E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২২ অক্টোবর, ২০২১ / ৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮

ত্রিপুরায় আরএসএস’র ট্রোজান হর্স হয়ে বামফ্রন্টকে আটকাতে চায় তৃণমূল

সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত


ত্রিপুরায় ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নয়া বর্গীরা হানা দিচ্ছে আগরতলায়। কোনো সংগঠন না থাকা সত্ত্বেও খোয়াবে বিভোর তৃণমূলের নেতানেত্রীদের সাজিয়ে গুছিয়ে বিমানে আগরতলা পাঠানো হচ্ছে। সঙ্গে যাচ্ছে মমতা ব্যানার্জির অনুগত সংবাদমাধ্যম - যাদের মালিকরা সরকারি বিজ্ঞাপন ও পয়সার জোরে বহুদিন আগেই বিবেক বন্ধক রেখেছেন মমতার কাছে। গত ১০ বছর মমতা ব্যানার্জির সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে এইসব সংবাদমাধ্যমের মালিকরা। চ্যানেলে চ্যানেলে গলার শিরা ফুলিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস ও ধারাভাষ্য শুনে মনে হচ্ছে ত্রিপুরায় গত তিন বছর ধরে বামপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশে বিজেপি-আরএসএস’র ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণ নিয়ে তাঁরা বিন্দুমাত্র অবহিত ছিলেন না। এখন তৃণমূলকে প্রচারে বাধা দেওয়ার ফলে তাঁদের কিছুটা উপলব্ধি হয়েছে। দশ বছর আগেও যিনি রাজনীতিতে আসেননি - তৃণমূলের পারিবারিক শাসনের সেই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে জননেতা সাজিয়ে প্রচার করছে এই বিকৃত সংবাদমাধ্যমগুলি।

২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর থেকে যেভাবে কমিউনিস্টদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্য নিয়ে গত দশ বছর ধরে স্বৈরাচারী আক্রমণ নামিয়ে এনেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার, ঠিক একই নৃশংসতায় ত্রিপুরার বিজেপি সরকার ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ক্ষমতা দখল করেই কমিউনিস্টদের উপর আক্রমণ নামিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বামপন্থীদের ওপর এই ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণের বিরুদ্ধে এতদিন নিশ্চুপ ছিল সংবাদমাধ্যমগুলি।

২০১৮ সালের ৩ মার্চ ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগণনা চলাকালীনই ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শুরু হয়ে যায় বামপন্থীদের ওপর বিজেপি-আরএসএস ঝটিকা বাহিনীর হিংসাত্মক আক্রমণ। এমনকী পুলিশের সামনেই গণনায় কারচুপি করে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে হারানোর জন্য তাঁকে গণনাকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। মানিক সরকারের দৃঢ়তায় সেই যাত্রায় আরএসএস-বিজেপি দুর্বৃত্তদের পিছু হঠতে হয়েছিল।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ত্রিপুরার মতো ছোটো রাজ্যে ৬৬২টি সিপিআই(এম) পার্টি অফিস, ২০৪টি বাম গণসংগঠনের অফিস এবং সিপিআই(এম) সদস্যদের ৩৩৬৩টি বাড়ি ও ৬৯৫টি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বা ভাঙচুর করা হয়েছে। খুন করা হয়েছে ১৯ জন বামপন্থী কর্মীকে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ২২টি কলেজ ইউনিয়ন দখল হয়ে যায়। বিলোনিয়ায় বুলডোজার দিয়ে ঘৃণ্য উল্লাসে ভাঙা হয় লেনিন মূর্তি। তৎকালীন রাজ্যপাল আরএসএস’র তথাগত রায় মূর্তি ভাঙাকে সমর্থন জানিয়ে টুইট করেছিলেন। নির্বাচনের ফল প্রকাশের সময় থেকে ত্রিপুরা জুড়ে বিজেপি’র ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। নির্বাচনের পরপরই এই আক্রমণের নিন্দা না করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা তাঁদের আদর্শগত জয়।

