E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২৩ এপ্রিল, ২০২১ / ৯ বৈশাখ, ১৪২৮

মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্র

উন্নয়ন কাজে মানুষের সাথে নিবিড় যোগাযোগই মোর্চা প্রার্থীকে এগিয়ে রেখেছে মানিকতলা কেন্দ্র

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়


বিকল্পের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর সরকার পরিচালনা করেছে বামফ্রন্ট। সেই অভিজ্ঞতার পথ বেয়ে বিকল্পের রূপরেখা নির্ভর উন্নয়নের পরিকল্পনাকেই অগ্রাধিকার  দেওয়া হয়েছে সংযুক্ত মোর্চার ইস্তাহারে। যেখানে সাধারণ মানুষকে বিধানসভা বা ওয়ার্ড ভিত্তিক গণ্ডি নয়, ভোটের মাপে ‘আমরা-ওরা’র  হিসেবে নয়, দলমত নির্বিশেষে তার প্রয়োজন পূরণই উন্নয়নের  লক্ষ্য। বিভাজন নয় গরিব মানুষের স্বার্থ দেখাই অগ্রাধিকারের  ক্ষেত্র। মানিকতলা বিধানসভার ক্ষেত্রেও মানুষের পূর্ব অভিজ্ঞতা তাই। শ্যামল চক্রবর্তী থেকে রুপা বাগচী - বিধানসভা থেকে কলকাতা পুরসভা, জনপ্রতিনিধি হিসেবে এদের গলায় সব জায়গাতেই খেটে খাওয়া মানুষের চাহিদার  প্রতিধ্বনি  শোনা গেছে।  এই কথাগুলো নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে একটু অন্যভাবে বলছিলেন কলকাতার একটি কলেজের জনৈক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাহিত্যের অধ্যাপক, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মানিকতলা বিধানসভা এলাকায় একটি আবাসনে থাকেন।  আর খান্না মোড়ের থেকে একটু দূরে হরি সাহার হাটে দাঁড়িয়ে দূরে রাস্তা পেরোতে থাকা তৃণমূল বিধায়ক বা মন্ত্রী সাধন পান্ডের প্রচার মিছিলের দিকে তাকিয়ে লকডাউনে কাজ হারানো ঠিকা শ্রমিক তারক সাউ ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন, ছোটবেলা থেকে তো দেখেছি, সিপিএম (বামফ্রন্ট) কোনোদিন তফাত করেনি মানুষে মানুষে। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় নেই ১০ বছর। তাহলে এরা কেন এমন ভয় পাচ্ছে বলুনতো? কেন রূপাদির (বাগচী) পোস্টার ছিঁড়ছে বলতে পারেন? উনি আট বারের বিধায়ক, দু’বারের মন্ত্রী। ক্ষমতায় না থাকা একটা দলকে কেন এত ভয় পাচ্ছেন? কই বিজেপি’র ফ্ল্যাগ তো খুলে দিচ্ছেন না! পোস্টার ছিড়ছেন না? দু’টো দলই তো ওনার বিরোধী! উনি কি বিজেপি-তে যাবার রাস্তা খোলা রাখতে চাইছেন? মাঝে তো শুনছিলাম উনি ওখানে চলে যাবেন। ওর মেয়েকেও তো ইডি ডেকেছে।

নিজস্ব ভঙ্গিতে বিশ্লেষণের এই কথোপকথন থেকে ছিটকে আসা শব্দগুলো আশেপাশে যাদের কানে যাচ্ছিল, তাঁদের মধ্যে থেকে পাশে এসে দাঁড়ানো নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই যুবক এবার যোগ দিলেন আলোচনায়। ওঁরা বললেন, কর্পোরেশনের জলের সংযোগ থেকে স্নানের জায়গা বস্তিতে ফ্ল্যাট তৈরি, যা যা সুবিধে এখন দেখছেন সবটাই রূপাদির আমলে করা। ওদের জিজ্ঞাসা করা হলো, বস্তির উন্নয়নের জন্য আপনাদের বিধায়ক ‘দাদা’ কি কি করেছেন আর কি কি করেন নি, কেন করেননি সেটা সামনাসামনি তৃণমূলের ছেলেদের জিজ্ঞেস করেছেন নাকি। উত্তর এলো, কি দরকার। হিসাব কিতাব ভোটের দিন পুরো করে দেব। ওরা তো কথায় কথায় ৩৪ বছরের কথা তোলে। আটবারের বিধায়ক মানে তো পাঁচ আষটে ৪০ বছর। সেটাতো আরও বেশি দিন!

