E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২৩ এপ্রিল, ২০২১ / ৯ বৈশাখ, ১৪২৮

কাশীপুর বেলগাছিয়া কেন্দ্র

তৃণমূলের সন্ত্রাস পেরিয়ে বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জোরালো হচ্ছে সংযুক্ত মোর্চার প্রচার


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সন্ত্রাস আর ভয়ের সরণি পেরিয়ে দিনবদলের দিকে প্রতিদিন একটু একটু করে বামপন্থীদের নেতৃত্বে সংযুক্ত মোর্চার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছেন এরাজ্যের মানুষ। অন্য অনেক এলাকার মতো এবারের বিধানসভা নির্বাচনে কাশীপুর বেলগাছিয়া কেন্দ্রের প্রার্থী সিপিআই(এম)’র প্রতীপ দাশগুপ্তের প্রচার পরিক্রমাকে ঘিরে ঘটা টুকরো টুকরো ঘটনা সেই ইঙ্গিত প্রতিদিন আরও স্পষ্ট করে তুলছে। পাশাপাশি বামপন্থীদের ঘিরে প্রতিষ্ঠিত কতগুলি সামাজিক সত্য চিরায়ত রূপ নিচ্ছে এখানেও। সেরকমই একটি অন্যতম সামাজিক দিক হলো, গরিব মানুষ বামপন্থীদেরকেই তাঁদের সাথি মনে করে মনের কথা খুলে বলেন। সেটাই ঘটছে এখানেও। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগে থেকেই প্রতীপকে চেনেন এলাকার মানুষ যুব এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের সারির অন্যতম মুখ হিসেবে। কিন্তু গরিব মানুষ চেনেন তাদের প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের সাথী হিসেবে। তাই ভোট চাইতে আসা একতরফা চাহিদার মোড়কে হুমকি সর্বস্ব অন্ধকারের মুখগুলিকে নয়, ঘোষ বাগান, জুড়িপাড়া বা বেলগাছিয়া বসতির মধ্যে দিন গুজরান করা দিন আনা দিন খাওয়া অথবা আধপেটা না খাওয়া মানুষ তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা বলার জন্য বেছে নিচ্ছেন প্রতীপ দাশগুপ্তকেই।

কলকাতা পুরসভার এক নম্বর থেকে ৪ নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত বসবাসকারী নাগরিকদের একটা বড়ো অংশ কোনও নির্বাচনেই ভোট দিতে পারেননি গত ১০ বছর। তাই প্রতীপ যখন মানুষের কাছে বামফ্রন্টের ইস্তাহার অনুযায়ী সবার জন্য কাজ, রেগা’র ১০০দিনের কাজকে ১৫০ দিন করা, সরকারের শূন্য পদে নিয়োগের কথা, টেট, এসএসসি পরীক্ষা নিয়মিত করার কথা, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত ভরতুকি দেবার বিকল্পের কথা মানুষকে বলছেন - তখন চেনা অচেনা অল্প চেনা মানুষ সঙ্গী হয়ে যাচ্ছেন তাঁর প্রচার মিছিলের। আর এগিয়ে এসে যাঁরা জড়িয়ে ধরেছেন প্রার্থী প্রতীপের হাত, কিন্তু পা মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন না প্রচার পরিক্রমায় তাঁরা কী করছেন? বলা ভালো তাঁরাই প্রতীপ দাশগুপ্ত’র হয়ে নানা স্তরে পৌঁছে দিচ্ছেন নির্বাচনী সংগ্রামে অংশগ্রহণের গুরুত্বের বার্তা।

এই এলাকার ‘উন্নয়নে’র জন্য ভোট লুট করে যারা পৌরসভা এবং বিধানসভা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন সেই তৃণমূলীরা কোথায়? তাদের কী অবস্থা? এলাকায় আছেন নাকি। উত্তরটা একই সঙ্গে হ্যাঁ এবং না। তারা মানুষের আশেপাশে নেই, ঘাপটি মেরে রয়েছেন এদিক ওদিক। কেন নেই তারা? নেই তার কারণ হলো নিকাশি থেকে পানীয় জল, ভেঙে পড়া টালা ব্রিজের ভবিষ্যৎ কী, কীভাবে বন্দরের সরকারি জমিতে রাতারাতি ফ্ল্যাট গজিয়ে উঠল ইত্যাদি এলাকার অসংখ্য সমস্যার কোনো কৈফিয়ৎ বা উত্তর নেই তাদের কাছে। কারণ কলকাতাসহ রাজ্যের অন্যত্র বেআইনি নির্মাণের অর্থনীতি ঠিক যেভাবে চলে এখানেও তাই হয়েছে। অর্থাৎ কাটমানি থেকে তোলাবাজি সবটাই বেআইনের নিয়মে তৃণমূলীরা চালিয়েছেন মসৃণভাবে। অভিযোগ, যাবতীয় অপকর্মের ব্লুপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ করেছেন এলাকার কাউন্সিলর থেকে বিধায়ক। দিনের আলোয় প্রকাশ্যে সবাই দেখেছেন, গরিব মানুষ কিভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, বন্ধ কারখানার শ্রমিকের চোখের সামনে কারখানার জমিতে কীভাবে গজিয়ে উঠেছে বহুতল, শ্রমিকের বকেয়া না মিটিয়েই। সংক্ষেপে এই হলো এই বিধানসভা কেন্দ্রের তথাকথিত উন্নয়নের রূপরেখা।