গত ৬ সেপ্টেম্বর নিজের কেন্দ্রের বিধায়ক হিসাবে একটি পূর্বনির্ধারিত গণডেপুটেশনে যোগ দিতে বিজেপি এবং পুলিশ বাধা দেয় মানিক সরকারকে। কিন্তু জনতার প্রতিরোধে বিজেপি’র বাধা উড়িয়ে কর্মসূচিতে যোগ দেন মানিক সরকার। জনতার সেই প্রতিরোধে আতঙ্কিত বিজেপি-আরএসএস সংগঠিতভাবে ফ্যাসিস্তসুলভ কায়দায় রাজ্যজুড়ে শুরু করে বেনজির হিংস্র গেরুয়া সন্ত্রাস। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর, লুট, অগ্নিসংযোগ ও বামকর্মীদের ওপর দৈহিক আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তর ফ্যাসিস্তসুলভ পদ্ধতিতে আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আক্রান্ত হয় ডেইলি দেশের কথা, প্রতিবাদী কলম, পিবি ২৪ ও দুরন্ত টিভি চ্যানেল। ত্রিপুরার কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নেতা দশরথ দেবের মূর্তি ভেঙে দেওয়া হয়। ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বরের গেরুয়া সন্ত্রাসে সিপিআই(এম)’র ৪২টি, আরএসপি এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ১টি করে অফিস ভাঙচুর বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সিপিআই(এম) সমর্থকদের ৬৭টি বাড়ি ও দোকান লুট বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

পাশাপাশি ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণের সংক্ষিপ্ত কিছু খতিয়ান দেখলে ত্রিপুরার সাথে মিল দেখতে পাওয়া যাবে। তৃণমূলের গত ১০ বছরের শাসনে পশ্চিমবঙ্গে এপর্যন্ত ২৩০ জন বামপন্থী কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন ৫০ হাজারের ওপর বাম সমর্থক, ৭হাজার বাড়ি ধ্বংস বা পোড়ানো হয়েছে, ১০ হাজার একর জমি থেকে প্রায় ২৮ হাজার পাট্টাদার ও বর্গাদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ভয় দেখিয়ে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৫০ কোটি টাকারও বেশি। শাসক দলের দুষ্কৃতীদের হাতে বামপন্থীদের দেড়হাজার পার্টি অফিস ও ৫০০ গণসংগঠনের কার্যালয় লুট, দখল বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে ৫০ হাজারের ওপর বামপন্থী নেতা-কর্মীকে। ত্রিপুরার মতো লেনিন মূর্তি ভাঙা হয়েছে যাদবপুর, গড়বেতা ও অন্যত্র। ২০১৬ সালে বামপন্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য বসিরহাটের পানিগোবরা গ্রামের প্রায় পুরোটাই জ্বালিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল দুষ্কৃতীরা।

ছাত্রনেতা শহিদ সুদীপ্ত গুপ্তর পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর প্রতিবাদে দিল্লি পুলিশের অনুমতি নিয়ে ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল এক ধিক্কার সমাবেশ আহুত হয়েছিল দিল্লির যোজনা ভবনের সামনে। যোজনা কমিশনের সাথে আলোচনায় আসার পথে এই প্রতিবাদ সমাবেশ দেখে রুষ্ট হন মমতা ব্যানার্জি। ওইদিন রাত্রেই শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী দলের উপর ঘৃণ্য আক্রমণ। কোচবিহার থেকে সাগর - সহস্রাধিক সিপিআই(এম) অফিস ধ্বংস করা হয়। আক্রান্ত হন প্রাক্তন মন্ত্রী, নেতা ও সংগঠকরা। বামপন্থী অন্যান্য দলের অফিসও এই আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। আক্রমণের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে পুলিশের সামনে। সরকার থেকে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। ত্রিপুরায় গত ৭-৮ সেপ্টেম্বরে বিজেপি-আরএসএস’র ত্রিপুরা জুড়ে আক্রমণের সাথে ২০১৩ সালে মমতা ব্যানার্জির দলের ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণের অদ্ভুত মিল দেখলে কী অন্যায় হবে!

মমতা ব্যনার্জির সাথে বিজেপি’র আসল পরিচালক আরএসএস’র ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। এই পর্যন্ত মমতা ব্যানার্জিকে আরএসএস’র বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে একবারও দেখা যায়নি। মমতার নাকি আসল লড়াই বিজেপি’র বিরুদ্ধে, আরএসএস’র বিরুদ্ধে নয়। বাজপেয়ী মন্ত্রীসভায় থাকাকলীন তিনি প্রায়ই বলতেন বাজপেয়ী ভালো, আদবানি খারাপ। আবার দেখা গেল আদবানির সাথে তাঁর সখ্যও কম নয়। এরই প্রতিদানে নারদ ঘুষকাণ্ডের এথিকস্ কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে একটি সভাও সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে আদবানি ডাকেননি। ফলে নারদ ঘুষকাণ্ডে জড়িত তৃণমূলের কলঙ্কিত নায়করা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মমতা ব্যানার্জির দলকে বাঁচাবার জন্যই অনেক হিসাব করে আদবানিকে এথিকস্‌ কমিটির চেয়ারম্যান করেছিলেন।

