৫৯ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২২ অক্টোবর, ২০২১ / ৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
লখিমপুর খেরির ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে দেশজুড়ে কৃষকদের রেল অবরোধ
কৃষকদের রেল অবরোধ গাজিয়াবাদে।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ উত্তর প্রদেশের লখিমপুর খেরিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে ৪ কৃষককে হত্যার প্রতিবাদে সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে ১৮ অক্টোবর দেশজুড়ে রেল রোকো কর্মসূচি পালিত হয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতা, পুলিশি জুলুম, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদিকে উপেক্ষা করেই জেদি মনোভাব নিয়ে রেল চলাচল রুখে দেন প্রতিবাদী কৃষকরা। এদিন আন্দোলনের জেরে সারা দেশে ২৯০টির বেশি ট্রেনের চলাচল ব্যাহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিনের এই প্রতিবাদ কর্মসূচির পর কৃষকরা অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে অনড় রয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত তিন অক্টোবর কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে লখিমপুর খেরিতে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থানরত কৃষকদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির পুত্র আশিস মিশ্র টেনি। এই বর্বরোচিত ঘটনায় ৪ কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে আশিস সরাসরি মাথায় গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ। এছাড়া এই ঘটনায় অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয় সারা দেশ। উত্তর প্রদেশ ছাড়াও পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যে প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়।
কৃষকদের রেল অবরোধ বাহাদুর গড়ে।
১৮ অক্টোবর প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন হাজার হাজার কৃষক। এই কর্মসূচি পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় সর্বাধিক সফল হয়েছে। এদিন লখিমপুর খেরির হত্যাকাণ্ডের বিচারই শুধু নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের তিন কালা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতেও সোচ্চার ছিলেন কয়েক হাজার কৃষক। উত্তর প্রদেশে আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে আগের মতো এদিনও কৃষক নেতা, কর্মীদের আটক অথবা গৃহবন্দি করে রাখে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের পুলিশ। মধ্যরাত থেকেই জেলা, গ্রামস্তরের কৃষক নেতাদের আটক করা শুরু হয়। এদিন ব্যাপক পরিমাণে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল রেল স্টেশনগুলিতে। এসব সত্ত্বেও সাহসের সঙ্গেই রেল রুখে দেন কৃষকরা। মধ্যপ্রদেশের গুনা, গোয়ালিয়র, রেওয়া, ঝাবুয়া, বিদিশা সহ বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তার করা হয় কৃষক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে। গ্রেপ্তার করা হয় সারা ভারত কৃষক সভার নেতা বাদল সরোজ, সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতা ইরফান জাফরি সহ অনেককে। শুধু কৃষক নেতৃবৃন্দই নন, এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে গিয়ে পুলিশি হেনস্তার শিকার হন ছাত্র, যুব সহ শ্রমিক আন্দোলনের নেতারাও। রাজস্থানে রেল রোকো কর্মসূচিতে শামিল হয়েছিলেন কৃষকদের পাশাপাশি ছাত্র, যুব, মহিলা, শ্রমিক সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কর্মীরা। তাঁরা ‘কৃষক হত্যাকারী মোদী-শাহ দূর হটো’, ‘আদানি-আম্বানির দালাল বিজেপি-আরএসএস সরকার মুর্দাবাদ’, ‘কৃষক বিরোধী আইন প্রত্যাহার করতে হবে’ ইত্যাদি স্লোগান তুলে একযোগে বিভিন্ন রেল স্টেশন এবং রেলপথ ৬ ঘণ্টা ধরে অবরোধ করে রাখেন।
কৃষকদের রেল অবরোধ রাঁচিতে।
এদিন উত্তর ভারতের মতো অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক প্রভৃতি রাজ্যেও প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়েছে। এছাড়া বিহার, ওডিশা, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যেও রেল রোকো কর্মসূচি মোটামুটি সফল হয়েছে।
এদিনের এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে সফল করার জন্য দেশের কৃষক সহ অন্যান্য সংগঠনকে অভিনন্দন জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। এদিন এক বিবৃতিতে মোর্চার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, লখিমপুর কাণ্ডের ক্ষেত্রে নৈতিক দায়িত্ব নিতেই হবে মোদি সরকারকে। স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়া এবং তদন্ত যাতে প্রভাবিত না হয় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। আর লখিমপুর কাণ্ডের বিচার না পেলে আন্দোলন আরও তীব্র আকার নেবে বলে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। এদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত এবং গ্রেপ্তারের দাবি ফের জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।
