E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ৪ আশ্বিন, ১৪৩০

প্রয়াত কমরেড কানাইলাল ব্যানার্জি


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ প্রয়াত হলেন প্রবীণ শ্রমিক নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামী, সিপিআই (এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্য কমরেড কানাইলাল ব্যানার্জি। তিনি সিআইটিইউ’র অন্যতম প্রাক্তন সম্পাদক ছিলেন। ১৪ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ বিজয়গড়ে তাঁর বাড়িতে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বার্ধক্যজনিত রোগে তিনি ভুগছিলেন। বয়স হয়েছিল ৯৭বছর। তিনি অকৃতদার ছিলেন।

কমরেড কানাই ব্যানার্জির জীবনাবসানে গভীর শোক জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সিআইটিইউ সর্বভারতীয় সম্পাদকমণ্ডলী। সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো শোকবার্তায় বলেছে, কমরেড কানাই ব্যানার্জি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন এবং ছাত্রাবস্থাতেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন। পরে একজন রেলের কর্মী হিসেবে তিনি যুক্ত হয়ে রেলশ্রমিক আন্দোলনে আজীবন অবদান রেখে গেছেন। একই সঙ্গে সিআইটিইউ’র কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে সারাদেশের শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলায় ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। দর্শন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। পলিট ব্যুরো তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।

সিআইটিইউ সর্বভারতীয় সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে এদিন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তপন সেন গভীর শোক জানিয়ে এক বার্তায় বলেছেন, সি‌আইটিউ’র সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে কমরেড কানাই ব্যানার্জি বিভিন্ন ক্ষেত্র ও রাজ্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে শ্রমজীবী নারীদের নিয়ে আসার বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দিতেন। সিআইটিইউ লাইব্রেরি তৈরি করতেও তিনি ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। নয়া-উদারবাদকে মতাদর্শগতভাবে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সিআইটিইউ’র একজন সামনের সারির নেতা। সিআইটিইউ’র সংগঠন সম্পর্কে গৃহীত ঐতিহাসিক ভুবনেশ্বর দলিল রচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুতে মতাদর্শগতভাবে লড়াইয়ের একজন প্রথম সারির যোদ্ধাকে আমরা হারালাম। সিআইটিইউ গভীর শ্রদ্ধা ও শোক জানাচ্ছে এই বিপ্লবী নেতার জীবনাবসানে এবং তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।

১৫ সেপ্টেম্বর সকালে প্রয়াত নেতার বাসভবন থেকে মরদেহবাহী শকট প্রথমে নিয়ে আসা হয় সিআইটিইউ রাজ্য দপ্তর শ্রমিক ভবনে। এখানে শ্রদ্ধা জানানোর পরে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে। এখানে মরদেহ রক্ত পতাকা দিয়ে আচ্ছাদিত করেন প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা বিমান বসু ও পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব, আভাস রায়চৌধুরি, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কল্লোল মজুমদার, রাজ্য কমিটির সদস্য রত্না দত্ত, কনীনিকা ঘোষ, সুদীপ সেনগুপ্ত, শতরূপ ঘোষ, পার্টিনেতা দেবেশ দাস, কৌস্তভ চ্যাটার্জি, ডাঃ সত্যজিৎ চক্রবর্তী, প্রয়াত নেতার বোন কণিকা গাঙ্গুলি সহ আরও অনেকেই। এখানে মরদেহ শায়িত ছিল বেলা একটা পর্যন্ত। তারপরে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই তাঁর মরদেহ পরিবারের পক্ষে দান করা হয়।

সিআইটিইউ দপ্তরেও মরদেহ রক্ত পতাকায় ঢেকে দেওয়া হয়। এখানে শ্রদ্ধা জানান সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি সুভাষ মুখার্জি, সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু। শ্রদ্ধা জানান প্রশান্ত নন্দীচৌধুরী, জীবন সাহা, দেবাশিস রায়, সুব্রত দত্ত সহ আরও অনেকেই।


সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ ১৯২৬ সালের ১০ অক্টোবর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ঢাকা বিক্রমপুরের রানি মণ্ডল গ্রামে কমরেড কানাই ব্যানার্জির জন্ম। কিশোর বয়সেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। কমিউনিস্ট আন্দোলনেও ছাত্রাবস্থাতেই যুক্ত হন। ১৯৩৯ সালে ঢাকাতে সুভাষ চন্দ্র বসুর একটি সভায় যোগ দেওয়ার স্মৃতির কথা তিনি প্রায়শই বলতেন সহকর্মীদের। ছাত্র ফেডারেশনের একজন কর্মী হিসেবে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। মন্বন্তরের সময় ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মোকাবিলায় জনসাধারণকে খাদ্য আন্দোলনে সংগঠিত করার কাজে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায় তাঁকে জেলা থেকে বহিষ্কার করে ব্রিটিশ সরকার। তিনি কোচবিহারে এসে কলেজে ভরতি হন এবং সেখানেও ছাত্র আন্দোলন শুরু করেন। কোচবিহার থেকেও তাঁকে বহিষ্কার করা হলে প্রবল বিক্ষোভে ব্রিটিশ সরকার তাঁর ওপর বহিষ্কারের আদেশনামা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। চল্লিশের দশক তিনি বিড়ি শ্রমিক, দরজি, ধোপা সহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। এই সময় তিনি এই অংশের শ্রমজীবীদের নিয়ে সমবায়ও গড়ে তুলেছিলেন। কলকাতায় আসার পর তিনি ছাত্র ফেডারেশনের সাথে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন।

দেশ বিভাজনের পর তাঁদের পরিবারও কলকাতায় চলে আসে। তিনি এই সময় রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে তিনি রেলের একজন কর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেন। দীর্ঘদিন তিনি অল ইন্ডিয়া রেলওয়েমেনস্‌ ফেডারেশন (এআইআরএফ)’র নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৭৪ সালে ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।

১৯৮৪ সালে প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা ও শ্রমিক আন্দোলনের নেতা কমরেড বিটি রণদিভের অনুরোধে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সি‌আইটিইউ কেন্দ্রে যোগ দেন এবং শ্রমিক আন্দোলনের একজন সর্বসময়ের কর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ১৯৮৯ সালে তিনি সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় পদাধিকারী নির্বাচিত হন এবং ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর তিনি সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে বসবাস শুরু করেন।

কমরেড কানাই ব্যানার্জি ২০০৮ সাল পর্যন্ত সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। দর্শন, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান পাঠক এবং আদর্শ শিক্ষক। ভারতীয় দর্শন ও প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান থাকায় হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে মোকাবিলা করা এবং সমস্তরকম বিচ্যুতি থেকে কর্মীদের সচেতন করার প্রশ্নে তিনি ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি খুবই সহজ-সরল সাধারণ জীবনযাপন করতেন।