ডিলিমিটেশন’র পর মানিকতলা কেন্দ্রের সঙ্গে বড়তলা কেন্দ্রের সংযোগ ঘটে। অর্থাৎ কলকাতা কর্পোরেশনের মোট আটটি ওয়ার্ডকে নিয়ে গঠিত আজকের মানিকতলা। ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মানিকতলার বিধায়ক ছিলেন রূপা বাগচী। শুধু পাঁচ বছর বিধায়ক থাকার খতিয়ান নয়, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের তিন বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর হিসেবে রূপা বাগচীর ভূমিকা কি ছিল তা গড়গড় করে বলে যেতে পারেন ঝুপড়ির বাসিন্দা থেকে বাসন্তী কলোনির মানুষও, নন্দন বাগান বস্তি থেকে খালপাড়ের মৃৎশিল্পীরা। তাই মধ্যবিত্ত পাড়া থেকে অনিশ্চয়তাকে সম্বল করে দিনগুজরান করা ঝুপড়ি, বস্তিবাসীর মহল্লা-সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী রূপা বাগচীর প্রচার মিছিল যেখানেই রাস্তা পেরোচ্ছে সেখানে পথে নেমে আসছেন। স্লোগান দিচ্ছেন। ব্যস্ত রাস্তায় একটু ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। কৃতজ্ঞতায় তাঁরা জড়িয়ে ধরছেন প্রার্থীর হাত। যত্ন করে পরিয়ে দিচ্ছেন মালা, ছুঁড়ে দিচ্ছেন ফুল। রাস্তা আগলে দাঁড়াচ্ছেন তাদের প্রিয় রূপাদির। দাঁড়াচ্ছেন কৃতজ্ঞতা জানাতে। আগ্রহ নিয়ে শুনছেন সংযুক্ত মোর্চার বিকল্প কর্মসূচির কথা।

রূপা বলছেন সেসব। তাঁদের বলছেন, কম খরচে সবার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সুবিধার কথা, বেকার ছেলেমেয়েদের চাকরি ও সরকারি শূন্য পদে নিয়োগের কথা, সঠিক সময়ে টেট, এসএসসি পরীক্ষা নিয়মিত হবার কথা, বস্তিতে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাসকারীকে এক টাকার বিনিময়ে ৯৯ বছরের লিজ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবার কথা, প্রোমোটাররাজ শেষ করে বস্তি উচ্ছেদ রুখে দেওয়ার কথা, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের ভরতুকির কথা, মেয়েদের সম্মান ও মজুরির কথা, খেটে খাওয়া মানুষের ন্যূনতম ২১ হাজার টাকা মাসিক মজুরির কথা, বেসরকারি স্কুলের ফি কমানোর কথা। মানুষ আগ্রহ নিয়ে বাম প্রচারের লিফলেট পড়ছেন। প্রশ্ন করছেন বিভিন্ন বিকল্প সম্ভাবনার বাস্তবতার কথা জানতে। পরিকল্পনার কথা জানতে। দীর্ঘদিনের জনপ্রতিনিধি রূপা বাগচী তাদের বুঝিয়ে উত্তর দিচ্ছেন সহজ করে, প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া বা না শোনার ভান করে নয়।

খাল ধারের মৃৎশিল্পী সুবল পাল বলছিলেন ,তাদের জন্য কি করেছেন তাঁদের রূপাদি। আমরা এখানে রয়েছি তিন পুরুষ ধরে। ঠাকুরের মূর্তি গড়ি। শুকানোর জন্য রাখা মূর্তি রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে আমাদের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে আগে। রূপাদি এখানে আমাদের স্থায়ী কাঠামো গড়ে দিয়েছেন। এখন আমরা মূর্তি ওখানেই রাখি। আগের মতো লোকসান হয় না আমাদের। দিদি আমাদের নিয়মিত খোঁজখবর নেন, আসেন এখানে।

