৫৯ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২২ অক্টোবর, ২০২১ / ৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
টাটাকে ‘মহারাজা’ উপহার দিলেন মোদি
অর্ণব ভট্টাচার্য
গত আট তারিখ সকাল থেকেই উচ্ছ্বসিত অধিকাংশ খবরের কাগজ। কেউ বলছেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে, কেউ বলছেন রাজমুকুট আবার হারিয়ে যাওয়া রত্ন ফিরে পেয়েছে। এই এতো আনন্দের কারণ টাটার হাতে এসেছে এয়ার ইন্ডিয়ার মালিকানা। বেসরকারি মালিকের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আসায় উচ্ছ্বসিত কর্পোরেট দুনিয়া। তাই বিজয়ী টাটার স্তুতি চলছে অধিকাংশ সংবাদপত্রের হেডলাইন জুড়ে।
১৯৫৩ সালে ভারতের বিমান পরিষেবা রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন হয়ে যায়। সেসময় এয়ার ইন্ডিয়ার মালিক ছিল টাটা গোষ্ঠী। ১৯৩২ সালে এই বিমান সংস্থার পত্তন করেছিলেন জে আর ডি টাটা। এয়ার ইন্ডিয়ার বিখ্যাত ‘মহারাজা’ লোগো ১৯৪৬ সালে তৈরি করেন ববি কুকা। একথা সত্য যে, দেশের প্রথম বিমান সংস্থার কর্ণধার হিসেবে জে আর ডি টাটা এবং তাঁর গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ভারতের বুনিয়াদি ক্ষেত্রগুলিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রাখবার যে নীতি গৃহীত হয়েছিল তার সাথে সঙ্গতি রেখেই বিমান পরিষেবাকেও সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আটটি বেসরকারি বিমান সংস্থা অধিগ্রহণ করে তৈরি হয় দুটি বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স ও এয়ার ইন্ডিয়া।
ভারতের মতো বিশাল দেশে অসামরিক বিমান যোগাযোগ ও বৈদেশিক বিমান পরিষেবাকে উন্নত করার জন্য বিমান পরিষেবার জাতীয়করণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনীতি নির্মাণের কথা ঘোষণা করা হলেও আসলে জাতীয়করণের প্রধানতম কারণ ছিল এই যে, ভারতের উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণি সেইসময় বুনিয়াদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য যে বিপুল পরিমাণ পুঁজি প্রয়োজন তা জোগাড় করতে অসমর্থ ছিল এবং এই সমস্ত ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগ করার পর মুনাফা পেতে যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় তা করতেও তারা প্রস্তুত ছিল না।
অতএব বুর্জোয়া শ্রেণি নয়, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির বুনিয়াদ তৈরি করেছে এদেশের মানুষ। তাদের করের টাকায় দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠেছে যার উপর এখন উল্লাসনৃত্য করছে কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলি।
কেমন ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার যাত্রাপথ? একথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিমান সংস্থা হয়ে উঠেছিল এয়ার ইন্ডিয়া এবং তার ব্যালেন্স শিটে লাভের অঙ্ক ক্রমশ স্ফীত থেকে স্ফীততর হচ্ছিল। ১৯৬০ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার প্রথম জেট বিমান বোয়িং ৭০৭ কেনা হয়, ১৯৭১ সালে বোয়িং ৭৪৭। দুটি জাতীয় বিমান পরিবহণ সংস্থাই সাফল্যের শীর্ষে উঠতে থাকে। দেশে-বিদেশে তখন ‘মহারাজা’র খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স যাকে অনেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এয়ারলাইন্স বলে তা সত্তরের দশকে এয়ার ইন্ডিয়ার প্রযুক্তিগত ও পরিচালনাগত সহায়তা নিয়ে তৈরি হয়েছিল। ১৯৯১-৯২ আর্থিক বর্ষে যোগী দেবেশ্বর চেয়ারম্যান থাকাকালীন এয়ার ইন্ডিয়া ৩৩৩ কোটি টাকার রেকর্ড মুনাফা করে। আর সে বছরই মনমোহন সিং সংসদে পেশ করেন নয়া-উদার অর্থনীতির ব্লুপ্রিন্ট - ভারত পা বাড়ায় লাগামহীন বেসরকারিকরণ, উদারীকরণ, বিশ্বায়নের পথে।
