৬১ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ৪ আশ্বিন, ১৪৩০
দেশজোড়া কৃষি সংকটের প্রেক্ষিতে কলকাতায় বিশাল কৃষক সমাবেশ
দাবি আদায়ে রাজভবন অভিযান ২৬ নভেম্বর
রানি রাসমণি রোডে কৃষক সমাবেশে বলছেন সর্বভারতীয় কৃষক নেতা অশোক ধাওয়ালে।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দেশজোড়া কৃষি সংকটে চরম বিপন্ন কৃষক। কেন্দ্রের মোদি সরকার তার প্রতিশ্রুতি না রেখে দাসত্ব করছে করপোরেটের। এ রাজ্যে তার দোসর মমতা ব্যানার্জির সরকার। আন্দোলনের ঢেউয়ে এই দুই সরকারকে বাধ্য করা হবে কৃষকদের দাবি মানতে। পঞ্চায়েতে এরাজ্যে কৃষকদের রায়ের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেনি, লোকসভায় তাই পরাস্ত করতে হবে এই দুই সরকারকে। ১৯ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভার ডাকে কলকাতার রানি রাসমণি রোডের সুবিশাল কৃষক সমাবেশে একথা বলেন কৃষক নেতৃবৃন্দ। এদিন প্রবল বৃষ্টির মধ্যে হাজারো মানুষের অনড় উপস্থিতিতে সভায় আন্দোলনের আগামী কর্মসূচি হিসেবে ২৬ থেকে ২৮ নভেম্বর সারাদেশের ৩০টি রাজ্যে রাজভবন অভিযানের ডাক দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গে রাজভবন ঘেরাও হবে আগামী ২৬ নভেম্বর।
এই প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন সারা ভারত কৃষক সভার সভাপতি অশোক ধাওয়ালে, সহ সভাপতি হান্নান মোল্লা, সম্পাদক বিজু কৃষ্ণান এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভার সম্পাদক অমল হালদার। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি বিপ্লব মজুমদার।
বর্গাপাট্টা রায়তি অধিকার রক্ষা, ধান পাট আলু সহ সব ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, অবিলম্বে ১০০ দিনের কাজ চালু করা, সততা ও স্বচ্ছতার সাথে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ এবং নদী ভাঙ্গন রোধের দাবিতে এবং সারে ভেজাল ও চড়া দাম, বিদ্যুতে স্মার্ট মিটার চালু, সমবায়-কে ধ্বংস করে চড়া মহাজনি সুদের নয়া প্রথা চালুর প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভা এই সমাবেশের ডাক দেয়।
এদিনের সভায় রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষক সভার কর্মীরা ধর্মতলায় আসেন ট্রেনে এবং বাসে চেপে। প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তাঁদের বাড়তে থাকা ভিড় একসময় গোটা রানি রাসমণি রোডের পুরোটারই দখল নিয়ে নেয়।
উত্তরবঙ্গ এবং দূরবর্তী জেলাগুলি থেকে সারারাত ট্রেনে চেপে এসে হাওড়া এবং শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছেছেন অনেকেই। হাওড়ার রেল মিউজিয়ামের সামনে থেকে শুরু হওয়া মিছিল হাওড়া ব্রিজ টি বোর্ড হয়ে রানি রাসমণি রোডের সমাবেশে যোগ দেয়। স্লোগানে সোচ্চার অন্য মিছিলটি আসে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে।
হাওড়া স্টেশন থেকে সমাবেশ অভিমুখে কৃষকদের মিছিল।
