E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ২২ অক্টোবর, ২০২১ / ৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮

অরণ্যে কর্পোরেট আগ্রাসনের পথ খুলে দিচ্ছে অরণ্য সংরক্ষণ আইন (১৯৮০)-এর সংশোধনী

তপন মিশ্র


ধীরে ধীরে অসংরক্ষিত হচ্ছে ভারতের বনাঞ্চল। ২০১৪ সালের পর থেকে বিভিন্নভাবে কর্পোরেটদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে অরণ্যে অনুপ্রবেশের সমস্ত দরজা। মুখে পরিবেশ ও অরণ্য রক্ষার বুলি আর বাস্তবে বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থা ও অরণ্যনীতি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অরণ্য সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণের পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে। এই আইনি পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন হলো - কেন্দ্রীয় সরকারের গত ২ অক্টোবর অরণ্য সংরক্ষণ আইন (১৯৮০)-এর সংশোধনীর প্রস্তাব। এর মূল বক্তব্য হলো, আরও বেশি বেশি করে বনাঞ্চলকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের মধ্যে আনা।

ভারতবাসীদের ইমোশনাল ব্লাকমেলিং

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কয়লার অভাব ঘটিয়ে দেশজুড়ে এক কৃত্রিম বিদ্যুতের সংকট তৈরি করা হয়েছে। আসলে দেশের মানুষকে ইমোশনাল ব্লাকমেল করার ব্যবস্থা করা হয়েছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে। কোল ইন্ডিয়ার তথ্য বলছে, দেশে এবছরের প্রথম ছয় মাসে গত বছরের তুলনায় কয়লার উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ১২ শতাংশ। অবশ্য তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতাও এই সময়কালে বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ শতাংশের মতো। তাই সেখানে উৎপাদন বৃদ্ধির হার অনুযায়ী সমপরিমাণ কয়লার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিসম্প্রতি সরকার ১৯টি কয়লা ব্লক দেশি বিদেশি বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছে। এবার আরও ৪০ টি নতুন কয়লা খনির নিলাম প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এগুলির প্রায় সবই বনাঞ্চলে। ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ‘কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট, ২০১৫’ নামে একটি আইন সংসদে পাশ করায়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, অতীতে ২০৪টি কয়লা ব্লককে নিলাম করার বিরুদ্ধে মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কারণে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল, তা দূর করতে কিছু আইনি পরিবর্তন ঘটিয়ে কয়লা খনিগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া।

দেশের বর্তমান পরিবেশ ও অরণ্য রক্ষা আইন বলবৎ থাকলে এই খনিগুলির যথেচ্ছ খনন ব্যাহত হবে এবং মুনাফায় টান পড়বে। তাই বেসরকারি উদ্যোগে অধিক কয়লা উৎপাদনের অজুহাতে অরণ্য রক্ষা আইন শিথিল করার এক বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টা করছে দেশের সরকার।

আইন পরিবর্তনের প্রথম ধাপ

গত ২ অক্টোবর, গান্ধীজির ১৫২তম জন্মজয়ন্তীতে ভারত সরকার ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট (১৯৮০)-র কিছু সংশোধনীর সুপারিশ করে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। অরণ্য সংবিধানের যৌথ তালিকাভুক্ত হওয়ায় রাজ্য সরকারগুলি এবং সর্বসাধারণের মতামতের জন্য মাত্র ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়। দেশব্যাপী প্রতিবাদের পর মতামতের সময়সীমা আরও ১৫ দিন অর্থাৎ ১ নভেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ভারতে বর্তমানে অরণ্যের পরিমাণ ২১.৬১শতাংশ। বনাঞ্চলের বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদন যুক্ত করলে এই পরিমাণ ২৪ শতাংশের মতো। আমরা দেশে ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ বনাঞ্চল তৈরি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু আলোচনাতে দেওয়া প্রতিশ্রুতি (ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কমিন্টমেন্ট) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে বৃক্ষ আচ্ছাদন বৃদ্ধি করে ২.৫-৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের ব্যবস্থা করা হবে। হিসেব মতো এই পরিমাণ কার্বন শোষণ করতে কমপক্ষে ১০ কোটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষের (বছরে গড়ে বৃক্ষপ্রতি ২৫ কিলো গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের হিসাবে) বনাঞ্চল চাই।

কিন্তু কোথায় কী? দুঃখের বিষয় এই যে, সমস্ত প্রতিশ্রুতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশের অরণ্য সংরক্ষণ আইনের যে সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে তা পুরোপুরি মুনাফালোভী কর্পোরেটদের সাহায্য করার লক্ষ্যে তৈরি। কেবল কয়লা খনি নয়, উন্নয়নের নামে অরণ্যে সংরক্ষণের সমস্ত বাধা তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে।

