৬১ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ৪ আশ্বিন, ১৪৩০
গণআন্দোলন ও জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে ‘ইন্ডিয়া’কে শক্তিশালী করার আহ্বান পলিট ব্যুরোর
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চরিত্র, সংবিধান এবং দেশবাসীর মৌলিক অধিকারগুলিকে সুরক্ষিত রাখতে বিরোধীদের মঞ্চ ইন্ডিয়াকে আরও সুসংগঠিত ও সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেবে সিপিআই(এম)। ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত পার্টির পলিট ব্যুরোর বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই মঞ্চের ডাকে সারা দেশে জনসভা সংগঠিত করার উপরেও জোর দিয়েছে পলিট ব্যুরো, যাতে আগামী নির্বাচনগুলিতে বিজেপি’র পরাজয়কে সুনিশ্চিত করতে বেশি বেশি মানুষকে সমবেত করা যায়। বৈঠকে এই সঙ্গেই ‘এক দেশ এক নির্বাচন’-এর ভাবনা এবং দেশের প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে প্রস্তাবিত নতুন ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছে। ত্রিপুরায় উপনির্বাচনে বিজেপি’র সন্ত্রাসের কড়া নিন্দাও করেছে পলিট ব্যুরো। ১৭ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্তগুলিকে জানানো হয়েছে পলিট ব্যুরোর তরফে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অক্টোবরের ২৭ থেকে ২৯ তারিখ বৈঠক হবে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির।
বিজেপি-বিরোধী মঞ্চ ইন্ডিয়া
পলিট ব্যুরোর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চরিত্র, সংবিধান, গণতন্ত্র, জনগণের মৌলিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতা থেকে বিজেপি-কে দূরে রাখতেই হবে। তাই বিজেপি-বিরোধী মঞ্চ ইন্ডিয়াকে আরও সুসংগঠিত ও সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে কাজ করবে সিপিআই(এম)। আগামী নির্বাচনগুলিতে বিজেপি-কে পরাস্ত করার জন্য এই মঞ্চের তরফে দেশ জুড়ে পরপর জনসভা সংগঠিত করতে হবে মানুষকে সমবেত করার জন্য। পাটনা, বেঙ্গালুরু ও মুম্বাইয়ের বৈঠকে সিপিআই(এম) সেই কথাই বলেছে। বিরোধীদের মঞ্চ ইন্ডিয়াকে আরও প্রসারিত করার উদ্যোগে জোর দিতে হবে, সেই সঙ্গেই এই উদ্যোগে শামিল করতে হবে জনগণের আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ অংশকে। সিপিআই(এম)’র অবস্থান হলো, এই মঞ্চের শরিক দলগুলির নেতৃবৃন্দই সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। এই মঞ্চের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো থাকা উচিত নয়, তা এমন সিদ্ধান্তের পথে বাধা তৈরি করবে।
এক দেশ এক নির্বাচন
পলিট ব্যুরো বলেছে, দেশের সংবিধানে যে সংসদীয় গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, এক দেশ এক নির্বাচন-এর ভাবনা তার উপরে আক্রমণ। মোদি সরকার ইতিমধ্যে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে এই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য। লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন একসঙ্গে করার জন্য কীভাবে এগোনো যায়, তার সুপারিশ করতে বলা হয়েছে এই কমিটিকে। এর জন্য সংবিধানকে তো তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় সংশোধন করতে হবেই, সেই সঙ্গে এই প্রস্তাব রাজ্য বিধানসভাগুলির মেয়াদকে হয় কাটছাঁট করার বা বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে, যাতে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে একই সময়ে সেগুলির নির্বাচন করা যায়। কিন্তু বিধানসভায় একটি সরকার যখন গরিষ্ঠতা হারায়, তখন সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকা বেআইনি। আবার তখন সংশ্লিষ্ট রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন বা কেন্দ্রীয় শাসন জারি করে রাজ্যবাসীকে নতুন সরকার নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে তা হবে অগণতান্ত্রিক। সিপিআই(এম) এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধী।
নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ
পলিট ব্যুরোর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইন তৈরির জন্য মোদি সরকার একটি খসড়া বিল বণ্টন করেছে। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়কে নস্যাৎ করা হয়েছে তাতে। ওই রায়ে বলা হয়েছিল, দেশের প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এবং ভারতের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত একটি কমিটিরই বেছে নেওয়া উচিত মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনারদের। সংসদের বিশেষ অধিবেশনে যে খসড়া বিল বিবেচনা করা হবে, সেখানে ভারতের প্রধান বিচারপতির জায়গায় প্রধানমন্ত্রী মনোনীত এক জন কেন্দ্রীয় পূর্ণমন্ত্রীকে নিয়ে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্য সুনিশ্চিত হবে। তা হবে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করার যে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের, তা এর ফলে ক্ষুণ্ণ হবে।
ত্রিপুরায় গণতন্ত্রের নিধন
গত ৫ সেপ্টেম্বর ত্রিপুরা বিধানসভার দু’টি আসনে উপনির্বাচনে রাজ্যের শাসকদল বিজেপি যেভাবে রিগিং করেছে, পলিট ব্যুরো তার নিন্দা করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উপনির্বাচনে ত্রিপুরায় ব্যাপক সন্ত্রাস চালিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে শাসক বিজেপি। ওই উপনির্বাচনে রাজ্য সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সন্ত্রাসের এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। পুরোপুরি লুট করা হয়েছে ভোট। এই দুই উপনির্বাচন বাতিল করে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ফের ভোটের ব্যবস্থা করা উচিত।
জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হামলা
পলিট ব্যুরোর বিবৃতিতে জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগে অপারেশন গাড়লে সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে নিহত তিন নিরাপত্তা আধিকারিকের বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। ওই অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন কর্নেল মনপ্রীত সিং, মেজর আশিস ধোনচাক এবং পুলিশের ডেপুটি সুপার হুমায়ুন মুজাম্মিল ভাট। তবে একইসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কাশ্মীরে শান্তি ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠার যে দাবি মোদি সরকার করে থাকে, এই ঘটনায় তার অন্তঃসারশূন্যতা সম্পূর্ণ ধরা পড়ে গিয়েছে।
আদানির কেলেঙ্কারি
পলিট ব্যুরো বলেছে, অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রোজেক্ট-এর তথ্যের ভিত্তিতে দু’টি সংবাদ মাধ্যম দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস এবং দ্য গার্ডিয়ান ফাঁস করে দিয়েছে, কীভাবে বিনোদ আদানির দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী বারমুডার একটি লগ্নি তহবিলকে ব্যবহার করে এবং শিখণ্ডী কোম্পানি তৈরি করে লক্ষ লক্ষ ডলার দিয়ে আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন। এক্ষেত্রে শেয়ার বাজারের যাবতীয় নিয়মকানুনকে সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ভারতের শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি ২০১৪ সালে আদানি গোষ্ঠীর বৈদেশিক লেনদেন খতিয়ে দেখা শুরু করেছিল। তবে কিছু দিনের মধ্যেই সেই তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ারের দামে কারচুপির এই যে নতুন তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে, তা বিষয়টি নিয়ে গভীর তদন্তের প্রয়োজনীয়তাকে নির্দেশ করছে। সুপ্রিম কোর্টের নজরে আগেই এসেছে বিষয়টি। তদন্ত যেন ধামাচাপা দেওয়া না হয়, সুপ্রিম কোর্টকে তা সুনিশ্চিত করতে হবে।