৬১ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ৪ আশ্বিন, ১৪৩০
মণিপুরে কুকি এবং মেইতেই দু’পক্ষই চায় আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান
অথচ সরকারি প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা নেই
দেবলীনা হেমব্রম
মণিপুরে ঘরছাড়া মানুষের ত্রাণ শিবিরে সীতারাম ইয়েচুরি ও দেবলীনা হেমব্রমসহ পার্টি নেতৃবৃন্দ।
মণিপুরের মানুষেরা কেমন আছেন সেই প্রকৃত পরিস্থিতি দেখতে ১৮ আগস্ট আমাদের পার্টির সম্পাদক কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির নেতৃত্বে আমরা, সিপিআই(এম)’র চার সদস্যের প্রতিনিধি দল ইম্ফলে পৌঁছাই। স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে জাতিসংঘর্ষ চলেছে মণিপুরে। অসংখ্য প্রাণহানি হয়েছে। আতঙ্ক আর হিংসার জেরে রাজ্যের পরিবেশ থমথমে। সরকারের ভূমিকা কার্যত শূন্য। বিবদমান কুকি এবং মেইতেই দুই জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই হানাহানির অবসান চাইছেন। চাইছেন সমাধান হোক আলোচনার মাধ্যমেই। ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে দেখা করে তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আমরা তাদেরকে বলে এসেছি, এই পরিকল্পিত সন্ত্রাসের পরিস্থিতিতে গোটা দেশ তাদের পাশে আছে। আমরা একই পরিবারভুক্ত। এই দলের আরও দুই সদস্য ছিলেন পার্টির ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক জিতেন চৌধুরী এবং আসাম রাজ্য সম্পাদক সুপ্রকাশ তালুকদার।
মণিপুরে এখন আতঙ্কের পরিবেশ। সরকার এবং প্রশাসনের কোনো কার্যকর ভূমিকাই নেই। বিজেপি’র ডবল ইঞ্জিন সরকার এখানে ফেল। তার মূল্য চোকাচ্ছে এখানে মেইতেই এবং কুকি দুই সম্প্রদায়ই। মানুষ ধরে ফেলেছেন, এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় ভাবাবেগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তার সবচেয়ে বড়ো শিকার মহিলা ও শিশুরা।
আমরা ১৮ এবং ১৯ তারিখ আতঙ্কে ঘরছাড়া মানুষের একাধিক ক্যাম্পে গিয়েছি, আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা এই দেশের অধিবাসী হিসেবে এত বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছি। কে কবে এসেছি সেটা নিয়ে বিবাদ না করে আমরা এতোগুলো বছর বিভিন্ন অংশের মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছি এইটাই আমাদের জোরের জায়গা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রক্তাক্ত বিবাদ ঘটল। কারণ, এই হিংসায় উসকানি আছে। চেষ্টা হয়েছে পারস্পরিক সম্পর্কে অবিশ্বাস তৈরি করার।
আমরা প্রথম দিন গিয়েছিলাম বিষ্ণুপুরের মইরাঙের এক আশ্রয় শিবিরে। এই শিবিরের পরিস্থিতি একেবারেই বসবাসের যোগ্য ছিল না। ন্যূনতম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছিল না। পর্যাপ্ত বালিশ বিছানা মশারি নেই। এই শিবিরে ছিলেন মূলত মেইতেই সম্প্রদায়ের ঘরছাড়া মানুষজন। প্রবল গরমে গ্রামের একটি মাঠের মাঝখানে টিনের শেডের নিচে চলা এই অস্থায়ী শিবিরে হাঁসফাঁস অবস্থায় বহু মহিলা পুরুষ রয়েছেন একসাথে। বাধ্য হচ্ছেন থাকতে।
এখান থেকে আমরা যাই চোরাচাঁদপুরের আরও দুটি শিবিরে। এখানে একটি স্কুল বাড়িতে আশ্রয় শিবির খোলা হয়েছে। এই শিবিরে বেশ কয়েকজন আসন্নপ্রসবা মহিলা ছিলেন। আমরা পৌঁছানোর কয়েকদিন আগেই দু’টি শিশু ওই আশ্রয় শিবিরে জন্ম নিয়েছে। জীবনযাত্রার ন্যূনতম উপকরণ নেই। পর্যাপ্ত পানীয় জল, খাবার নেই। এই অবস্থাই কমবেশি রয়েছে সব শিবিরেই। এখানে ছিলেন হিংসায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরছাড়া কুকিরা। শিবিরের ৩০০-র বেশি মানুষ থাকলেও সরকারি আনুকূল্য প্রায় নেই বললেই চলে। প্রায় কোনও শিবিরেই নেই উপযুক্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা। বিশেষত, মেয়েরা খুবই অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরা চাইছেন পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হোক, তাহলে তাঁরা ঘরে ফিরবেন যত দ্রুত সম্ভব।