ধর্মতলার এই সমাবেশে দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক হান্নান মোল্লা বলেন, কেন্দ্র এবং রাজ্যের কৃষিনীতির ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত। সরকার কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমানো, ফসলের লাভজনক দাম দেওয়ায় কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছে না, বরং তারা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। গোটা দেশের সামনে বিজেপি’র কৃষক-শ্রমিক বিরোধী চরিত্র তুলে ধরতে হবে। দিল্লি ঘেরাও হয়েছিল, এবার ভারত ঘেরাও হবে। মোদি অপরাজেয়, এই মিথ ভেঙেছেন দেশের কৃষকরা। তিন কৃষি আইন বাতিল করতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। বাজারের ব্যবস্থা, গোডাউনের ব্যবস্থা করা, উৎপাদন খরচ কমানো, কৃষককের কৃষি উৎপাদনকে লাভজনক করা- কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে এগুলো করতে হবে।
হান্নান মোল্লা বলেন, কৃষকদের আন্দোলনের ফসল হচ্ছে ১০০ দিনের কাজ। আজ সেটাও তুলে দিতে চাইছে। সরকার চাইছে কৃষকের হাত থেকে কৃষি কেড়ে করপোরেটের হাতে তুলে দিতে। সরকার আইন আনুক। ফসলের ন্যূনতম দাম বেঁধে দিক। তার থেকে কম দামে কৃষকের থেকে ফসল না কিনলে কৃষক বাঁচবে না। ফসলের দেড়গুণ দাম সুনিশ্চিত করতে হবে। আর পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার কৃষি আত্মহত্যা আড়াল করতে মিথ্যা কথা বলে। বলে পারিবারিক বিবাদে চাষি আত্মহত্যা করে। ২৬ নভেম্বর ব্যাপক জমায়েত করতে হবে। আঘাত এলে প্রত্যাঘাত করার লক্ষ্য নিয়ে সেদিন রাস্তার লড়াই হবে।
সমাবেশে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিজু কৃষ্ণান বলেন, কৃষি সংকট চলছে দেশজুড়ে। সঙ্ঘ পরিবার সংকট মোকাবিলা না করে মেরঠ, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা - দেশজুড়ে দাঙ্গা ছড়াচ্ছে। ত্রিশুল নিয়ে মিছিল করলে কৃষক আত্মহত্যা বন্ধ হবে কী করে?
তিনি বলেন, এই বাংলায় কৃষকদের অন্তত আত্মহত্যা করতে হতো না আগে, সেটাও গত দশবছর ধরে ঘটছে। তিনি বলেন, ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ওপরে কেরালার বাম গণতান্ত্রিক সরকার অতিরিক্ত ৮০০ টাকা ভরতুকি দিয়ে প্রতি কুইন্টাল ২৮৫০ টাকায় কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন এভাবে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না? ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তো দূরের কথা, এরাজ্যের কৃষকদের ১২০০- ১৩০০ টাকায় ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। মোদি এবং মমতা ব্যানার্জি এরকমই নির্মম, সরকারের কোনো মমতা নেই কৃষকদের প্রতি।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, মোদি সরকার কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তার কী হলো? কৃষক আত্মহত্যা করছে কেন তাহলে? ২০১৪-২০২৩ পর্যন্ত দেশে ১ লক্ষ কৃষক এবং ৩ লক্ষ খেতমজুর আত্মহত্যা করেছেন। পশ্চিমবাংলার শুধু বর্ধমানে ১৪৭ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। মাত্র ১ জেলায় এটা হলে বাকি জায়গায় কী অবস্থা ভেবে দেখুন। অথচ সরকার ক্ষতিপূরণ দেয়নি ১৪৬টি পরিবারকে। কৃষক-শ্রমিক ঐক্য গড়ে উঠছে দেশে। ২৬, ২৭ এবং ২৮ নভেম্বর রাজভবন অভিযানে লক্ষ লক্ষ কৃষকের জমায়েত হবে। আন্দোলনের ঢেউয়ে কৃষকদের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করা হবে।
