৬১ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ৪ আশ্বিন, ১৪৩০
রেল এবং রেল হকার
অলকেশ দাস
কাটোয়া রেল স্টেশনে রেল হকার ও রেল ঠিকাশ্রমিকদের যৌথ সভা।
রেল হকারঃ শিকড়ের সন্ধানে
আমাদের রাজ্যে যারা রেলস্টেশনে এবং ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে রেল যাত্রী এবং নিত্যযাত্রীদের পরিষেবা-চাহিদা পূরণ করে তারা রেল হকার বলে চিহ্নিত। রেল হকারির ইতিহাসের সঙ্গে দেশভাগের প্রশ্নটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আকস্মিক দেশভাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পরিণতিতে অসংখ্য উদ্বাস্তু মানুষ এ বাংলায় আছড়ে পড়েছিল। তারা তখন শরণার্থী। ক্যাম্পগুলোতে উপচে পড়া লোক। খাবার নেই, চিকিৎসা নেই, পরিকাঠামো নেই। নিজেরাই তখন খুঁজে বার করেছিল থাকার জায়গা। খাস জমি, কর্দমাক্ত জলাশয়ের ধার,পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি কিংবা রেলস্টেশনের উঁচু জায়গা। রেল স্টেশনেই যাত্রীদের কাছে তাদের চাহিদার জিনিস বিক্রির হাতেখড়ি। ট্রেনের এক কামরা থেকে আরেক কামরা হাঁপিয়ে জিরিয়ে গ্রীষ্মের দাপানো দুপুর বা কোঁচকানো শীতের বিকেলে এক যাত্রী থেকে আর এক যাত্রীর কাছে পণ্য ফেরি করা। খাবার জিনিস তো আছেই সঙ্গে মেয়েদের ব্রতকথা, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, বিষহরি তেল, দাদের মলম ইত্যাদি। সাধারণভাবে রেল হকাররা পরিশ্রম করে আট ঘণ্টারও অনেক বেশি। সঙ্গে জীবনের ঝুঁকি, রেল পুলিশের ভয়, অত্যাচার এবং যাবতীয় অসম্মান। এদের রোজগার সাধারণভাবে দিনে ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। এদের ৩৯ শতাংশের মূলধন ৫০০ টাকার নিচে। নিজের পুঁজি থাকলে এরা রেল হকারি করত না। বিকল্প পথ খুঁজতো। এই হকারদের মধ্যে এক অংশ বংশপরম্পরায় রেল হকারিতে যুক্ত। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যে ছিন্নমূল মানুষ ‘রিফিউজি’ হয়ে এ বাংলায় এলো তাদেরও এক অংশ গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য রেল হকারিকে জাপটে ধরেছিল।
রেল হকারঃ কী কাজে লাগে?
রেল ছিল পরিষেবার। ইন্ডিয়ান রেল। ভারতের রেল। ভারতের জনগণের রেল। নয়া উদার অর্থনীতিতে সেই রেল থেকে পরিষেবা আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে। এখন তা মুনাফার রেল। সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে এখন তা বেসরকারি পথে ছুটছে। না, দৌড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে রেলে ১০০ শতাংশ বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের কথা কার্যকর হচ্ছে। সরকার যখন রেল যাত্রীদের কথা ভাবেনি তখন রেল হকাররা যাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সকালের চা থেকে শুরু করে বিস্কুট, বাদাম,ফল, জলের বোতল যাত্রীদের কাছে সরবরাহ মানে বিক্রি করার দায়িত্ব রেল হকারেরাই তুলে নেয়। তাই রেল হকাররা শুধু যাত্রীদের পণ্য বিক্রি করে না, পরিষেবা দেয়। যান্ত্রিক ত্রুটি বা বিভিন্ন কারণে ট্রেন যখন অনেক সময় দাঁড়িয়ে যায় এক জায়গায়, তখন রেল হকাররাই খাবার বা অন্যান্য সামগ্রী যাত্রীদের সরবরাহ করে। মানসিকভাবে তাদের স্বস্তি দেয়। এছাড়াও স্টেশনে এবং ট্রেনের কামরায় রেল হকাররা যাত্রীদের এক ধরনের সুরক্ষা বলয়।
