৫৯ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২২ অক্টোবর, ২০২১ / ৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
গান্ধী এবং সাভারকর - রাজনাথ সিংয়ের অনৃত ভাষণ
বৃন্দা কারাত
সম্প্রতি বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে নিয়ে লেখা এক পুস্তক প্রকাশের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বললেন,‘‘সাভারকরকে নিয়ে বারবার মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে। প্রচার করা হয়েছে, কারাবন্দি থাকাকালীন তিনি নাকি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বন্দিদশা থেকে মুক্তি চেয়ে পর পর অনেকগুলি আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো মহাত্মা গান্ধী তাঁকে ক্ষমাপ্রার্থনা করে আবেদনপত্র জমা দিতে বলেছিলেন...’’
সম্ভবত এই প্রথম কোনো বরিষ্ঠ বিজেপি নেতা নিজমুখে স্বীকার করলেন, তাঁদের চিরস্মরণীয় বরেণ্য সাভারকর ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে একাধিক আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলেন। পরাধীন ভারতে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী ব্রিটিশ সরকারের হাতে বন্দি হয়ে বছরের পর বছর আন্দামানের সেলুলার জেলে দিন কাটিয়েছেন। অকথ্য অত্যাচারের পরেও স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি তাঁরা। এর বিপ্রতীপে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজেপি’র একমাত্র আইকন সাভারকর ব্যাকুল হয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে একের পর এক দয়া ভিক্ষার আবেদন জমা দিচ্ছেন - বিষয়টা বিজেপি’র কাছে গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে রয়েছে। এই চরম অস্বস্তি লাঘব করার জন্যই মহাত্মা গান্ধীকে টেনে আনা। গান্ধীজি নিজে এগারোবার ব্রিটিশদের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। সারা জীবনে কী একবারও তিনি ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করে আবেদন করেছিলেন?
কথায় বলে - তথ্যনিষ্ঠ বাস্তবকে অস্বীকার করা যায় না। আরও একটি আপ্তবাক্য আছে - বাস্তবের মধ্য থেকে সত্যকে খুঁজে নাও। যদি বাস্তব তথ্য জানতে চান, সাভারকরকে নিয়ে এ জি নুরানি যা লিখেছেন, সেগুলি পড়ে নিন। নুরানির তথ্যনিষ্ঠ গবেষণালব্ধ লেখাগুলির মধ্যে রয়েছে গ্রন্থ ‘সাভারকর এবং হিন্দুত্ব’ (সাভারকর অ্যান্ড হিন্দুত্ব) এবং প্রবন্ধ ‘সাভারকরের ক্ষমাভিক্ষার আবেদনপত্র’ (সাভারকরস মার্সি পিটিশন)। ভারতের জাতীয় মহাফেজখানায় (ন্যাশনাল আর্কাইভস অব ইন্ডিয়া) সংরক্ষিত নথি ও দলিলপত্র উদ্ধৃত করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, বন্দি থাকাকালীন ক্ষমাপ্রার্থনা করে একটি নয়, অনেকগুলি আবেদনপত্র লিখেছিলেন সাভারকর।
ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ব্রিটিশ অফিসারদের খুন ও খুনে সহায়তা করার আলাদা আলাদা অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল। এরপর ১৯১১ সালের জুন মাসে তাঁকে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গ্রেফতারের কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে প্রথম আবেদনপত্রটি জমা দেন। সেই প্রথম আবেদনপত্রে তিনি কী লিখেছিলেন তা জানার কোনো উপায় নেই, তবে তাঁর দ্বিতীয় আবেদনপত্রে প্রথমটির উল্লেখ থাকায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে দ্বিতীয় আবেদনপত্রটি তিনি লিখেছিলেন ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর তারিখে। ওই আবেদনপত্রে তিনি উল্লেখ করেন,‘‘আমি ক্ষমা প্রার্থনা করে ১৯১১ সালে যে আবেদনপত্রটি জমা দিয়েছিলাম, দয়া করে সেটি আপনার বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত করবেন... সরকার যেমনভাবে চাইবেন ঠিক সেভাবেই আমি সরকারের সেবা করতে তৈরি আছি... একমাত্র বলবানই পারে ক্ষমাশীল হতে, এবং দিগ্ ভ্রষ্ট পুত্র তার মাতৃপিতৃসম সরকারের দরজা ছাড়া আর কোথায় ফিরে যাবে...’’