একইরকম কৃতজ্ঞতার কথা বলছিলেন আগুন লেগে পুড়ে যাওয়া বাসন্তী কলোনির মানুষ। প্রায়শই আগুন লেগে কলকাতায় বস্তি পুড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রচুর। এক দশক আগে বাসন্তী কলোনি এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাবার পর সেখানে পাকা বাড়ি করে তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে বামফ্রন্ট আমলেই। তাই মানুষ বলছেন অনেক ঠকেছেন তাঁরা বিশ্বাস করে। এবারে তাই কোনো চোরেদের দল নয়, খুনেদের দল নয়, তাদের পছন্দ লাল ঝান্ডাকেই।

ক্যানাল ইস্ট রোড থেকে ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে যাবার জন্য পুরনো ব্রিজ আগে ছিল অপরিসর বিপজ্জনক ও দুর্ঘটনাপ্রবণ। বিবেকানন্দ রোড থেকে কাঁকুড়গাছি - গাড়ি রাস্তায় যানজট নিত্য সমস্যা ছিল।রূপা বাগচী এলাকার বিধায়ক থাকার সময়ে উদ্যোগ নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করেন। যা রূপার সময়ে নতুন দু’টি ব্রিজ তৈরি করার জন্য তুলনায় কমেছে। তবে তাঁর কৃতিত্বে ভাগ বসাতে ব্রিজ উদ্বোধনের আগেই দীর্ঘদিনের বিধায়ক থাকা সাধন পান্ডে তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে উদ্বোধনের চেষ্টা করার মতো যে কুরুচিকর কাজ করেছিলেন তা এলাকার অনেকেই ভুলে যাননি। এর পাশাপাশি বাইপাস থেকে ফ্লাইওভার যা ভিআইপি রোডের সঙ্গে সংযোগ সেতু হিসেবে নির্মিত তা করেছিলেন বামফ্রন্ট বিধায়িকা হিসেবে রুপা  বাগচী। উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

প্রচারের বিভিন্ন মাধ্যমে পথসভা থেকে সোস্যাল মিডিয়ায় রূপা বাগচি বলছেন, নির্বাচিত হলে তিনি এলাকায় কলেজ এবং স্কুল স্থাপন করার চেষ্টা করবেন। কারণ গুরুদাস কলেজের পর এখানে আর কোনো কলেজ নেই। অথচ পড়ুয়াদের চাপ বাড়ছে। কাঁকুড়গাছি থেকে হাডকো পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় জল জমার সমস্যা থেকে মুক্ত করার জন্য নতুন যে পাম্পিং স্টেশন তৈরি করেছিলেন তার দরুন এখন জল জমাটা কমলেও তার রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা আছে এই সরকারের তরফে। তিনি শুনেছেন কর্পোরেশন থেকে দেওয়া বিধবা ভাতা সহ অন্যান্য ভাতা - আগে যে মানুষ দলমত নির্বিশেষে যেভাবে পেতেন এখন তা পান না। দলীয় আনুগত্য এবং কাটমানি সেখানে একমাত্র বিবেচ্য। এসব দলবাজি বন্ধ করতে চান তিনি। তাঁর এহেন বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন নতুন প্রজন্মের ভোটাররা। পথসভা জনসভায় তাঁরা ভিড় করে আসছেন। নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছেন বামফ্রন্ট প্রার্থীর বিশ্লেষণ। তাই রূপা যখন প্রশ্ন তুলছেন ৪০ বছরের বিধায়ক আর দু’বারের মন্ত্রী তাঁর দলের ১০ বছরের সরকার থাকাকালীন এলাকার মানুষকে কি নতুন দিলেন দিতে পারলেন, তার উত্তর জোগাচ্ছে না অতি বড়ো তৃণমূল সমর্থকের মুখেও। তাই রূপাকে থামাতে ছেঁড়া হচ্ছে পোস্টার, খোলা হচ্ছে ফ্ল্যাগ, ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে হেরে যাবার ভয় থেকেই। তৃণমূল যে বেকায়দায় তার সব লক্ষণই স্পষ্ট।