২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার পরে শত শত মানুষের মৃত্যুর জন্য যখন দেশজুড়ে ধিক্কৃত নরেন্দ্র মোদি এবং কেন্দ্রের বাজপেয়ী সরকারের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনায় গোটা দেশ উত্তাল, ঠিক সেই সময় সংসদে বিজেপি’র পক্ষে সমর্থন দিতে মমতা ব্যানার্জি এগিয়ে এসেছিলেন। ‘অ্যান আউটসাইডার ইন পলিটিকস’ পুস্তকের লেখিকা তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু এই প্রশ্নে মমতার দু’মুখো আচরণে হতাশ ও হতবুদ্ধিও হয়ে পড়েছিলেন। গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গার আলোচনায় সংসদে বাজপেয়ী সরকারকে সমর্থনের তীব্র বিরোধী ছিলেন কৃষ্ণা বসু। তাঁর দাবি ছিল, এই প্রশ্নে দল সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিক।কিন্তু মমতার ইচ্ছানুযায়ী তৃণমূল কংগ্রেস বাজপেয়ী সরকারের পক্ষে ভোট দেবে এই সিদ্ধান্তই হয়ে যায়। লোকসভার সেই বিতর্কে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে এই একাত্মতার বিষয়টি কৃষ্ণা বসুর বর্ণনায় আরও স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। এখানেই থেমে ছিলেন না মমতা ব্যানার্জি। গণহত্যার কিছুকাল পরেই বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর দ্রুত নরেন্দ্র মোদিকে ফুলের তোড়া পাঠিয়ে অভিনন্দন জানাতে কোনো দ্বিধা রাখেননি।

২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে আরএসএস’র মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’-র সম্পাদক তরুণ বিজয়ের লেখা কমিউনিস্ট বিরোধী একটি পুস্তকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির আরএসএস নেতাদের উপস্থিতিতে মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেনঃ ‘আপনারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক। আমি জানি আপনারা দেশকে ভালোবাসেন।’ এমনকী, ‘কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি আরএসএস-কে সমর্থন করবেন’ - বলে জানিয়েও দিয়েছিলেন। আরএসএস’র মতো ফ্যাসিবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে মমতা ব্যানার্জির এহেন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে খুশি হয়ে আরএসএস নেতা বলবীর পুঞ্জ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘হামারি মমতাদি, সাক্ষাৎ দূর্গা’ (দ্য টেলিগ্রাফ, ১৬/০৯/২০০৩)। এইরকম মমতার আরএসএস প্রীতির অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়।

২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের পর তৃণমূল কংগ্রেস ত্রিপুরায় ৬ জন কংগ্রেসের বিধায়ককে ভাঙিয়ে এনে ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টকে হারিয়ে ত্রিপুরা দখলের খোয়াব দেখেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ত্রিপুরার তৃণমূল দলটি পুরোপুরি বিজেপি’তে চলে যায়। তৃণমূলের তৎকালীন রাজ্য সভাপতি এখন বিজেপি’র বিধায়ক। এইভাবেই সেদিন বামপন্থীদের শক্তিহ্রাসে বিজেপি’র সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল তৃণমূল। তেমনই আজও বিজেপি’কে সাহায্য করতে বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ করে আগামী নির্বাচনে বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় আসা আটকাতে এবং বিজেপি-কে পুনরায় ক্ষমতায় আনার আরএসএস’র গোপন অ্যজেন্ডা রূপায়ণেই ত্রিপুরাতে তৃণমূলের এই সাম্প্রতিক তৎপরতা।

ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট আন্দোলন ও আত্মত্যাগের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরের জন্য সামন্ত-বিরোধী শক্তির সংগঠিত আন্দোলনে উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছিল তীব্র সংগ্রাম। ১৯৪৫ সালে বীরেন দত্তের নেতৃত্বে আগরতলায় অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লা জেলা কমিটির অধীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি শাখা গঠিত হয়। এটাই ছিল ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রথম উদ্যোগ।

৭৬ বছর আগে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কমিউনিস্ট নেতা বীরেন দত্ত’র উৎসাহে ত্রিপুরায় গড়ে ওঠে ত্রিপুরা জনশিক্ষা সমিতি। এর সভাপতি ছিলেন সুধন্বা দেববর্মা সহ-সভাপতি ছিলেন দশরথ দেব। গঠনের অল্প সময়ের মধ্যেই জনশিক্ষা সমিতি উপজাতি অধ্যুষিত গ্রাম ও পাহাড়ে ৪৮০টি স্কুল স্থাপন করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে ৩০০টিকে ব্রিটিশ প্রশাসন অনুমোদন দিয়েছিল। ত্রিপুরার রাজা কমিউনিস্টদের এই মহৎ উদ্যোগকে ভালোভাবে নেননি। তিনি তাঁর মোসাহেবদের দিয়ে পাল্টা ত্রিপুরা সঙ্ঘ গঠন করেছিলেন। যদিও তা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। সুদখোর মহাজন, সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ১৯৪৮ সালে গড়ে ওঠে ত্রিপুরা গণমুক্তি পরিষদ, যার উত্তরসুরি বর্তমানে উপজাতি গণমুক্তি পরিষদ। ত্রিপুরার সাধারণ মানুষের সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে গণমুক্তি পরিষদ।

