৫৯ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২২ অক্টোবর, ২০২১ / ৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
ত্রিপুরার চিঠি
জাতি-উপজাতি-অনুপজাতি সকল অংশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই-ই পরাস্ত করবে দক্ষিণপন্থী শক্তিকে
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সিপিআই (এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ত্রিপুরা রাজ্য বামফ্রন্টের আহ্বায়ক কমরেড বিজন ধরের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় গত ১৮ অক্টোবর। আগরতলার রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনের ১ নম্বর প্রেক্ষাগৃহ উপচে পড়া স্মরণসভার উদ্যোক্তা ছিল পার্টির ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি। সভায় নেতৃবৃন্দের আহ্বান ছিল, যৌথ কাজের মধ্য দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিকে। এই কাজে চ্যালেঞ্জ নিন ঐক্যবদ্ধভাবে। ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বামপন্থীদের আপসহীন লড়াই আগামী দিনে হবে আরও তীব্র। এই লড়াইয়ে আরও বেশি মানুষকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নিতে হবে।
বিভিন্ন স্তরের বামপন্থী নেতা-কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতিতে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনের ১ নম্বর প্রেক্ষাগৃহ ছিল পরিপূর্ণ। নির্দিষ্ট আসনে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেকে দাঁড়িয়ে, আলাদা চেয়ারে বসেছিলেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। আবার অনেকেই রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নেতৃবৃন্দের ভাষণ শোনেন। সভা থেকে ঘোষিত হয় প্রত্যয় - শত্রুর কাছে ত্রিপুরা কখনও মাথা নত করবে না। যত আক্রমণই আসুক, লড়াই থামাবে না। আরও শক্তিশালী হবে জাতি-উপজাতি সহ অন্যান্য অংশের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। বিজেপি এবং আইপিএফটি জোট শাসনের বিরুদ্ধে, গণহত্যার বিরুদ্ধে লড়াই হবে শাসকের চোখে চোখ রেখে।
সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই (এম)-র পলিট ব্যুরোর তিন সদস্য প্রকাশ কারাত, বিমান বসু, মানিক সরকার, পার্টির আসাম রাজ্য কমিটির সম্পাদক দেবেন ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব, রমা দাস, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মানিক দে, সিপিআই-র রাজ্য পরিষদের সম্পাদক রঞ্জিত মজুমদার, আরএসপি নেতা দীপক দেব, সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা দুলাল দেব এবং বিজন ধরের একমাত্র কন্যা পূর্বাশা ধর। শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করেন পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন সিপিআই (এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অঘোর দেববর্মা।
প্রকাশ কারাত বলেন, কোভিড মহামারীর সময়ে আমাদের পার্টি ও বাম আন্দোলনের শত শত কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আমাদের পার্টির চারজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের মধ্যে দু’জন ত্রিপুরার। একজন কমরেড গৌতম দাশ, অন্যজন কমরেড বিজন ধর। এটা আমাদের পার্টি এবং বিশেষ করে ত্রিপুরা রাজ্য শাখার জন্য এক বিরাট ক্ষতি। কারণ এঁরা ত্রিপুরার গণআন্দোলনের মধ্যেই তৈরি হয়েছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে নেতৃত্বে উন্নীত হয়েছেন এবং পার্টির বিকাশে বড়ো অবদান রেখেছেন।
কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হঠাৎ একদিনে কেউ হয়ে যান না। পুঁজিবাদী দলের মতো পারিবারিক সম্পর্ক, সম্পত্তি বা জাতিগত পরিচয়ে এখানে কেউ নেতা হন না। এখানে বহু বছরের ত্যাগ, পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতা একজন নেতাকে তৈরি করে। তাই এই ধরনের একজন নেতাকে যখন আমরা অকস্মাৎ হারাই, তখন সেই মানুষটির সঙ্গে বহু বছরের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা, দক্ষতার পুঁজি এবং নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা থেকেও আমরা বঞ্চিত হই। বিজন ধর এমনই একজন সহযোদ্ধা ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। বিজন ধরের অসাধারণত্ব হলো, মার্কসবাসী তত্ত্বের অধ্যয়ন করে একে কমিউনিস্ট পার্টির গঠন ও আন্দোলনের বিকাশে ব্যবহার করেছেন তিনি। বিজন ধর এমনই এক নেতা, যিনি পার্টির সুসময়েও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং পার্টি যখন আক্রমণের মুখে, তখনও নেতৃত্ব দিয়েছেন। এটাই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের পরীক্ষা। আলোচনায় দৃঢ়তার সাথে কথাগুলি উল্লেখ করেন প্রকাশ কারাত।