টালা ব্রিজের কথায় আসা যাক। অনেকেরই মনে আছে সেখানকার আশেপাশের ছিন্নমূল মানুষের বসতির কথা। ওই এলাকায় বসবাসকারী অসহায় গরিব মানুষকে কোনো পুনর্বাসন ছাড়াই কীভাবে উচ্ছেদ করা হলো রাতের অন্ধকারে সেই কথা। তাঁদের পাশে বামপন্থীদের দাঁড়ানোর কথা। প্রতীপদের দাঁড়ানোর কথা। তাঁদের কেড়ে নেওয়া বাসস্থানের অধিকারের দাবিতে বিকাশ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে আইনি লড়াইয়ে যাবার কথা।

একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক ঘটনা পরম্পরা। বছর কয়েক আগে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমাগত যখন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ ভেঙে পড়ছে, তখন মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন। অভিযোগ, মানুষের সেই আতঙ্ককে পুঁজি করে রাজ্য সরকার সদিচ্ছার ভান করে ঘোষণা করে টালা ব্রিজ মুমূর্ষু। তারপরই গোটা উত্তর কলকাতাকে পঙ্গু করে দেওয়া হলো টালা ব্রিজ ভেঙে ফেলে। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো গরিবে গরিবে তফাত করার তৃণমুলী কায়দা। বউবাজার এলাকায় মেট্রোরেলের কাজের ফলে নামা ধসে যখন সেখানকার গরিব মানুষরা বাস্তুচ্যুত হলেন তাঁদের রাখা হলো হোটেলে। আর টালা ব্রিজের নিচে থাকা মানুষকে প্রশাসন ত্রিপলটুকুও দিল না। কলকাতা কর্পোরেশন এলাকার সঙ্গে বাকি পশ্চিমবাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঠেলে দেওয়া হলো অনিশ্চয়তার মুখে। সেই সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল এলাকার অর্থনীতি বেহাল হলো। সেটা সুনিপুণভাবে করা হলো!

কেন করা হলো এসব? ওয়াকিবহাল মহলের অভিযোগ, ভাঙা হলো অন্য প্রয়োজনে। পুনঃনির্মাণের তহবিল থেকে তৃণমূলের ‘স্থায়ী রোজগারে’র জন্য। এলাকার বিধায়ককে এবারে মনোনয়ন না দিয়ে ছেঁটে দেওয়া হলো কেন? তার মূলেও রয়েছে টালা ব্রিজ কাণ্ড। অভিযোগ, ভাইপোর কাছে নাকি ব্রিজ নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদারদের প্রণামী ঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে পৌঁছাচ্ছিল না। তার ওপর, এবারের প্রার্থী অতীন ঘোষ নাকি গেরুয়া শিবিরের দিকে পা বাড়িয়ে ফেলেছিলেন। সবদিক সামলাতেই তাই এই পদক্ষেপ। এসব আঁচ করেই নাকি গত এক-দেড় বছর বিদায়ী বিধায়ক এবং কাউন্সিলর এলাকার ধার মাড়ান নি। কিন্তু ওই এলাকার বসবাসকারী সাবিনা বিবি, প্রকাশ মণ্ডলরা (নাম পরিবর্তিত), যাঁরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছেন এখন, তাঁদের সঙ্গে এলাকার বহু মানুষ জবাব চাইছেন তাঁদের এ দুরবস্থার জন্য। প্রতীপের নেতৃত্বে,প্রতীপদের নেতৃত্বে তাঁদের সে লড়াই বৃহত্তর আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। তাঁরা নির্বাচনের দিন জবাব না পাবার পাল্টা জবাব দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

নিকাশি ব্যবস্থাটা ঠিক কেমন কাশীপুর বেলগাছিয়া এলাকার নিম্নবিত্ত মানুষের বসতির মধ্যে? তাদের বাড়ির মধ্যে উঠোনে জল জমে থাকে বর্ষা পেরিয়ে শরৎকালেও। গা ঘিনঘিন করা পচা জলের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মশা মাছি সহ সাপের উপদ্রব-এর মধ্যে তাদের থাকতে হয় রোগ ব্যাধিকে সঙ্গী করে। টালা ট্যাংকের জল অর্ধেক জায়গায় পান না এই বিধানসভার মানুষ। চিত্রটা গত ১০ বছরে একই থেকেছে। এই মানুষরাই প্রতীপের সঙ্গে আছেন। কারণ তাঁদের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রতিনিয়ত লড়াইয়ের ময়দানে আছে পার্টি, আছেন প্রতীপরা।