বেশিরভাগ রেল হকারদের হাতে সরকারি কাগজ নেই। পরিচয়ের সংকট। সেই সূত্র ধরেই তাদের তাড়া খেতে হয় রেল পুলিশের। কিন্তু সাধারণ যাত্রীরা জানে গুণমানে ভালো এবং সস্তা দামে খাবার বা পণ্য পাওয়া যায় রেল হকারদের কাছ থেকেই। নিত্যযাত্রীরা তাই বাড়ির জন্য তাদের পছন্দের জিনিস রেল হকারদের থেকেই কেনে। প্রতিমুহূর্তে চলমান যাত্রী যোগাযোগ, এছাড়া নিজেরাও গতিশীল হওয়ার কারণে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্নরকম ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আলাপ-আলোচনায় যুক্ত হয় রেল হকারেরা। তাদের দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই, পণ্য বিক্রি করার জন্য তৈরি হয়ে যাওয়া এক বাকপটুতা, নিত্যযাত্রী তথা ক্রেতাদের সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক - ইত্যাদির কারণে রেল হকারদের প্রতি এক সহানুভূতির বোধ তৈরি হয় যাত্রীদের মধ্যে।
রেল হকারঃ বৈধ না অবৈধ?
‘দি রেলওয়েজ অ্যাক্ট ১৯৮৯’-তে যে ১৪৪ ধারা যুক্ত আছে সেই অনুযায়ী ট্রেনের কামরায় মাল বিক্রি, তার জন্য প্রচার করার কারণে কোনো ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ এক বছর অবধি জেল, ২ হাজার টাকা পর্যন্ত ফাইন করার সুযোগ আছে। প্রয়োজনে দুই শাস্তি একই সঙ্গে হতে পারে। ২০০৩-এ দ্বিতীয়বার রেলওয়ে অ্যাক্ট সংশোধনের পর আরপিএফ-এর হাতে একগাদা ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। সেই ক্ষমতায় এখন রেল হকারদের জীবন দুর্বিষহ। কথায় কথায় ফাইন, সে ফাইনেও অদ্ভুত ধারা। প্লাটফর্মে পণ্য বিক্রি করা হকারকে ফাইন করা হয় মহিলা কামরায় ওঠার দায়ে (১৬২ ধারা) বা লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার জন্য। পুলিশ বোঝাপড়া করতে চায় রেল হকারদের সঙ্গে। সারা মাসে নির্দিষ্ট সংখ্যক ফাইনের টাকা দাও পুলিশকে। তাহলে ঝুট ঝামেলা করবে না রেল পুলিশ। সরকারি আইনের বাইরেও রেল হকারদের বেসরকারি ফাইনের মুখোমুখি হতে হয় পুলিশ প্রশাসনের থেকে।
১৯৮৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক মামলায় (সাধন সিং ভার্সেস এনডিএমসি) একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দেয়। রায়ে উল্লেখ করা হয় যে, প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনধারণের জন্য আয় করা তার মৌলিক অধিকার। কারণ এটা তার বেঁচে থাকার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। রেল হকারেরাও রেল কর্তৃপক্ষকে ফি দেওয়ার মাধ্যমে বৈধভাবে সরকারি স্বীকৃতি সহ পেশাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সেই জন্যই রেল লাইসেন্সের দাবি রেল হকারেরা করেছে। এক সময়ের রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব প্রায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় রেলওয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বাসুদেব আচারিয়া। কিন্তু তারপরে রাজ্য থেকে তিনজন রেলমন্ত্রী হওয়ার পরেও তারা রেল হকারদের এই দাবির