এই আবেদনপত্রগুলির মধ্যে স্পষ্ট ভাষায় এক কারাবন্দির অপরাধ স্বীকার এবং ব্রিটিশদের সেবাদাস হয়ে জীবন কাটানোর অঙ্গীকার লিপিবদ্ধ ছিল। ১৯১১ থেকে ১৯১৩ সালের মধ্যে সাভারকর যখন ক্ষমাভিক্ষা করে এই দু’টি প্রার্থনাপত্র জমা দেন, তখন গান্ধীজি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। তিনি ভারতে ফিরে আসেন ১৯১৫ সালে। ১৯১৫ সাল পর্যন্ত যিনি ভারতে ছিলেনই না, তিনি কী করে ১৯১১ সালে সাভারকরকে ক্ষমা প্রার্থনা করার পরামর্শ দেবেন? এইটুকুতেই প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়, রাজনাথ সিং যা বলেছেন তা আদ্যোপান্ত মিথ্যা।
এরপর ১৯১৪ সালে সাভারকর আবারও ক্ষমাভিক্ষা করে আবেদনপত্র জমা দেন। এবারে তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, ব্রিটিশরা যেভাবে বলবে সেভাবেই তিনি তাদের স্বার্থে কাজ করতে প্রস্তুত। তিনি অন্য সকল রাজনৈতিক বন্দির প্রতিও ক্ষমা প্রদর্শনের প্রার্থনা করেন। তিনি ভেবেছিলেন, ব্রিটিশ সরকার যদি সকল বন্দির প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে তবে তিনি ও তাঁর ভ্রাতা, দু’জনেই মুক্তি পাবেন। এরপর ১৯১৭ সালেও তিনি এই অনুরোধের পুনরুল্লেখ করেন। এইভাবে ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করে অন্তত চারটি আবেদনপত্র লিখেছিলেন তিনি, যার মধ্যে তিনটিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, মুক্তি পেলে তিনি ব্রিটিশদের সম্পূর্ণ সমর্থন করবেন। উল্লেখ্য,এই চারটিতেই সাভারকর নিজে হস্তাক্ষর করেছিলেন। এবং এই চারটি আবেদনপত্র লেখা হয়েছিল এই বিষয়ে গান্ধীজির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হবার আগেই।
‘গান্ধী রচনা সংগ্রহ’ (দ্য কালেক্টেড ওয়ার্কস অব গান্ধী) গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট তথ্য অনুসারে ১৯২০ সালের জানুয়ারি মাসে ভি ডি সাভারকরের তৃতীয় ভ্রাতা গান্ধীজির কাছে এক চিঠি লিখে কারাবন্দি সাভারকর ও তাঁর দ্বিতীয় ভ্রাতাকে কীভাবে মুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দেবার অনুরোধ করেন। গান্ধীজির উত্তর খুব স্পষ্ট ভাষায় লেখা ছিল। তিনি বলেন,‘‘আপনার চিঠি আমি পেয়েছি। এই বিষয়ে আপনাকে পরামর্শ দেওয়া খুবই কঠিন কাজ। তবে আমার মনে হয়,আপনি একটি আবেদনপত্র লিখতে পারেন, যাতে সংশ্লিষ্ট সমস্ত তথ্য দেওয়া থাকবে এবং সে তথ্য থেকে স্পষ্ট হবে যে, আপনার ভাই যে অপরাধটি করেছেন, সেটি পুরোপুরি রাজনৈতিক।’’ অর্থাৎ সাভারকর তাঁর আবেদনপত্রে যা লিখেছেন, তা গান্ধীজির পরামর্শে একেবারেই ছিল না। গান্ধীজি বলেছিলেন একরকম, কিন্তু সাভারকর লিখলেন সেই আগের আবেদনগুলির মতোই ব্রিটিশদের কাছে পুরো অবনত মস্তকে অনুগত থেকে ব্রিটিশদের সেবা করে যাওয়ার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে। ব্রিটিশদের উদ্দেশে তিনি লিখলেন, তাঁকে মুক্তি দিলে তিনি ‘‘ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত হতে পারবেন এবং রাজনৈতিকভাবে সহায়ক হবেন।’’ কাজেই গান্ধীজির পরামর্শ মেনে সাভারকর ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমাভিক্ষার আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলেন - এই কথাটি শুধু সত্যের অপলাপই নয়, গান্ধীজির স্মৃতির প্রতি অবমাননাও বটে।
আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়। ভগ্নস্বাস্থ্য বা মানবিকতার কারণ দেখিয়ে বহু কারাবন্দিই ক্ষমাপ্রার্থনার আবেদন জমা দেন। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এতে অনেকে মুক্তিও পেয়ে যান। ব্রিটিশরাও এভাবে বহু বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু সাভারকরের আবেদনপত্র অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সাভারকর তাঁর আবেদনপত্রে শুধু ক্ষমাপ্রার্থনাই করেন নি, ওই সঙ্গে ব্রিটিশ রাজের প্রতি তাঁর নিঃশর্ত আনুগত্যও প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি আজীবন ব্রিটিশদের স্বার্থে কাজ করে যাবার অঙ্গীকারও করেছেন তিনি। এবং শুধুমাত্র আবেদনপত্র লিখেই থেমে থাকেন নি তিনি, ১৯২৪ সালে কারামুক্ত হবার পর থেকে প্রতিশ্রুতিমতো ব্রিটিশদের সেবা করে গেছেন।