২০২০তে লকডাউন’র সময় একমাত্র বামপন্থীরাই রাস্তায় থেকেছেন। মানুষের পাশে থেকেছেন। এখানেও তাই। কলকাতা স্টেশনে আটকে পড়া ত্রিপুরা বা আসানসোল, উত্তরবঙ্গের অসহায় মানুষের পাশে থেকে খাবার জল সহ অন্যান্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন সাধ্যমতো। বিধানসভা এলাকার বিভিন্ন জায়গায় খোলা হয়েছে শ্রমজীবী ক্যান্টিন, কমিউনিটি কিচেন। বিলি করা হয়েছে রান্না করা খাবার থেকে রেশন পর্যন্ত। ফোর বি বাসস্ট্যান্ডে ওই সময় স্কুলপড়ুয়াদের দেওয়া হয়েছে শিক্ষা সামগ্রী। বিধানসভার অন্তর্গত ১ থেকে ৬ নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় নানা সংগঠনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, এলাকায় স্যানিটাইজেশন’র কাজ করা হয়েছে। হ্যাঁ এসবই করা হয়েছে কোনো ‘আমরা’ ‘ওরা’ না দেখেই। মানুষ মনে রেখেছেন। বিজেমূলীদের দেখা মেলেনি। প্রচারে এগিয়ে এসে তাঁরা বলছেনও সেসব।

গত ১০ বছরের এখানে বন্ধ হয়েছে ভেনাস, ইউনিয়ন কার্বাইড বা এঞ্জেলো ব্রাদার্স-এর মতো চালু কারখানা। জমি হাঙরেরা তার বেশ কয়েকটিতে ইতিমধ্যেই গড়ে তুলেছে অবৈধ নির্মাণ। এখানকার জমির চরিত্র বদল হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি। বস্তির জমিতে বহুতল গড়ে উঠছে। কর্পোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী ছাড় দিয়ে বাড়ি করার কথা মান্য করা হচ্ছে না। অভিযোগ, বরো কমিটির চেয়ারম্যান থেকে এমএলএ’র নেতৃত্বে বেআইনি নির্মাণের ক্ষেত্রে এখন বেনিয়মটাই আইন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্বকে সঙ্গে নিয়ে বস্তি উন্নয়ন কমিটি বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে ডেপুটেশন দিয়েছে কর্পোরেশনে। লড়াই ‌আন্দোলনে থেকেছেন। কোনো কাজ হয়নি, হয়নি পুনর্বাসন। না, বন্ধ কারখানার জমিতে গড়ে ওঠেনি নতুন কারখানা। ভুক্তভোগীরা মনে রেখেছেন তা।

অসংগঠিত শ্রমিকদের পাশেও রয়েছেন প্রতীপ। প্রতীপরা। হকারদের লাইসেন্স দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন থেকে আর জি কর হাসপাতালে ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের সংগ্রামের সংগঠক প্রতীপ। এটিএমগুলির রক্ষীদের ১২ ঘন্টা নয়, আট ঘন্টা ডিউটি করাতে হবে এ দাবি তুলেও আন্দোলনে মোটা মাইনের চাকরিকে ছুঁড়ে ফেলে মানুষের ডাকে সাড়া দেওয়া প্রতীপ। টালা পার্কের সবুজ রক্ষার অভিযান থেকে রক্তদান শিবির সংগঠন, নাট্যোৎসব সংগঠন সবেতেই আছেন প্রতীপ। বলা উচিত এগিয়ে রয়েছেন ভোটের লড়াইয়ের সামনে।

তাই সংযুক্ত মোর্চাকে আটকাতে বামপন্থীদের দুর্বল করতে সন্ত্রাসের আবহ অটুট রাখতে মরিয়া তৃণমূলীরা। তাই ওরা পার্টি অফিস ভাঙচুর করেছে, ভেঙেছে শহিদ বেদি। বামপন্থীদের মিছিলকে রুখতে অগণতান্ত্রিকভাবে বাধা দিচ্ছে তৃণমূলী সাংসদ শান্তনু সেনরা। মার খেয়েছেন পার্টির পুরনো জোনাল থেকে লোকাল কমিটির সম্পাদকরা। এলাকা ছাড়া হয়েছেন দীর্ঘ দিন। পাল্টা প্রতিরোধ হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে সেই শহিদ বেদি আবার। আর এলাকার মানুষ বলছেন লড়াইয়ে তাঁরা আছেন থাকবেন। শেষ দেখবেন।

প্রতীপের কাছে এলাকার এক ছোট ব্যবসায়ীর অভিযোগ, আমি তৃণমূল করলেও ছেলের একটা অল্প বেতনের চাকরির জন্য তৃণমূল নেতাদের কাছে তদবির করতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। ওরা বলে তৃণমূল করো আর যাই করো, টাকা দিতে হবে চাকরি পেতে হলে। বাড়ি ফিরে ছেলেকে কোনো জবাব দিতে পারিনি। ছেলে যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল। তারপর থেকে ঘাসফুলের ঝান্ডা ধরিনি কোনোদিন। এদের চিনে গেছি। আপনারা আসুন। আমার মতো আরও অনেক তৃণমূলী সমর্থক আর সাধারণ মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি তফাতটা। আর সহ্য হচ্ছে না। রাজ্যের অন্যত্র যেমন, এখানেও তেমন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিরোধের লড়াইটা ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে চেনা গণ্ডি ছাড়িয়ে।