প্রতি কর্ণপাত করেননি। তার পরেও তৃণমূলের এই মন্ত্রীদের দলীয় রেল হকারদের সংগঠনে কীভাবে তাদের নেতারা যান এবং বক্তব্য রাখেন এটাই রহস্যের। ভারতের সংবিধানের ১৯ (১) (জি) ধারায় প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিককে যেকোনো পেশা বা যে কোনো জীবনধারণের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছে। এই পথের অনুসারী হয়েই পথ হকারদের জীবিকাকে স্বীকৃতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আইনসভায় প্রণয়ন হয়েছে স্ট্রিট ভেন্ডারস (প্রোটেকশন অফ লাইভলিহুড অ্যান্ড রেগুলেশন অফ স্ট্রিট ভ্যান্ডারিং) অ্যাক্ট ২০১৪। এই আইনে দেশের সকল স্ট্রিট ভেন্ডারদের যাদের বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ ঘোষণা করেছিল তাদের পেশার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। অর্থাৎ তাদের পেশার বৈধকরণের পথ প্রশস্ত করেছে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার।
রেল হকারদের জীবনযাপনের পেশার সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে লাইসেন্স প্রদান করার দাবি রেল হকারদের প্রথম দাবি। রেল স্টেশনের উন্নয়নের জন্য যদি কোনো হকার উচ্ছেদ করতে হয় তবে তাকে উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। লাইসেন্স িরনিউ করার সময় প্রয়োজনে রেল হকারেরা এফিডেফিট করে জানাবে যে, তার পরিবার এই ব্যবসার উপরই নির্ভরশীল। যে স্থানে রেল হকার তার মাল বিক্রি করে সেই স্থান পরিষ্কার রাখার দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট রেল হকার নেবে। রেল হকারদের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের অধীনে আনতে হবে এবং এদের ই এস আই, পিএফ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
যে আক্রমণের শিকার রেল হকারেরা
রেলকে সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণের পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় সরকার। ইতিমধ্যে ১৫১ ট্রেন বেসরকারি হাতে পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। আগে রেলের পৃথক বাজেট সংসদে পেশ হতো। এখন তা বন্ধ করা হয়েছে। কোন রাজ্যে কোন রেলের উন্নয়ন কার তা জানার উপায় নেই। ট্রেনের দুর্ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। সরকার তার দায় নিচ্ছে না। বিবেক দত্তরায় কমিটির সুপারিশ কার্যকর করতে তারা বদ্ধপরিকর। সেখানে রেল যাত্রী এবং অন্যান্যদের কোনো সামাজিক পরিষেবা থাকবে না। এমনকী রেলওয়ে পুলিশ ফোর্সও তুলে দেওয়া হবে। অথচ এই আরপিএফ ভয়ংকর অত্যাচার চালাচ্ছে রেল হকারদের উপর। তৃণমূল সরকার রাজ্যে আসীন হওয়ার পর আরপিএফ এবং জিআরপি’র সঙ্গে যোগসাজশে তৃণমূলের রেল হকার ইউনিয়ন সিআইটিইউ ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ে হকার্স ইউনিয়নের সদস্যদের ওপর নির্মম অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল। জোর করে এই সদস্যদের তাদের দলে নাম লেখানোর ব্যবস্থা করছিল।