এছাড়া আরও দুটি শিবিরে আমরা যাই, যেখানে পরিস্থিতি অন্য দুটি শিবিরের তুলনায় আলাদা কিছু নয়। নির্মীয়মাণ একটি বাজারের ভেতরে বৃষ্টির জল জমে কাদা থকথকে পরিবেশে একসঙ্গে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন বহু অসহায় মানুষ। এখানে নিকাশির ব্যবস্থা নেই। চরম অস্বাস্থ্যকর স্যাঁতস্যাতে অবস্থা। প্রয়োজন আরও শিবিরের।
এই প্রত্যেকটি শিবিরেই বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে খাবার দাবার দেওয়া হচ্ছে। সরকার থেকে শুধুমাত্র চাল, ডাল আর আলু দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকজন শিশু এখানে জন্ম নিয়েছে যা স্থানীয় গির্জার মেডিকেল পরিষেবার সক্রিয় সাহায্যে। সদ্য জন্মানো শিশুদের উপযুক্ত টিকা এবং ভ্যাকসিন দেওয়ারও ব্যবস্থা নেই। শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না। পড়াশোনা বন্ধ। অনিশ্চিত অবস্থা। দুই সম্প্রদায়েরই ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্মশানের মতো অবস্থা পোড়া একাধিক জনবসতির। জাতি দাঙ্গায় বাবা-মা-কে হারিয়ে অনাথ হয়ে গেছে বহু শিশু।
আমরা এখানে দুই সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা তাঁদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। সাধারণ মানুষ সহ বিভিন্ন সংগঠনের পর্যবেক্ষণ, যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি তাঁর কিছুই পূরণ করতে পারেনি। তাই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারার খামতি ঢাকতে বিভাজনে উসকানি। তারই পরিণতি এই জাতিদাঙ্গা এমনকী মহিলাদের উপস্থিতিতে মহিলাদের অপমান-নির্যাতন, হিংসায় মহিলাদের নজিরবিহীন অংশগ্রহণ। কুকি-মেইতেই দুপক্ষেরই রয়েছে সরকার বিরোধী ক্ষোভ। কিন্তু তাঁরা আমাদের বারবার বলছিলেন, সরকারকে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দিতে যে তাঁরা চান, আলোচনার মধ্যদিয়ে সমাধান হোক।
এখানে আইন শৃঙ্খলা একেবারে ভেঙে পড়েছে। কুকি এবং মেইতেইদের পরস্পরের জনবসতিতে যাবার এক্তিয়ার নেই। দু’পক্ষের হাতেই অস্ত্র রয়েছে। এমনকী সেনাবাহিনীর ব্যবহারের অস্ত্রও সাধারণ মানুষের হাতে দেখা যাচ্ছে। কীভাবে পাচ্ছেন মানুষ এই সব অস্ত্র? কে জোগান দিচ্ছে তাঁদের এই অস্ত্র? এই সব অস্ত্র উদ্ধারে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই, রয়েছে পরোক্ষ রাজনৈতিক উসকানি। তাই হিংসা থামানো কঠিন বলে অনেকেই মনে করছেন।
যাতায়াতের পথে দেখলাম রাস্তায় চলাচলকারী গাড়িগুলিকে স্থানীয়দের নজরদারিতে পড়তে হচ্ছে। এক শহর থেকে অন্যত্র যাওয়া আসার গাড়ি থামিয়ে খোঁজ করা হচ্ছে কে কোথায় যাচ্ছেন। দেশের মধ্যে এই রাজ্যে কুকি এবং মেইতেই দুই গোষ্ঠীর সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়েছে চলাফেরার। এক জায়গা থেকে অন্যত্র পরিবহণ, এমনকী আসাম রাইফেলসের গাড়ি আটকে দিচ্ছেন মহিলারা, এমন দৃশ্যও চোখে পড়ল। শুনেছি অনেকেই রাজ্য ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র, সীমানা পেরিয়ে দেশের বাইরেও। খাবারদাবার বোঝাই ট্রাক পৌঁছতে পারছে না ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বা আশ্রয় শিবিরে।
আমরা রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা জানাই। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কেন্দ্রকে সর্বদলের বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়ারও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এই হিংসার বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মণিপুরবাসীর মতো ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের ‘না’ বলতে হবে যাতে সরকারের কানে বার্তা পৌঁছায়।