E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ৪ আশ্বিন, ১৪৩০

বিগ ডাটা ও বেগার খাটা

ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী


‘বিগ ডাটা’ (Big Data) আজ গোটা দুনিয়ার ব্যবসায়িক মহলে (এবং রাজনৈতিক মহলেও) খুবই আলোচ্য বিষয়। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বটে। মুকেশ আম্বানির মতো করপোরেট মাতব্বর মন্তব্য করেছেন, ‘‘We are at the be-ginning of an era where data is the new oil.’’ অর্থাৎ বিপুল ডাটা ভাণ্ডার আসলে তেলের খনির মতো দামি। গোটা দুনিয়া জোড়া অসংখ্য কোম্পানি আছে যাদের মূল ব্যবসাই হলো ডাটা সংগ্রহ করা এবং তা অ্যানালিসিস করা। আমাদের পরিচিত এরকম কয়েকটা সংস্থা হলো Facebook, Amazon, Google ইত্যাদি। যদিও শুধুমাত্র ডাটা নিয়ে ব্যবসা করার‍‌ ক্ষেত্র ধরলে এর থেকেও বড়ো কিছু সংস্থা আছে। এরা সবাই গোটা দুনিয়ার তথ্য সংগ্রহ করে। সেই তথ্যের মধ্যে বিজ্ঞানীর গবেষণাপত্র যেমন আছে ঠিক সেরকম ‘‘আজ সকালে আমার মন খারাপ’’ - এই সোশ্যাল মিডিয়া স্ট্যাটাসও আছে। এই তথ্যই পণ্য। তথ্যের বিরাট ভাণ্ডার যা প্রধানত মানুষের চাহিদা বা বাজার বুঝতে সাহায্য করে। তাই প্রতিটা মানুষ কী চায় বা ‘customized demand’ বোঝার জন্য বিভিন্ন কোম্পানি, এমনকী ভোট চালানো কোম্পানিও (IPAC-এর মতো) এই তথ্য ক্রয় করে। কী খাই, কী দেখি, কী বলি, কোথায় যাই - এই সমস্ত তথ্যই এখন পণ্য। এই পণ্যের মালিক বড়ো বড়ো কোম্পানি, এই পণ্যের ক্রেতাও মূলত বড়ো সংস্থা (সরকারি, বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই)। কিন্তু এই পণ্যের মজদুর হলো কোটি কোটি জনগণ।