গান্ধী হত্যার বিচারের সময় আদালতে গডসে, সাভারকার (পেছনের সারিতে চশমা ও টুপি পরে) সহ অন্যান্যরা।
১৯১১ সালের ক্ষমাভিক্ষার আবেদনপত্রে তিনি নিজেকে ব্রিটিশ সরকারের ‘পুত্র’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তার পর থেকে প্রতিটি ক্ষমাভিক্ষার আবেদনপত্রে নিজেকে ব্রিটিশ সরকারের আরও বেশি অনুগত করে দেখানোর চেষ্টা করে গেছেন তিনি। ১৯২০ সালের আবেদনপত্র তিনি নিজেকে উপনিবেশবাদী শক্তির রাজনৈতিক স্বার্থবাহী বলে বর্ণনা করেছেন। উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ শক্তির কাছে সাভারকরের এই নিঃশর্ত ও সাষ্টাঙ্গ আত্মসমর্পণ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য। বর্তমানে রাজনাথ সিং যে চেষ্টাটা করছেন, সেভাবে ইতিহাস বিকৃত করে সাভারকরের কলঙ্কময় জীবনকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা যাবে না। তিনি নিজেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ এক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন, এটা বাস্তব তথ্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সত্য। তাঁকে মহান হিসাবে দেখানোর চেষ্টা তাই বিফল হতে বাধ্য। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, রাজনাথ সিংয়ের এই প্রচেষ্টা আরএসএস নির্দেশিত পথেই এগিয়েছে। অসত্যকে প্রতিষ্ঠা দেবার যে দায়িত্ব নিয়েছেন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ঠিক সেই দায়িত্বই পালন করছে আরএসএস - সত্য এবং বাস্তব তথ্যকে চাপা দিয়ে অসত্যের চাষ করার মধ্য দিয়ে।
যে অনুষ্ঠানে রাজনাথ সিং এই কথাগুলি বলেছিলেন, তাতে আরএসএস অধ্যক্ষ মোহন ভাগবত নিজেও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে দাবি করলেন, সাভারকর নাকি মুসলিম-বিরোধী ছিলেন না, কারণ তিনি উর্দু ভাষায় গজল লিখেছেন (যেন উর্দু ভাষায় গজল লিখলেই প্রমাণ হয়ে যায় সেই ব্যক্তি মোটেই মুসলিমবিরোধী নন)! আসলে এই কথা বলে সাভারকরের প্রচারিত ‘হিন্দুত্ব’, যার মূল কথাই হলো ধর্মভিত্তিক বিভাজন, তাকে খানিকটা গ্রহণযোগ্য করে নেওয়ার চেষ্টা হলো। উল্লেখ্য, দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা সর্বপ্রথম সামনে আনেন এই সাভারকর। ১৯৩৫ সালে হিন্দু মহাসভার সভাপতি হিসাবে তিনি হিন্দু এবং মুসলিমদের সম্পূর্ণ আলাদা দুই জাতি হিসাবে বর্ণনা করেন। মনে রাখতে হবে, সাভারকরের এই তত্ত্ব ব্রিটিশ সরকারের ‘বিভাজনভিত্তিক শাসন’ (ডিভাইড অ্যান্ড রুল) কায়েম করার ক্ষেত্রে প্রভূত সহায়তা করেছিল।
সাভারকর প্রচারিত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অনুযায়ী ভারতমাতার সন্তান হিসাবে শুধুমাত্র তাঁদেরই গণ্য করা হবে যাঁদের ‘পিতৃভূমি’ এবং ‘পুণ্যভূমি’ এক ও অভিন্নভাবে ভারতবর্ষ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতকে এক হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে মুসলিম এবং খ্রিস্টানরা নাগরিক হিসাবে কার্যত অস্বীকৃত হবেন, কারণ ভারতে জন্ম নিলেও তাঁদের ‘পূণ্যভূমি’ ভারতে অবস্থিত নয়।
এই মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিরাই মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল। আজকের দিনে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা এই আদর্শকেই মহিমান্বিত করার প্রয়াস নিয়েছে। আর এটা করতে গিয়ে বার বার মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হচ্ছে।
(সৌজন্যঃ সংবাদ পোর্টাল এনডিটিভি ডট কম, ১৪.১০.২০২১)