স্বাধীনতা লাভের পর ত্রিপুরা ছিল রাজার দেওয়ানি শাসনাধীনে। ১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট ত্রিপুরা ভারতে অন্তর্ভুক্তি হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনে গোলাঘাটিতে পুলিশের গুলিচালনায় ১২ জন কৃষকের মৃত্যু ও শতাধিক আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ১০ জন উপজাতি ও ২জন মুসলিম ছিলেন। শতাধিক গুরুতর আহতর সরকারি চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে হাতুড়েদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ ও রাজকীয় দেওয়ানি শাসকরা। কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ বিজয় বসুর নেতৃত্বে চিকিৎসকদের একটি দল কলকাতা থেকে গিয়ে আহতদের চিকিৎসা করেছিলেন। এই ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ত্রিপুরার মানুষের আস্থা অর্জন করেছিল কমিউনিস্টরা। তারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল ১৯৫১ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ত্রিপুরায় লোকসভার ২টি আসনেই জয়ী হয়েছিলেন কমিউনিস্টরা। একটি আসনে বীরেন দত্ত ও অন্য আসনে দশরথ দেব। দশরথ দেব আত্মগোপন অবস্থায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন।

এরপর অজস্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭৮ সালে ৬০টির মধ্যে ৫৪টি আসন পেয়ে ত্রিপুরায় ক্ষমতাসীন হয় বামফ্রন্ট। এই নির্বাচনের বিশেষত্ব হচ্ছে, দীর্ঘদিনের শাসক কংগ্রেস একটি আসনও পায়নি। বামফ্রন্টকে স্বাভাবিকভাবে হারানো সম্ভব নয় বুঝেই ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগে রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকার উপদ্রুত অঞ্চল ঘোষণা করে। ভোট গণনায় কারচুপি করে জয়ী হয় কংগ্রেস-ত্রিপুরা উপজাতি সমিতি জোট। বামফ্রন্ট কংগ্রেস জোটের থেকে ১ শতাংশ ভোট বেশি পেলেও গণনায় কারচুপি করে জেতানো হয় জোটকে। এই নির্বাচনে কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ৩২টি আসন এবং বামফ্রন্ট পেয়েছিল ২৮টি আসন। উপদ্রুত অঞ্চল ঘোষণা ও গণনায় কারচুপিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সন্তোষমোহন দেব, যাঁকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ডাকতেন সন্ত্রাসমোহন দেব নামে। এই কথা উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক যে, সেই সময় কংগ্রেসে থাকা তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী মমতা ব্যানার্জির সাথে এই ধরনের রিগিংয়ের নায়ক সন্তোষমোহন দেবের সখ্য গড়ে উঠেছিল। এই সময়েই ঘটেছিল বীরচন্দ্র মনুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড। সিপিআই(এম) পার্টি অফিসে পতাকা উত্তোলনের সময় কংগ্রেসীদের আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন ১১ জন পার্টিনেতা ও কর্মী।

২০১৮ সালের ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে ৪৩.৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজেপি আসন পেয়েছিল ৩৫টি, বামফ্রন্ট ৪৪.৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিল ১৬টি আসনে। তৃণমূল ২৪টা আসনে প্রার্থী দিয়ে মাত্র ০.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে সব আসনে জামানত খুইয়েছিল। বিজেপি জিতেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সাথে জোট করে। নির্বাচনের এই ফলাফল এবং বিজেপি-আরএসএস’র ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণের মোকাবিলা করে গত তিন বছর মানুষকে নিয়ে যে দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে বামফ্রন্ট তাতে আগামী নির্বাচনে বিজেপি’র পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনেই আরএসএস’র পরিকল্পনামাফিক তৃণমূলের ত্রিপুরায় আগমন। উদ্দেশ্য বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ করে পুনরায় বিজেপি’র ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করা। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, ত্রিপুরাতে তৃণমূলের এই দাপাদাপি আরএসএস’র সাথে গোপন বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই হচ্ছে। শুধু ত্রিপুরা নয়, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও বিজেপি’র বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বিরোধী ঐক্যকে ইতিমধ্যেই ভিতর থেকে অন্তর্ঘাত করে চলেছে তৃণমূল। আসলে তৃণমূল হচ্ছে আরএসএস’র ট্রোজান হর্স।