৫৯ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২২ অক্টোবর, ২০২১ / ৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
কমরেড সরযু দত্ত’র জীবনাবসান
ত্রিপুরায় সামন্ত রাজাদের নিপীড়নমূলক শাসনে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম এবং মহিলাদের শৃঙ্খলমুক্তির সংগ্রামের আলোকবর্তিকা কমরেড সরযু দত্ত গত ৫ অক্টোবর আগরতলার আইজেএম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার অন্যতম পুরোধা কমরেড বীরেন দত্ত’র স্ত্রী ছিলেন কমরেড সরযু দত্ত। তিনি ১৯৪৭ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মানিক সরকার।
একজন কমিউনিস্টের স্ত্রী হিসেবে কমরেড সরযু দত্ত সামন্ত শাসনের নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক শোষণের জোয়াল থেকে উপজাতি ও অউপজাতি মানুষের মুক্তির লড়াইতে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। গত শতকের চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কমরেড বীরেন দত্ত’র সাথে তাঁর বিবাহ হয়। সেই সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যে এক বিশৃঙ্খলার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। কমরেড দশরথ দেবের নেতৃত্বে জনশিক্ষা সমিতিও এই সময়ে গড়ে ওঠে।
জনশিক্ষা সমিতির কর্মীরা উপজাতি মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে সামন্ত রাজার সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধেও জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করতে শুরু করেন। এরফলে জনশিক্ষা সমিতির কর্মীদের ওপর, উপজাতি জনগণের ওপর সামন্ত রাজার পুলিশের নিপীড়ন ও অত্যাচার নেমে আসে। পুলিশের নিপীড়ন থেকে উপজাতি জনগণকে বাঁচাতে ১৯৪৮ সালে সমিতির নেতৃবৃন্দ তৈরি করলেন গণমুক্তি পরিষদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়। কমরেড বীরেন দত্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁকে অসমের তেজপুর জেলে পাঠানো হয়।
কমরেড বীরেন দত্ত এবং পার্টির অন্যান্য নেতৃত্বকে পুলিশ যখন গ্রেপ্তার করল তখন কমরেড সরযু দত্ত তাঁর দুধের শিশুকে নিয়ে একেবারে একা। জেলের বাইরে থাকা গণমুক্তি পরিষদের নেতৃত্ব তাঁকে প্রত্যন্ত উপজাতি গ্রাম সুতারমুড়ায় থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানে জনশিক্ষা সমিতির প্রতিষ্ঠিত একটা স্কুলে পড়ানোর কাজে কমরেড সরযু দত্তকে যুক্ত করা হয়। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তিনি স্কুলে যেতেন। গ্রামবাসীরা তাঁর থাকার ও বাচ্চার দুধের ব্যবস্থা করেছিল, এবং সামান্য কিছু চাল ও সবজি তাঁকে মজুরি হিসেবে দেওয়া হতো। কমরেড সরযু দত্ত আনন্দের সাথেই এই জীবনকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি উপজাতি মানুষদের ভাষা, খাদ্যাভাস, সংস্কৃতি প্রভৃতি আয়ত্ত করেছিলেন। স্কুলে পড়ানোর সাথেই রাজার শাসনের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান শুরু করেন। তিনি উপজাতি মানুষদের সামনে এই মতই ব্যক্ত করেন - বেশিরভাগ মানুষ যে আর্থ-সামাজিক দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করেন তা ভগবানের অভিশাপ নয়, শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাই এরজন্য দায়ী। তিনি ডাইনি-খোঁজা, কবচ পড়া, ওঝা দিয়ে চিকিৎসা প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিবিড় প্রচার চালান। গ্রেপ্তারি এড়াতে কমরেড সরযু দত্ত পুলিশের সাথে লুকোচুরি চালাতেন। উপজাতি অঞ্চলে তিনি তিন বছর ছিলেন।
ত্রিপুরা রাজ্য মহিলা সমিতির প্রথম সম্মেলন ১৯৫১ সালে সদর মহকুমার দারোগামুড়ায় হয়। সম্মেলনে কমরেড সরযু দত্ত সহ-সম্পাদিকা হিসেবে নির্বাচিত হন।
গত শতকের ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল হয় রাজ্য। সে সময়ে কমরেড সরযু দত্ত আগরতলার জয়নগরে থাকতেন। ছাত্রদের দপ্তর চালানোর জন্য তিনি বাড়ির একটা ঘর ছেড়ে দেন। বিভিন্ন মহকুমা থেকে ছাত্রছাত্রীরা সংগঠনের কাজে আগরতলায় এলে এই দপ্তরেই যোগাযোগ করত। ছাত্র সংগঠনের কমরেডদের (যাঁদের অনেকেই বর্তমানে পার্টির নেতা) সঙ্গে তাঁর মাতৃসুলভ আচরণ এখনও তাঁদের স্মৃতিতে সজীব।