সারা ভারত কৃষক সভার পক্ষ থেকে এদিন এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রেল রোকোর এই সাফল্য কড়া বার্তা পৌঁছে দিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে, যিনি তাঁর সহকর্মী অজয় মিশ্র টেনিকে কৃষক হত্যাকারী জেনেও সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। কৃষকদের এই জেদ চলতি আন্দোলনকেই আরও ত্বরান্বিত করবে। যতক্ষণ সংযুক্ত কিষান মোর্চার দাবি দাওয়ার সমাধান হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই-আন্দোলন চলবে বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সারা ভারত কৃষক সভা।
পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদ-অবরোধ
এদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মতো পশ্চিমবঙ্গেও লখিমপুর খেরির হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি সহ তিন কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল বাতিলের দাবিতে রেলপথ অবরোধ করেন কৃষকরা। এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় এদিন কৃষকদের রেল অবরোধ কর্মসূচিতে শামিল ছিলেন শ্রমিকরাও। দিনভর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৃষ্টি উপেক্ষা করেই রেল লাইন দখল নেন কৃষক-শ্রমিকরা।
কলকাতার ঢাকুরিয়া এলাকায় কাঁকুলিয়াতে রেল অবরোধ করে দীর্ঘক্ষণ বিক্ষোভ দেখান সিআইটিইউ’র কর্মীরা। উপস্থিত ছিলেন সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। রেল অবরোধের পাশাপাশি বিক্ষোভ সভাও সংগঠিত হয়েছে সেখানে।
এদিন পূর্ব বর্ধমানের শক্তিগড়ে এই কর্মসূচিতে সকাল থেকে শক্তিগড় ও তার আশেপাশের এলাকার কৃষকরা রেল অবরোধে শামিল হন। সেই অবরোধে বক্তব্য রাখেন কৃষক নেতা সৈয়দ হোসেন, সমর ঘোষ ছাড়াও সিআইটিইউ’র পূর্ব বর্ধমান জেলার সম্পাদক সুকান্ত কোঙার।
হুগলি জেলা কৃষক সভার উদ্যোগে এদিন সিঙ্গুরের নসিবপুর রেল স্টেশনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে রেল রোকো কর্মসূচি হয়। নেতৃত্বে ছিলেন জেলা কৃষক সভার সম্পাদক স্নেহাশিস রায়, সৌমিত্র চ্যাটার্জি, পরান কোলে, মিণ্টু বেরা, পবিত্র সিংহরায়, রামকৃষ্ণ মণ্ডল, তন্ময় জানা প্রমুখ।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহিদ মাতঙ্গিনী স্টেশনে দীর্ঘ সময় ধরে রেল অবরোধ হয়। নেতৃত্ব দেন সংযুক্ত মোর্চার জেলা আহ্বায়ক সত্যরঞ্জন দাস, মহাদেব মাইতি, হিমাংশু দাস, আশিস প্রামাণিক, সুব্রত পান্ডা, কাঞ্চন মুখার্জি, রীতা দত্ত, অমল কুইল্যা, শেখ ইব্রাহিম আলি প্রমুখ।
হাওড়ার বালি স্টেশনে সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বিক্ষোভ ও মিছিল হয়েছে।
উত্তর ২৪ পরগনার হৃদয়পুর স্টেশনে রেল অবরোধের জেরে দীর্ঘক্ষণ আটকে যায় ট্রেন। কয়েকশো কৃষক, শ্রমিক অংশ নেন রেল অবরোধে। সিআইটিইউ’র জেলা সম্পাদিকা গার্গী চ্যাটার্জি নেতৃত্ব দেন।
নদীয়ার কৃষ্ণনগরেও দীর্ঘক্ষণ ধরে অবরোধ চলে। নেতৃত্ব দেন সিআইটিইউ নেতা এসএম সাদি। মুর্শিদাবাদের সালারে, বাঁকুড়ার ওন্দাতেও রেল অবরোধ হয়।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট এবং বনিয়াদপুর রেল স্টেশনে রেল রোকো কর্মসূচি পালিত হয়।
কৃষকদের রেল অবরোধ কোচবিহারে।
এদিন নিউ কোচবিহার রেল স্টেশনে রেল রোকো অভিযানে শামিল ছিলেন কৃষক সভার পাশাপাশি ছাত্র, যুব, মহিলা সংগঠনের কর্মীরাও। এখানে বিশাল পুলিশবাহিনী বাধা দেবার চেষ্টা করলেও তা উপেক্ষা করেই স্টেশনে প্রবেশ করেন আন্দোলনকারীরা। এখানে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন অনন্ত রায়, বিপিন শীল, সফিজ আহমেদ, শ্রমিক নেতা তারিনী রায় প্রমুখ।
মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরে রেল অবরোধের জন্য কিছুক্ষণ রেল চলাচল ব্যাহত হয়।
আলিপুরদুয়ার জংশনে মিছিল করে ছাত্র, যুব, মহিলা সহ কৃষক সভার সদস্যরা রেল অবরোধ কর্মসূচিতে শামিল হন। জেলার কামাখ্যাগুড়ি, দলগাঁও, বীরপাড়া, ফালাকাটাতে রেল অবরোধ হয়।
উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জেও রেল স্টেশনে অবরোধ চলে।
এ রাজ্যে রেল রোকো অভিযানে শামিল হওয়া কৃষকদের অভিনন্দন জানিয়ে সারা ভারত কৃষক সভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার বলেছেন, উৎসবের পরেই যেভাবে প্রতিটি জেলায় রেল অবরোধ সংগঠিত হয়েছে তা প্রমাণ করে হকের দাবিতে রাস্তাতেই থাকবেন কৃষকরা। এদিন কৃষকদের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলনে শামিল হওয়া শ্রমিকদের অভিনন্দন জানান সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু।