড মহামারীর কালে দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। কাজ হারিয়েছে কিংবা আয় কমেছে এরকম মানুষের সংখ্যা ১৩ কোটিরও বেশি। আর এই সময়কেই কেন্দ্রীয় সরকার নজিরবিহীনভাবে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য বেছেছে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে পেট্রোলের দাম ঘোরাঘুরি করছিল ৬৯ থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে। আর ডিজেলের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৬ টাকা। তা হলে বোঝাই যাচ্ছে, শুধু এই মহামারীর কঠিন সময়েই পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৪৫শতাংশ ও ৫০ শতাংশেরও বেশি। রান্নার গ্যাসের ওপরও ভরতুকি একেবারে কমিয়ে এনেছে মোদি সরকার। এরফলে রান্নার গ্যাসের দামও গত একবছরে (২০২০ অক্টোবরের তুলনায়) ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০ সালের অক্টোবরে দাম ছিল ৬০৪.৬৩ টাকা। এবছরের অক্টোবরে তা ৯০৬.৩৮ টাকা। দেশের মানুষের সবচেয়ে দুর্দশার সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার এরকম অমানবিক ও বর্বর কাজ করেছে।
পণ্য পরিবহণ খরচ বাড়ার ফলে বিশেষকরে খাদ্যদ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে যে চলে গেছে তার একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের ৯৪ থেকে ১০১ তম স্থানে অবনমনে। তবে এ থেকে কখনই বোঝা যাবে না, ঠিক কত কোটি মানুষ এদেশে প্রতিদিন অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে রয়েছে।
তবে এই কর বৃদ্ধিতে সরকারের কোষাগার ফুলেফেঁপে উঠেছে। ২০১৪-১৫ সালে পেট্রোপণ্যের ওপর রাজস্ব আদায় হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা এবং রাজ্য সরকারগুলির ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং ২ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, জনগণের কাছ থেকে কর আদায় কী বিশাল পরিমাণে বেড়েছে। মহামারীর সময়ে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে পেট্রোপণ্যের ওপর কেন্দ্রীয় কর আদায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৪লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ শুধু মহামারীর একবছরে জনগণের ওপর অতিরিক্ত ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার বোঝা চাপিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকারগুলির কর বাবদ আয় অপরিবর্তিতই আছে।