৫৯ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২২ অক্টোবর, ২০২১ / ৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
কমরেড বিজন ধরের স্মরণসভায় নেতৃবৃন্দ
সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ত্রিপুরা বামফ্রন্ট কমিটির আহ্বায়ক, পার্টির ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক এবং প্রখ্যাত সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিক কমরেড বিজন ধর গত ১১ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। কমরেড বিজন ধর চিকিৎসার জন্য কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি ছিলেন। গত ৪০ বছর ধরে দুরারোগ্য ডায়াবেটিস রোগে ভুগছিলেন তিনি। তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী ইলা দাশগুপ্ত, কন্যা গোপা ধর এবং অজস্র পার্টিকর্মী ও তাঁর অনুরাগীকে।
তাঁর মৃত্যুতে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো গভীর শোকপ্রকাশ করেছে।
কোভিডে আক্রান্ত হওয়ায় কমরেড বিজন ধরকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর আগরতলার জে বি পন্থ হাসপাতালে ভরতি করা হয়। ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় আরও ভালো চিকিৎসার জন্য ডাক্তাররা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেই অনুযায়ী কমরেড বিজন ধরকে গত ১৯ সেপ্টেম্বর কলকাতার ফর্টিস হাসপাতালে ভরতি করা হয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (এখন বাংলাদেশ) কুমিল্লা জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে ১৯৫১ সালে কমরেড বিজন ধর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা অনন্ত কৃষ্ণ ধর একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ছিলেন।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কমরেড বিজন ধর ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং রাজ্যজুড়ে সংগঠন গড়ে তোলায় তাঁর প্রশংসনীয় অবদান ছিল। ষাটের দশকে ‘ছাত্র ফেডারেশনে’র সভাপতি হন, পরবর্তী সময়ে এই সংগঠন ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের অনুমোদিত হয়। ছাত্র আন্দোলনে কাজ করার মধ্যদিয়েই ১৯৬৯ সালে সিপিআই(এম)’র সদস্যপদ অর্জন করেন কমরেড বিজন ধর।
১৯৭৫ সালে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থার সময়ে কমরেড বিজন ধর একবছর আত্মগোপন করেন, এবং পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পার্টির অন্যান্য নেতৃত্বের সাথে তিনি প্রায় এক বছর জেলে বন্দি ছিলেন।
১৯৭৮ সালে পার্টির রাজ্য দশম সম্মেলনে রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। একইসাথে সোনামুড়া বিভাগীয় কমিটির সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯৫ সালে পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হবার আগে পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। সেসময়ে কমরেড বিজন ধর পার্টির রাজ্য দপ্তরের কাজকর্ম পরিচালনায় তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক কমরেড বৈদ্যনাথ মজুমদারকে সহায়তা করতেন। ২০০২ সালে সপ্তদশ পার্টি কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত - এক দশক কমরেড বিজন ধর পার্টির রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেও ২০১৮ সালেই তাঁকে রাজ্য বামফ্রন্টের আহ্বায়কের নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়। বামফ্রন্টের ঐক্য ও সংহতি এবং শরিকদলগুলির মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যকে শক্তিশালী করতে কমরেড বিজন ধর-এর সুন্দর সৌজন্যপরায়ণতা ও আন্তরিকতা দেখা গেছে।
কমরেড বিজন ধর উপজাতি-অউপজাতি, ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত অংশের শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য গড়ে তোলায় সারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
দক্ষ সংগঠক হবার পাশাপাশি মার্কসবাদী তত্ত্বে ছিলেন সুপণ্ডিত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাক্রম, বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলি, সমাজতন্ত্রের নির্মাণে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল প্রয়োগ নিয়ে নিজেকে অবহিত রাখতেন। সহজবোধ্য ভাষায় জটিল রাজনৈতিক বিষয় প্রাঞ্জলভাবে বোঝাবার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। ছিলেন সুলেখক। স্বনামে এবং রফিকুল ইসলাম ছদ্মনামে অসংখ্য নিবন্ধ লিখেছেন। গল্প বলার ঢঙে, আলাপচারিতায় মার্কসবাদী তত্ত্ব, মতাদর্শ এবং রাজনৈতিক দর্শনের শিক্ষায় পার্টির কর্মীদের সুশিক্ষিত করার কাজে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সেজন্য তাঁর মৃত্যুতে প্রচারিত শোকবার্তায় সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো বলেছে, তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত এবং মার্কসবাদী তত্ত্বে সুশিক্ষিত।
ভালোবাসতেন গান। একসময় নিজে সুগায়ক ছিলেন। গণআন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে, খাদ্য আন্দোলন, শহিদ কাজল বর্মণের মৃত্যু, লেনিনকে নিয়ে, রেল শিল্প আন্দোলনের সমর্থনে জাঠাসহ বিভিন্ন বিষয়ে একের পর এক গণসঙ্গীত লিখেছেন। ‘‘শহিদের খুনে রাঙা ডেকে বলে ওই রাজপথ’’ বা ‘‘সারা বিশ্বের মুক্তির নেতা লেনিন’’সহ তাঁর লেখা বহু গণসঙ্গীত এখনও রাজ্যের শিল্পীদের কণ্ঠে সমাদৃত।
ব্যক্তিগত জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সহজ সরল ও অনাড়ম্বর। সাধারণ মানুষের সঙ্গে অতি সহজে মিশে থাকার সহজাত ক্ষমতার জন্য কোনোদিন সংসদীয় রাজনীতির অঙ্গনে পা না রাখলেও জনগণের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল উল্লেখ করার মতো।