১৮৫৮ সালে মার্কস Grundrisse-তে লিখছেন - ‘‘The development of fixed capital indi-cates to what degree general social knowledge has become a direct force of production, and to what degree hence, the conditions of the process of social life it-self have come under the control of the general intellect and been transformed in accordance with it.’’ । ওপরের এই উদ্ধৃতিটির মধ্যে দুটো অংশ আছে। প্রথম অংশতে বলা হচ্ছে যে ‘fixed capital’ অর্থাৎ মজুরের মজুরি বাদ দিয়ে যা উৎপাদনে বিনিয়োগ হয় তা আসলে সমাজের সম্মিলিত জ্ঞানকেই উৎপাদনের হাতিয়ারে পরিণত করার নামান্তর। যেমন যে কোনো প্রযুক্তিই (যা আসলে fixed capital) সমাজের সম্মিলিত জ্ঞানের মূর্ত রূপ। তাই প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনের বৃদ্ধির মানে হলো আসলে সমাজের সম্মিলিত জ্ঞানকে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা। সেটা বুঝতে একদমই অসুবিধা হয় না যে, মানুষের জ্ঞানের মূর্ত চেহারাই হলো উন্নত প্রযুক্তি, যা উৎপাদন বৃদ্ধি করে। যেমন হাতে বানানো কাপড়ের জায়গায় যন্ত্র চালিয়ে কাপড় তৈরি করলে অনেক দ্রুত, অনেক বে‍‌শি কাপড় তৈরি করা সম্ভব। এই যন্ত্রই সম্মিলিত সামাজিক জ্ঞানের ‘objectified’ চেহারা। এবার মজার ব্যাপার হলো ‘জ্ঞান’ নিজেই যদি পণ্য হয়ে যায়। তাহ‍‌লে কী হবে? আমরা কাপড় তৈরির উদাহরণটা দিয়েই দেখতে পারি যে, হাতে কাপড় বানাতে হলে সেই কাজের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট গুণ থাকা দরকার (quality of labour)। কাপড় বুনতে জানতে হবে, রঙ করতে জানতে হবে, নক্‌শা করতে জান‍‌তে হবে ইত্যাদি। যদি যন্ত্র চালি‍‌য়ে কাপড় তৈরি হয় তাহলে এসব আর জানার দরকার নেই, কারণ এই সমস্ত গুণ বা জ্ঞান ‘objectified labour’ হিসেবে যন্ত্রের মধ্যে পুঞ্জীভূত (যা fixed capital)। এবার শ্রমিককে শুধু বোতাম টিপতে হবে তাহলেই কাপড় তৈরি হবে। এই পুঞ্জীভূত জ্ঞান, যাকে প্রযুক্তি বলা হয়, তা মানুষের শ্রমের গুণগত দিককে নিকেশ করে (negation) পরিমাণগত বৃদ্ধি ঘটায়। যা জামা, জুতো, গাড়ি, বাড়ি তৈরি করার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের জন্মলগ্ন থেকে দুনিয়া দেখেছে। কিন্তু ‘জ্ঞান’ নামক বস্তুটিকে যদি পণ্য হিসেবে তৈরি করতে হয় তাহলে ‘জ্ঞানের’ উৎপাদনকেও একইরকমভাবে পরিচালিত করতে হবে। অর্থাৎ মানুষের বৌদ্ধিক শ্রমকেও উপরে উল্লিখিত উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। যেমন ছবি তোলা একটি বিশেষ গুণ। ফোকাস বুঝতে হবে, ব্যলান্স বুঝতে হবে, লাইট বুঝতে হবে, টোন বুঝতে হবে, তবে গিয়ে ভালো ছবি উঠবে। (ঠিক কাপড়ের রঙ, নকশা, বুনটের মতো)। কিন্তু যদি এরকম এক যন্ত্র এবং প্রযুক্তির আবিষ্কার করা যায় যা ওই কাপড়ের মেশিনের মতোই ছবির ক্ষেত্রেও ফোকাস, টোন, কালার সব নিজেই ঠিক করবে, যে ছবি তুলবে তার কাজ শুধু বোতাম টেপা, তাহলে ঠিক কাপড় উৎপাদনের মতোই যে কোনো কেউ ছবি তোলার গুণগত উৎকর্ষতা ছাড়াও ক্রমাগত ছবি তুলে যেতে পারবে। শুধু ছবি তুলবে না, শ্রমিক‍‌ যেমন যন্ত্র চালিয়ে বানানো কাপড়টা মালিকের গুদামে জমা করেই আসে, সেরকমই সে ছবিটাও মালিকের ‘ক্লাউড’-এ জমা করে আসবে। ২০০৭ সালের ৯ জানুয়ারি দুনিয়ার সামনে iphone নিয়ে আসার সময় স্টিভ জোভ ঠিক এরকমই এক প্রযুক্তির কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘‘Well, today, we are introducing three revolutionary product of this class [that changes everything]. The first one is a wide-screen iPod with touch controls. The second is a revolutionary mobile phone. And the third is a breakthrough internet communication device.’’ শব্দ, ছবি, চলমান ছবি, লেখা ...সব রকম বৌদ্ধিক শ্রমজাত পণ্য তৈরি করার অভিন্ন যন্ত্র যা‍‌কে আমরা এখন ‘স্মার্ট ফোন’ নামে জানি এবং দুনিয়া জোড়া কোটি কোটি মানুষের বৌদ্ধিক শ্রমকে জুড়ে দেওয়ার ‘Conveyor Belt’ যার নাম ইন্টারনেট। আমরাই প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে এই যন্ত্র মারফত কোটি কোটি ‘তথ্য’ বা ‘ডাটা’ তৈরি করছি যা Big Data নামক ‘তেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনি’ তৈরি করছি। এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তি নামক ‘fixed capital’-ই আসল নিয়ন্ত্রক। এই পণ্য অর্থাৎ ‘তথ্য’ যারা তৈরি করছেন তাদের facebook করার জন্য, Amazon এ জিনিস কেনার জন্য, spotify-তে গান শোনার জন্য কেউ ‘মজুরি’ বাবদ এক টাকাও দিচ্ছে না। Big Data নামক পণ্যের সিংহভাগ মজুর আসলে বেগার খাটছে। ওপরের উদ্ধৃতিটিতে মার্কস যাকে বলছেন, ‘general intellect’, অর্থাৎ সমাজের সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তা, Big Data হলো সেই বুদ্ধিমত্তারই ‘objectified’ চেহারা। শুধু তাই না, আমাদের সমাজজীবনও তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