২০১৪-র পরে সর্বনাশের যে ব্যবস্থা হয়েছে

২০১৪ সালের আগস্টে টি এস আর সুব্রহ্মনিয়ম কমিটি বিজেপি সরকার তৈরি করে এবং নভেম্বরে তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয় যে, দেশের সমস্ত পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের পরিবর্তন করে মাত্র একটি সহজ আইন করতে হবে। এখানেই ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইনের পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়। দেশজুড়ে প্রতিবাদের জন্য এই সুপারিশ সেইসময়ে ধামাচাপা পড়ে যায়।

২০১৮ সালে ১৯৮৮ সালের বননীতি পালটে নতুন এক বননীতি (নিউ ফরেস্ট পলিসি-১৯৮৮) ঘোষণা করে সরকার। এখানে বলাহয় “public-private participation models will be developed for undertaking afforestation and reforestation activities in degraded forest areas and forest areas available with Forest Development Corporations and outside forests.” (4.1.1.d) অরণ্য আমাদের প্রাকৃতিক পুঁজি (natural capital)। এখানে বেসরকারি সহযোগিতা ঔপনিবেশিক সরকারও ঘটায়নি। বনাঞ্চলের কিছু অংশে বেসরকারি পুঁজির অনুপ্রবেশ দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে (জৈব বৈচিত্র্য এবং বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য) বড়ো পরিবর্তন আনতে বাধ্য। স্বাভাবিকভাবে এই নীতিতে অরণ্যে কাষ্ঠল (timber) সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালের বননীতিতে প্রথম বলা হয় যে, অরণ্যের পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব থেকে বেশি প্রাধান্য পাবে।

এই নীতির ৪.১১ ধারায় ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইন (ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট)-কে যৌথ পরিচালন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে খর্ব করার চেষ্টা হয়েছে। বলা হয়েছে “As far as community forest resources management under Forest rights Act is concerned, the new policy will address the same under participatory forest management and the same will be addressed through the proposed community forest management mission.”। ১৯৮০-র দশকের বনবাসীদের উদ্যোগে যৌথ বনপরিচালন আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং ১৯৮৮ সালে সরকারের নয়া বননীতির মধ্যদিয়ে যৌথ বন পরিচালন ব্যবস্থাকে স্বীকার করা হয়। ধারাবাহিকভাবে এই লড়াই ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইনে উত্তরণ ঘটাতে বাধ্য করে। এবারে বনবাসীদের সেই সমস্ত অধিকারকে খর্ব করার চেষ্টা হয়েছে। কারণ হলো, বনবাসীদের অধিকার খর্ব না হলে কর্পোরেটদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে যাবে।

আবার ২০১৯ সালে, ১৯২৭ সালের বন আইন পরিবর্তনের প্রয়াসের মধ্যদিয়ে [ইন্ডিয়ান ফরেস্ট (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০১৯] অরণ্যের বাণিজ্যিকীকরণের প্রক্রিয়াকে আরও প্রশস্ত করার চেষ্টা হয়। এর মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তনের কথা বলা হয় তাহলো - (১) ১৯২৭ সালের আইনে দেশে তিন ধরনের বনাঞ্চলের কথা বলা ছিল। রিজার্ভ ফরেস্ট, প্রোটেক্টেড ফরেস্ট এবং আন ক্লাসড ফরেস্ট। ২০১৯ সালে এর সঙ্গে আর একটি ধরন যোগের প্রস্তাব করা হয়। তা হলো - ‘প্রোডাকশন ফরেস্ট’ অর্থাৎ যেখানে কেবল কাষ্ঠল সম্পদ উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকবে। (২) বনাধিকারিকদের সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে। এমনকী বনবাসীদের সঙ্গে বনাঞ্চলে আতঙ্কবাদীদের মতো আচরণের ক্ষমতাও দেওয়া হয় বনাধিকারিকদের।