ত্রিপুরায় বামপন্থী আন্দোলন কতটা তীব্র আক্রমণের মুখে, তা উল্লেখ করে প্রকাশ কারাত বলেন, আমাদের পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি। আমরা আমাদের যৌথ কাজের মাধ্যমে সমস্ত সমস্যা, সব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে আমাদের যৌথ শক্তিতে সামনে এগিয়ে যাবো। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। যদি আমরা সবাই মিলে যৌথ উদ্যোগ, চেতনা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মিলিতভাবে কাজ করি কোনো প্রতিক্রিয়ার শক্তি, কোনো ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণ আমাদের আন্দোলন ও পার্টিকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। এই দৃঢ়তা নিয়ে, যৌথ কাজ ও শক্তিতে তার অভাব পূরণ করার শপথ নিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে।
বিমান বসু বলেন, পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট প্রশাসন এবং মানুষের স্বার্থে কর্মসূচি রূপায়ণে পথ চলার দিক থেকে যে ত্রিপুরা উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল, সেই ত্রিপুরায় আজ মানুষের মধ্যে বিভেদ ও বিরোধের বিষ ছড়াবার চেষ্টা চলছে। তাদের পরাস্ত করা এবং জনবিচ্ছিন্ন করার শপথ নিতে হবে। আর এর মধ্য দিয়েই প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হবে বিজন ধরকে। তিনি ভাষণে উল্লেখ করেন দেশের সর্বত্র মানুষের ওপর মানুষের শোষণ ব্যবস্থাটাকে আরও পাকাপোক্ত করার কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে শাসকশক্তি। তার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে আরও বেশি মানুষকে যুক্ত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। লড়াই-সংগ্রামে ও তীব্র গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ঘন অন্ধকারের দিন অতিক্রম করে ত্রিপুরায় আবার আলোর রোশনাই ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হয়েছিল। এখন ত্রিপুরায় যা চলছে, তা এককথায় বলা যাবে না। তবে বামফ্রন্টের সময়ের চেয়ে এখন মানুষ যে ভালো নেই, তা অকপটেই অধিকাংশ মানুষ স্বীকার করবেন। গণতন্ত্রের উপর হামলা, আক্রমণ, মানুষের অধিকারের উপর হামলা, আক্রমণ এসব চলছে এখন ত্রিপুরাতে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, জাতের নামে মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা। এই অপশক্তি মানুষের ঐক্য, মানুষে মানুষে সংহতি পছন্দ করে না। প্রসঙ্গক্রমে বিমান বসু বলেছেন, হঠাৎ করে শোনা গেলো বাংলাদেশে খুব খারাপভাবে মন্দিরে হামলা হয়েছে। হামলাকারীরা মৌলবাদী। তাদের কোনো ধর্ম-বর্ণ থাকে না।
স্বাধীনোত্তর ভারতে এই প্রথম ১১ মাসের উপর ধরে চলা কৃষক আন্দোলন দমনে সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের লখিমপুর খেরিতে কৃষক হত্যার ঘটনাও উঠে আসে বিমান বসুর ভাষণে। তিনি বলেন, কৃষকদের দাবি ন্যায্য দাবি। কৃষকরা আমাদের অন্নদাতা। এই কৃষকদের প্রতি সামান্য চিন্তাভাবনা নেই মায়া মমতা নেই।
মানিক সরকার বলেন, আমরা কমিউনিস্টরা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রাজনীতি মাথায় রেখেই কাজ করি। একটা অঞ্চলভিত্তিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা কাজ করতে অভ্যস্ত নই। তাই গৌতম দাশ, বিজন ধরের অনুপস্থিতি শুধু ত্রিপুরা মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য অভাবনীয় ক্ষতি নয়, দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্যও ক্ষতি। ৫০ বছরের গভীর অভিনিবেশ নিয়ে আদর্শের প্রতি অনুরাগ রেখে মানুষের মধ্যে নিজেদের সমর্পিত করে লড়াইয়ের ময়দান থেকে এই নেতারা তৈরি হয়েছিলেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব আকাশ থেকে পড়ে না। মাটি ফুঁড়েও উঠে আসে না। জনগণের লড়াই-সংগ্রাম কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বের জন্ম দেয়।
সংগঠন ছাড়া শ্রেণি সংগ্রাম সুসংহত হতে পারে না - এই মন্তব্য করে বামপন্থী নেতা-কর্মীদের করণীয় সম্পর্কে মানিক সরকার বলেন, জনগণের দিকে সজাগ নজর রাখতে হবে। একেবারে গ্রামাঞ্চলের নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের মধ্যে বিরাজমান জ্বলন্ত সমস্যা থেকে শুরু করে জাতীয় স্তরে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত সমস্যা নিয়ে লড়াই করতে হবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আক্রমণ যে বিপন্নতা তৈরি করেছে, তার থেকে মানুষকে বের করে আনতে, বিকল্পের সন্ধান দিতে গণসংগ্রাম, শ্রেণিসংগ্রাম সুদৃঢ় করতে হবে। এটা বাদ দিয়ে পার্টি সংগঠন শক্তিশালী হবে না।
বিজেপি’র শাসনে ত্রিপুরায় ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণ শেষ কথা বলবে মনে করলে ভুল করা হবে বলে মন্তব্য করেন মানিক সরকার। তিনি বলেন ঘুরে দাঁড়াতে হবে সংঘবদ্ধভাবে। যোগ্য নেতৃত্ব গড়ার মধ্য দিয়েই সামনের দিনের লড়াই-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটাই হবে যাঁরা প্রয়াত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
দেবেন ভট্টাচার্য বলেন, বিজন ধরের সঙ্গে আমার অনেক দিনের সম্পর্ক। সেই ছাত্র আন্দোলন থেকে। বরাক উপত্যকার সাংগঠনিক কিছু সভাতে উপস্থিত ছিলেন তিনি। বিশেষ করে করিমগঞ্জ, কাছাড়, হাইলাকান্দি জেলাগুলিতে সংগঠন বৃদ্ধি করা নিয়ে বিশেষভাবে পরামর্শ দিতেন তিনি। এতে আমরা উপকৃত হতাম। তাঁর মৃত্যুতে শুধু ত্রিপুরাই নয়, আসামের পার্টি, গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরও ক্ষতি হয়েছে।