পুঁজিবাদের বৈশিষ্টই এই যে, মানুষ নিজের সৃজনশীল শ্রম দ্বারা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী উৎপাদন করে না। বরং যন্ত্রচালিত উৎপাদনের নিয়মেই নিজের ‘শ্রম’ নামক সামাজিক কর্মকাণ্ডকে পুনর্গঠিত করে। যেমন ধরা যাক, আপনি একটি ১৬ অ্যাম্পিয়ারের সকেটের জন্য থ্রি-পিন প্লাগ বাজার থেকে কিনলেন। সেই প্লাগ যে কোন কোম্পানির হতে পারে। অর্থাৎ সেটা টিটাগড়, তিরুবনন্তপুরম, টেক্সাস যে কোনো জায়গায় তৈরি হতে পারে। সেখানকার, যে কোনও শ্রমিক বা শ্রমিকরা তা তৈরি করতে পারেন। আপনি দেখবেন যে সেই প্লাগটি কোথায়, কার দ্বারা তৈরি সেই শর্ত-নিরপেক্ষভাবে আপনার ঘরের সকেটে ফিট করছে। তার কারণ প্লাগ তৈরির শ্রমিক এটা নির্ধারণ করেন না যে কী মাপে, কতটা, কী ধরনের ‍‌জিনিস তৈরি হবে। বরং সকেট ও প্লাগ কী রকম হবে তা যন্ত্র বা প্রযুক্তি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে, শ্রমিকের কাজ যন্ত্রের নিয়মে সেটা তৈরি করে যাওয়া। এবং সেই নিয়মেই তা ভোগ করে যাওয়াও বটে। ‘Mass production’-এর এই নিয়ম শুধুমাত্র সকেট বা প্লাগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, তা বৌদ্ধিক শ্রমজাত উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। ‘Cultural Mass Production’-এর প্রযুক্তি এখন আমরা পকেটে নিয়ে ঘুরছি। তার নিয়মেই গাইছি, নাচছি, কথা বলছি। আর সে জন্যেই কাটোয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়া সবাই ‘কাচা বাদামের’ সাথে একই নাচ নেচে চলেছে। ওই যে মার্কস বলছেন, ‘‘...come under the control of the general intellect and been transformed in accordance with it’’। কিন্তু কেউ কি এই প্রক্রিয়ার বাইরে থাকতে পারে না? অবশ্যই পারে। ঠিক যেমন আমরা এই প্রশ্নটাও করতে পারি যে, কেউ কি চাইলে অন্যরকম সকেট ও প্লাগ বানাতে পারে না? অবশ্যই পারে। কিন্তু অন্যরকমভাবে বানালে হয় এই নতুন পণ্যকেই বাজার দখল করতে হবে, অর্থাৎ তাকেই ‘trending’ হয়ে উঠতে হবে (যা আসলে ঘুরে ফিরে আমাদের একই জায়গায় দাঁড় করাবে) বা সে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হারিয়ে যাবে। এই Big Data আমাদেরই বেগার খাটার ফসল। যাকে বলা হচ্ছে ‘Prosumption’। অর্থাৎ Production এবং Consumption হচ্ছে এক‍‌ই সাথে। যত data গিলছি, তত data তৈরি করছি। এবং উল্টোটাও। পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী পণ্যায়নের সাম্প্রতিক চেহারা। যদিও এটা এখন সবার জানা যে, আমার তৈরি করা তথ্য নিয়ে ব্যবসা করছে করপোরেটরা। আর তাই এই দাবিও উঠছে যে, আমার অনুমতি ছাড়া আমার কোনো তথ্য ব্যবহার করা যাবে না। এই দাবি আদৌ কোনো সংগঠিত আন্দোলনের চেহারা পাবে কি না সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। দাবি খুব সহজ। ঠিক যে রকম আমাদের নদী, জঙ্গল, জমি ওদের মুনাফার জন্য নয়, তেমনই আমাদের বৃষ্টি ভাল লাগে না কি বাড়ির ছাদ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, সেই তথ্যও ওদের ব্যবসার জন্য নয়।