এয়ার ইন্ডিয়ার সমস্যার সূত্রপাত হয় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে। নেদারল্যান্ডের ক্যারিব জেটকে বিতর্কিত বরাত দেওয়ার মতো ঘটনা হয়তো এখন অনেকেরই স্মৃতিতে নেই; কিন্তু সে সময় এ ধরনের পদক্ষেপ প্রতিযোগিতার বাজারে এয়ার ইন্ডিয়া’র টিকে থাকাকে ক্রমশ কষ্টকর করে দেয়। ইতিমধ্যে বাজারে নেমে পড়েছে কিংফিশার এয়ারলাইন্সের মতো সংস্থা যারা সস্তা দরে বিমানের টিকিট বিক্রি করে অসামরিক বিমান পরিষেবার বাজারে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বেসরকারি বিমান সংস্থাকে সুবিধা পাইয়ে দিতে কার্যত দুর্বল করা হয় রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থাকে। ২০০১ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার প্রথম যখন এয়ার ইন্ডিয়াকে বেসরকারিকরণের চেষ্টা করে তখন এয়ার ইন্ডিয়া আদৌ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়। সে সময় টাটা গোষ্ঠী সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সঙ্গে একত্রে এবং হিন্দুজা গোষ্ঠী এয়ার ইন্ডিয়া কেনবার চেষ্টা করে, কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নগুলোর বাধায় এই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, টাকার অবমূল্যায়ন বিমান পরিষেবার ক্ষেত্রে বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে এয়ার ইন্ডিয়াকে। ২০০৫-০৬সালে ১১১টি বিমান কেনা হয় ৭০হাজার কোটি টাকা খরচ করে যা কিনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে সমালোচনা করে কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল। এয়ার ইন্ডিয়ার বিরাটসংখ্যক বিমানকে লিজ দেওয়া হয় কোনোরকম বিচার বিবেচনা না করেই। এমনকী সুবিধাজনক সময় ও লাভজনক রুটে বিমান পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় বেসরকারি বিমান সংস্থার স্বার্থে। তাহলে কী ধরে নিতে হবে যে, এয়ার ইন্ডিয়াতে অন্তর্ঘাত হয়েছে? ২০০৭ সালে এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সকে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। এই পদক্ষেপকে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ আত্মঘাতী বলে চিহ্নিত করেন। ২০০৭ সালের পর থেকে আর কোনো মুনাফা করেনি এয়ার ইন্ডিয়া।
এয়ার ইন্ডিয়াকে বিক্রি করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো যে যুক্তি সরকারের পক্ষ থেকে দেখানো হচ্ছে তা এই সংস্থার বিপুল ঋণভার। এবার দেখা যাক যে, টাটা কোম্পানি এই ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করেছে। এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রির শর্ত অনুযায়ী টাটা কোম্পানি এই বিপুল ঋণভারের মাত্র ২৫ শতাংশ বহন করছে যার পরিমাণ ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বাকি ৪৬ হাজার ২৩২ কোটি টাকার ভার বহন করছে কেন্দ্রীয় সরকার। এয়ার ইন্ডিয়া কেনবার জন্য টাটা ১৮হাজার কোটি টাকা দর দিয়েছিল। সেখান থেকে ঋণের অঙ্ক বাদ দিলে সরকারের ঘরে সরাসরি আসছে মাত্র ২৭০০ কোটি টাকা অর্থাৎ কার্যত জলের দরে একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানকে বিক্রি করে দিল কেন্দ্রীয় সরকার। বর্তমানে এয়ার ইন্ডিয়ার ঋণের সিংহভাগ তার এয়ারক্রাফট কেনবার সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। মাত্র ২৫ শতাংশ ঋণভার বহন করে টাটা এয়ার ইন্ডিয়ার সমস্ত বিমান নিজের করায়ত্ত করতে পারল। প্রশ্ন ওঠে সরকার যেখানে ৭৫ শতাংশ ঋণভার বহন করতে পারছে সেখানে আর ২৫ শতাংশ ঋণভার বহন করতে পারত না? আসলে সেই বাজপেয়ী সরকারের আমল থেকেই বিজেপি’র মনোভাব এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি করে দেবার। তাই তারা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অনড় থেকেছে।