১৯৮০ অরণ্য সংরক্ষণ আইনের পরিবর্তনের সুপারিশ

এই সুপারিশের মধ্য দিয়ে প্রথম যে আঘাতটা আসছে তা হলো, ১৯৯৬ সালে মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী অরণ্যের সংজ্ঞায় এক বড়ো পরিবর্তন করা হয় এবং কেবল সরকারি অধিগৃহীত বনাঞ্চল নয় তার বাইরে ব্যক্তি মালিকানায় থাকা ৫ হেক্টরের বেশি বৃক্ষ আচ্ছাদনকেও অরণ্য সংরক্ষণের আওতায় আনার ব্যবস্থা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় আসে “টি এন গোদাভর্মন থিরুমুলাপাদ বনাম ভারত সরকার এবং অন্যান্য” মামলায়। এই মামলার রায়দানের আগে অরণ্যের সংজ্ঞা নিরূপণের জন্য মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে। এরপরও মোদি সরকারের ধৃষ্টতা দেখলে অবাক হতে হয়। এবারের সংশোধনীতে মোদি সরকার বলছে - “Identification of such land is subjective and arbitrary to some extent... Considering any private area as forest would restrict the right of an individual to use his/her own land for any non-forestry activity.” বড়ো বনভূমির মালিককে সরকারি ব্যবস্থাপনার বাইরে রেখে যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া এক অপরাধ ছাড়া আর কী হতে পারে। এবারের সংশোধনীতে এই ধরনের বনভূমিকে বনাঞ্চল সংরক্ষণের বাইরে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, অরণ্যে উন্নয়নমূলক কাজের নামে ব্যাপক ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগের আইন অনুযায়ী অরণ্যের মধ্যে কোনো সরকারি বা বেসরকারি উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে হলে ভারত সরকারের পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের তৈরি বিশেষজ্ঞ কমিটির পরিবেশ রক্ষার কিছু শর্তসাপেক্ষ অনুমতি আবশ্যিক ছিল। প্রস্তাবিত সংশোধনে রেল, সড়ক,পর্যটন, খনি অনুসন্ধান এমনকী পাম তেল চাষের মতো ব্যবস্থাকে এই অনুমতি এবং পরিবেশ রক্ষার শর্ত মানার দায়বদ্ধতা থেকে ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

তৃতীয়ত, ১৯৮০ সালের আইনের 2(iii) ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে রাজ্য সরকারগুলিকে কর্পোরেট সংস্থার আবদার অনুযায়ী কোনো সংরক্ষণের দায়বদ্ধতা ব্যতিরেকে বনাঞ্চলে খনি, কারখানা ইত্যাদির জন্য লিজের অনুমতি প্রদানের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

আইনের দুই বি ধারার পরিবর্তন করে দেশের সমস্ত অরণ্যকে ‘গো’ এবং ‘নো গো’(‘Go’ এবং ‘No-go’) অঞ্চলে ভাগ করার কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো - জৈববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব বিচারে উন্নতমানের বনাঞ্চল হবে ‘নো গো’ অর্থাৎ যা পরিবর্তনযোগ্য নয় এবং বাকি অংশ হবে ‘গো’ অর্থাৎ যেভাবে খুশি ব্যবহার করা যায়। ২০০৯ সাল থেকে এই পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা হচ্ছে। ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্ট, ২০১৯)-র তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ২১ শতাংশ বনাঞ্চলের মধ্যে মাত্র ৯.৩৯ শতাংশ হলো উন্নতমানের ঘনত্বযুক্ত বনাঞ্চল। অর্থাৎ এইটুকু বাদ দিলে যে কোনো অংশে বনভূমির বাণিজ্যিক ব্যবহারের রাস্তা প্রশস্ত করা হচ্ছে।

এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে অরণ্যের বাণিজ্যিক ব্যবহার সুনিশ্চিত করলেও দেশের ৪০ কোটি বনবাসীর অরণ্য অধিকার (যে অধিকার ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইন তাঁদের দিয়েছে)-এর পক্ষে কোনো শব্দ এতে ব্যয় করা হয়নি বরং এর বিরুদ্ধে এক আইনি ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে যে, শত শত বছর ধরে অরণ্যের রক্ষাকর্তা হলেন অরণ্যনির্ভর বনবাসী-আদিবাসী মানুষ। বায়ুমণ্ডলে কার্বন শোষণ, দেশের জৈববৈচিত্র্য রক্ষা ইত্যাদির জন্য অরণ্য সংরক্ষণের কোনো উল্লেখও এই সংশোধনীতে নেই।

এবারের এই বিজ্ঞাপিত সংশোধনীর মধ্য দিয়ে চটজলদি আইন পরিবর্তন করার অভিসন্ধি স্পষ্ট লক্ষণীয়। তাই দেশজুড়ে দাবি উঠেছে, ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইনের সংশোধনী প্রত্যাহার করতে হবে এবং আগামীদিনে দেশে অরণ্য সংরক্ষণ এবং অরণ্যবাসীদের স্বার্থরক্ষার জন্য রাজ্যগুলির এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।