সিআইটিইউ কার্ড ছিড়ে ফেলে তাদের হুমকি দিচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ে হকার্স ইউনিয়ন করলে রেল হকারি করা যাবে না। প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে সেই অবস্থা খানিকটা কাটানো গেছে। এখনো অনেক ইউনিয়ন দপ্তর জোর করে তৃণমূল ইউনিয়ন দখল করে রেখেছে। এই অবস্থায় নতুন করে আরেকটি রেল হকারদের ইউনিয়ন তৃণমূলের ফাঁকা জায়গায় বসতে চাইছে। জয় বাংলা নামের এই সংগঠনের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বেশিরভাগই এলাকার তৃণমূল নেতৃত্ব। অথচ এরা রেল হকারদের কাছে ভান করছে অরাজনীতির। এদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু পশ্চিমবঙ্গ রেল হকার্স ইউনিয়নের সদস্যরা। তাদের ওপর দৈহিক ও মানসিক আক্রমণ করার ঘটনা এখন প্রায়শই তারা ঘটাচ্ছে। এদের হঠকারী মানসিকতার বলি অনেক সময় সাধারণ হকার সদস্যরা হয়ে যায়। যদিও পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ে হকার্স ইউনিয়ন এর বিরুদ্ধে লড়াই করে রেল হকারদের সামনে প্রকৃত তথ্য বোঝাতে সম্ভব হয়েছে। এরা যে রেল কর্তৃপক্ষের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে এবং সাধারণ রাজনীতির বাইনারি রেল হকারদের মধ্যে প্রবেশ করাতে চাইছে তা এখন সাধারণ রেল হকারদের কাছে পরিষ্কার হচ্ছে। ভুল বুঝে যারা জয় বাংলার দিকে ধাবিত হয়েছিল তারা আবার সিআইটিইউ-তে ফিরে আসছে।
সম্প্রতি রেল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে অমৃত কলস স্টেশনের কথা। পশ্চিমবাংলায় এরকম রেলস্টেশন হবে প্রায় ৪০টি। উত্তর ২৪ পরগনায় দুটি, আলিপুরদুয়ারের চারটি, পশ্চিম বর্ধমানের দুটি, পূর্ব বর্ধমানের তিনটি, বীরভূমের দুটি, কুচবিহারে দুটি, উত্তর দিনাজপুরে তিনটি, হুগলিতে চারটি, জলপাইগুড়িতে ছয়টি, মালদহে দুটি, মুর্শিদাবাদের তিনটি, নদিয়ায় ছটি এবং শিয়ালদা স্টেশন। এই স্টেশনগুলির পুনর্গঠন হবে উন্নয়নের মাধ্যমে। এখানে নাকি আধুনিক যাত্রী পরিষেবা দেওয়া হবে, প্রতীক্ষা রুম থাকবে, দুটি করে প্রবেশদ্বার, প্ল্যাটফর্মের সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য হাঁটার ব্যবস্থা, গাড়ি রাখার জায়গা, আরপিএফ ব্যারাক, ইলেকট্রিক সাব স্টেশন, উন্নত মানের বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, ইকো ফ্রেন্ডলি স্টেশন, বাজারের ব্যবস্থা থাকবে। প্রসঙ্গত, এখন যে পরিষেবাগুলি আছে সেগুলি অকার্যকর। সাবওয়েগুলি অপরিষ্কার, লিফটগুলি সচল নয়, এসকেলেটরগুলি কখনো চলে- কখনো চলে না। রেল স্টেশনের ফ্যানগুলি কখনো চলে, কখনো চলে না। স্টেশনের দুদিকে টিকিট কাউন্টার প্রায় বেশিরভাগ প্লাটফর্মেই নেই। এদিকে টিকিট কাউন্টারগুলি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণভাবে ‘এ’ চিহ্নিত স্টেশনগুলিতে দশটি টয়লেট, দশটি ইউরিনাল থাকার কথা। ‘বি’ চিহ্নিত স্টেশনগুলিতে ছ’টি টয়লেট, ছ’টি ইউরিনাল থাকার কথা। ‘সি’ চিহ্নিত স্টেশনগুলিতে চারটি টয়লেট, চারটি ইউরিনাল থাকার কথা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা নেই। রেলস্টেশনে দুটি ওভারব্রিজ থাকার কথা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা নেই। ২০০৭ সালে রেলের যাত্রী ছিল ১ কোটি ৪০ লক্ষ। ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয় ২ কোটি ৩০ লক্ষ। অর্থাৎ ওই ন’বছরে প্রায় নব্বই লাখ যাত্রী বেড়েছে। অথচ তাদের পরিষেবা প্রদানের জন্য কোনো ব্যবস্থা রেল কর্তৃপক্ষ করেনি। সকলেই জানে ট্রেনের সময়ের অনিয়মের কথা। এখনো পর্যন্ত সব ট্রেনকে ১২ বগি করা যায়নি। নতুন রেললাইন বৃদ্ধি করার কাজও প্রায় শিকেয়। বেশিরভাগ ট্রেনের তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ফলে এইসব সমস্যার থেকে মানুষের নজর ঘোরানোর জন্য ঝকমকে অমৃত কলস স্টেশনের ঘোষণা। আসলে রেলস্টেশনগুলোকে ওরা বিক্রি করে দিতে চাইছে বেসরকারি পুঁজির কাছে। তার আগে সেগুলোকে ধোপদুরস্ত করে ওরা পরিবেশন করতে চাইছে। এতে পর্যুদস্ত হবে গতরখাটা শ্রমিকরা। তাদের হটিয়ে দিয়ে সেই জায়গায় বেসরকারি পুঁজি স্ফীত করার ব্যবস্থা হবে। ঝাঁ চকচকে দোকানগুলিতে দামি মূল্যের পণ্যের পসরা সাজানো হবে। শিকার হবে সাধারণ রেল যাত্রীরা। যে উন্নয়ন হবে সেই উন্নয়ন কতখানি স্থায়ী থাকবে সন্দেহ নিত্যযাত্রী মহলের।
রেল হকারদের এখনকার লড়াইয়ের মর্মবস্তু
অর্থনীতিতে এবং রাজনীতিতে যে দক্ষিণপন্থী মোড় নেওয়া শুরু হয়েছে রেল হকারেরা তার ব্যতিক্রম নয়। সমস্ত সামাজিক কল্যাণ প্রকল্পে যেভাবে অর্থ বরাদ্দ ছাটাই হচ্ছে তাতে রেল হকারেরাও আক্রান্ত। জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি, কর্মসংকোচন, কর্মনাশ, সাধারণের থেকে শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে নেওয়া, গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে রেল হকারেরা আক্রান্ত। পাশবিক শক্তি নিয়ে যেকোনো প্রতিবাদকে দুই সরকারের গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রেল হকারদেরও প্রতিবাদ আছে। ধর্ম-জাতিকে সামনে রেখে বিভাজনের প্রক্রিয়া রেল হকারদের মধ্যেও ক্রীয়াশীল। হিন্দুত্বের আস্ফালনের ইউনিয়নও রেল হকারদের মধ্যে গজিয়ে উঠেছে। রেল হকারেরা উদারনীতির বিরুদ্ধে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, জাতপাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়ছে। লড়ছে কেন্দ্রীয় সরকারের বেসরকারিকরণ এবং বিলগ্নিকরণের নীতির বিরুদ্ধে। একা তারা পারবে না বলে রেলযাত্রী সমিতি, রেল কন্ট্রাকটরস লেবার ইউনিয়ন, ভেন্ডার, ইত্যাদির সঙ্গে যৌথ কার্যক্রমে ভূমিকা গ্রহণ করছে। এমনকী সাধারণ রেল হকারের উপর যখন আক্রমণ হয় তখন অন্য ইউনিয়নকে যুক্ত করে যৌথ কার্যক্রমের আহ্বানও সিআইটিইউ করে। আজকের কঠিন পরিস্থিতিতে সিআইটিইউ ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ে হকার্স ইউনিয়ন আহ্বান করেছে - চারিদিকে তাকাও, পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করো, আক্রান্ত রেল হকারের পাশে দাঁড়াও, হকার উচ্ছেদের নীতির পেছনের রাজনীতি রেল হকারদের কাছে ব্যাখ্যা করো। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রেল হকারদের ঐক্যবদ্ধ করো। যাদের দ্বারা পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার রেল হকারদের সামনে বাধার প্রাচীর গড়ে তুলেছে তাদের অবসানের জন্য সর্বাঙ্গীণ লড়াইয়ের বার্তা ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ে হকার্স ইউনিয়ন।