জেআরডি টাটা বিমান জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত কখনও মানতে পারেননি এবং টাটা গোষ্ঠীর সবসময় বাসনা ছিল যাতে তারা কোনো না কোনোদিন এয়ার ইন্ডিয়ার দখল আবার ফিরে পায়। এই মনস্কামনা পূরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রতন টাটার টুইটে যেখানে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছেন, ‘‘ওয়েলকাম ব্যাক এয়ার ইন্ডিয়া’’। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র যে বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থরক্ষার আর তার সবরকম ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে তা এই সমস্ত সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে। যাঁরা এয়ার ইন্ডিয়া টাটার হাতে ফিরে যাওয়ায় আনন্দে আত্মহারা তাঁরাও স্বীকার করছেন যে, এয়ার ইন্ডিয়ার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যাত্রাপথের ঈর্ষণীয় নেটওয়ার্ক রয়েছে, বিভিন্ন দেশের সাথে মূল্যবান দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আছে আর আছে দেশের মাটিতে বিপুল পরিকাঠামো। লন্ডন-নিউইয়র্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে স্লট আছে এয়ার ইন্ডিয়ার। মালিকানা বদলের সাথে সাথে টাটার হাতে এলো দেশে ৪৪০০টি বিমান অবতরণ ও পার্কিং স্লট, এবং বিদেশে ১৮০০টি অবতরণ ও পার্কিং স্লট। এয়ার ইন্ডিয়া বিমান পরিষেবার সাথে এয়ার কার্গো পরিষেবাতেও যুক্ত। এয়ার ইন্ডিয়ার ১০০ শতাংশ শেয়ার কেনায় তার সহায়ক কার্গো পরিষেবা সংস্থা এবং স্যাটস এয়ারপোর্ট সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের ৫০ শতাংশ শেয়ারের মালিক হচ্ছে টাটা। এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের মালিকানাও এখন তাদের হাতে।
এয়ার ইন্ডিয়াতে যে কর্মচারীরা রয়েছেন তাঁদের আগামী এক বছর চাকরি থেকে ছাঁটাই করা যাবে না এরকম শর্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক বছর পরে কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। এয়ার ইন্ডিয়া বিভিন্ন সময় যে সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করেছে, যেভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজ করেছে সেই সামাজিক দায়বদ্ধতা বেসরকারি বিমান সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া যাবে তো? তার গ্যারান্টি দিতে পারবে দেশের সরকার? এই ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়াতে কেন্দ্রীয় সরকারের একজন অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী থাকবেন, কিন্তু কোনো রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা থাকবে না। আসলে এটাই লক্ষ্য ছিল বুর্জোয়া শ্রেণির। জনগণের করের টাকায় সম্পদ সৃষ্টি হবে, পরিকাঠামো তৈরি হবে, তারপর জলের দরে তা কিনে নেবে কর্পোরেট মালিকরা। সরকার সেখানে বুর্জোয়া শ্রেণির পোষা ভৃত্যের ন্যায় কাজ করবে।
এয়ার ইন্ডিয়াকে কার্যত উপঢৌকন হিসেবে টাটা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া বর্তমান সরকারের মনিটাইজেশন পলিসির অঙ্গ যার লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় সম্পদের ঢালাও বেসরকারিকরণ। এই লাগামছাড়া বেসরকারিকরণের বিপজ্জনক দিকগুলি বামপন্থীরা বরাবর উল্লেখ করেছেন। এমনকি সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন যে, মোদি সরকারের ‘মনিটাইজেশন পলিসি’ বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতি কয়েকটি পরিবার বা শিল্পগোষ্ঠীর (Oligarch) অধীনস্ত হয়ে যাবে যার পরিণতি অত্যন্ত ক্ষতিকারক। রাশিয়াতে সমাজতন্ত্র পতনের পর যেভাবে অর্থনীতি কয়েকটি পরিবার বা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার ফলে অসাম্য এবং অর্থনৈতিক নৈরাজ্য সেখানে ব্যাপক মাথাচাড়া দিয়েছে তেমনটাই ভারতের ক্ষেত্রে ঘটতে চলেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই আমাদের দেশে কর্পোরেট হাঙররা গিলে খাচ্ছে জল-জঙ্গল-জমি-আকাশ। লাগামহীন বেসরকারিকরণ ক্রমশ দেশের মানুষের জন্য বিধ্বংসী চেহারা নিচ্ছে। তাই সরকার যে ভাষা বোঝে সেই ভাষাতেই বুঝিয়ে দিতে হবে যে, পুঁজিপতিদের ইচ্ছে পূরণ নয়, জনগণের স্বার্থরক্ষাই গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের কর্তব্য।