রাজভবন অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়ার ডাক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষকসভার সম্পাদক অমল হালদার বলেন, রাজ্যে কৃষকদের নিজের জমি অন্য নামে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। বর্গা যদি অন্যের নামে চলে যায় তাহলে গ্রাম গঞ্জে ভয়াবহ অবস্থা হবে। এই জমিচুরির দুর্নীতি সরকারি অফিসে বসেই করছে তৃণমূল। সমবায়ে দুর্নীতি। ঋণ পাচ্ছেন না গরিব কৃষক। মাইক্রো ফাইনান্স কৃষিক্ষেত্রকে ধ্বংস করছে। ১০০ দিনের কাজ নেই। স্মার্ট মিটার কৃষককে সর্বস্বান্ত করবে। স্মার্ট মিটার আমরা লাগাতে দেব না। ভেজাল সারে বাজার ছেয়ে গিয়েছে। পেঁয়াজ চাষিদের অবস্থা চোখে দেখা যাচ্ছে না, গত বছর দাম মেলেনি। সরকার চুপ। গ্রামে কাজ নেই। কাজ খুজতে রাজ্যের বাইরে যাচ্ছে গ্রামের জোয়ান ছেলেরা। আর লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে। মমতা ব্যানার্জি, আপনি এর জবাব দেবেন না? আপনি অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়িত হয়নি। জবাব দিতে হবে এই সব প্রশ্নের।
তিনি জুট কর্পোরেশনের অফিস ঘেরাওয়ের ডাক দিয়ে বলেন, কৃষক ভালো নেই। সেচ নেই। জল নেই। সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে পাট পচাতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ধানে পোকা লেগেছে। আলুর দাম নেই। লোকসানে চলছে। হেক্টরের পর হেক্টর জমি গিলছে নদী। দুই সরকার নীরব। কোনও ভূমিকা নেই। মানুষ কাঁদছে। সরকার আর কবে নদীতে বাঁধ দেবে? শালি জমি নষ্ট হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা তলানিতে যাবে। শুধু ডেপুটেশনে হবে না। পথে নামতে হবে। পঞ্চায়েতে আমাদের কৃষকদের রায়কে পায়ের তলায় পিষেছে। লোকসভায় পঞ্চায়েতের জবাব দিতে হবে।
সারা ভারত কৃষকসভার সভাপতি অশোক ধাওয়ালে বলেন, ৭৭ সাল থেকে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার এ রাজ্যে ১৩ লক্ষ একর জমি গরিব দলিত আদিবাসী সংখ্যালঘু সব অংশের মানুষের মধ্যে বণ্টন করেছিলেন। আর এখন মমতা ব্যানার্জির রাজত্বে ডিজিটাইজেশনের নাম করে গরিব মানুষের নাম জমির রেকর্ড থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাঁকুড়া জেলায় এই ঘটনা নজরে এসেছে। এই রাজ্যের সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত। মমতা ব্যানার্জিকে কখনো কেউ আরএসএস’র সমালোচনা করতে শোনেনি কারণ, দিল্লিতে ওর দুই ভাই রয়েছেন- নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ। নাগপুরে রয়েছেন আর এক ভাই মোহন ভাগবত, যিনি পশ্চিমবঙ্গে এলে মমতা ব্যানার্জি তাঁকে উপহার পাঠান। তাঁর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জি একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও তাই সিবিআই-ইডি তাঁকে গ্রেপ্তার করে না। অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জি বহু প্রতিশ্রুতি কৃষকদের দিলেও তার একটিও পূরণ করেননি। আলুর দাম কুইন্টাল পিছু না বাড়িয়ে ফড়েদের হাতে কৃষকদের ঠেলে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, তেভাগার ঐতিহ্য গোটা দেশের সম্পদ। তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সামনে লোকসভা নির্বাচন। দেশ বাঁচানোর লড়াই। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র যুব, মহিলাদের পাশাপাশি লড়াই চালাবেন কৃষকরা। তৃণমূল বিজেপি-কে রাজ্য থেকে উৎখাত করতে হবে। ফের গোটা পশ্চিমবঙ্গে লাল ঝান্ডা উড়বে।
রাজ্য-কেন্দ্রের সরকারের তীব্র শোষণ-নিপীড়নে জর্জরিত ও প্রতারিত কৃষক। কেন্দ্রের করপোরেটের বন্ধু ও স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। রাজ্যে তাদের সহযোগীদের পরাস্ত করতে হবে। ১৮ সেপ্টেম্বর ধর্মতলায় জনসভা থেকে এই আহ্বান জানিয়েছেন সভার সভাপতি বিপ্লব মজুমদার।