E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২৩ এপ্রিল, ২০২১ / ৯ বৈশাখ, ১৪২৮

মেলা-উৎসব নয় - বেলেঘাটা কেন্দ্রের মানুষ চায় প্রকৃত উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান

সন্দীপ দে


বেলেঘাটা কেন্দ্রে প্রচারে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সিপিআই(এম)’র রাজীব বিশ্বাস।

বেলেঘাটা কেন্দ্রের মানুষ উন্নয়নের নামে মেলা-উৎসব, ফুটপাথ আর রাস্তা দখল করে মূর্তি বসানো এবং বস্তি উচ্ছেদ করে অপরিকল্পিত নির্মাণ চায় না। এই কেন্দ্রের মানুষ চায় প্রকৃত উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান। সেই সঙ্গে তাঁরা চায় জোরজুলুম, চোখ রাঙানি বা ঘরদোর ভাঙচুর, মারধর ইত্যাদির অবসান হোক - ফিরে আসুক সুস্থ-গণতান্ত্রিক পরিবেশ। বেলেঘাটা অঞ্চলের সমস্ত অংশের মানুষের দীর্ঘদিনের এই দাবিগুলিকে সামনে রেখেই নির্বাচনী প্রচার সংগঠিত করছে সংযুক্ত মোর্চা। এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সিপিআই(এম)’র রাজীব বিশ্বাস। তিনি এই এলাকার মানুষের কাছে খুবই পরিচিত মুখ। এই কেন্দ্রের অন্তর্গত ৩৩নম্বর ওয়ার্ড থেকে দু’বার কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছিলেন বোরো কমিটির চেয়ারম্যান। কাউন্সিলর হিসাবে তাঁর ভূমিকার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে এবং মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে, সমস্যা সমাধানে রাজীব বিশ্বাসের আন্তরিক প্রচেষ্টার কথা জানেন সকলেই।

তৃণমূলের দশ বছরের জমানায় গরিব শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজির সঙ্কট তীব্র হয়েছে। এই সময়কালে নতুন কোনো কল-কারখানা তৈরি হয়নি। উল্টে শাসকদলের দৌরাত্ম্যে ও সরকারের উদাসীনতায় ছোটো-মাঝারি অনেক কারখানার ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে। এখানে ই এম সি, কোলে বিস্কুট কারখানা, সেরামিক কারখানা, পটারি শিল্প বন্ধ অনেকদিন। এক সময় ঘরে ঘরে বাল্ব তৈরি হতো। তাও বন্ধ হয়ে গেছে। রাজাবাজার অঞ্চলে যে অসংখ্য ক্ষুদ্র শিল্প ছিল, বিশেষ করে কার্ডবোর্ড বাইন্ডিং, কাটিং, চামড়ার কাজ বন্ধ হওয়ায় চরম দুর্ভোগের কবলে পড়েছেন ব্যাপক অংশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। এখানে যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হ্যান্ড গ্লাভস তৈরি হয় - যা বিদেশে পর্যন্ত রপ্তানি হয়, সেই কারখানা টিকে আছে। সেই কারখানাও গত লকডাউনের সময়ে বিপন্ন হতে বসেছিল। এখন সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠে কোনোভাবে চলছে।

এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থার যখন এমনই করুণ দশা, তখন এই অঞ্চলের রিকশা ও অটোচালক, হকার, ভ্যান চালকদের উপর চলছে শাসকদলের অমানবিক আচরণ ও নানা আক্রমণ। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই আক্রমণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। এদের ওপর জোরজুলুম, বেপরোয়া জরিমানা ও তোলাবাজি, খেয়ালখুশি মতো কাজ বন্ধ করে দেবার মতো ঘটনা সীমা ছাড়িয়েছে। পাশাপাশি তৃণমূল জোর খাটিয়ে অটো-রিকশা ইউনিয়নগুলিকে দখল করে নিয়েছে। নিজেদের ইচ্ছেমতো অটোচালক ও হকারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চালু করেছে। ফলে স্বল্প আয়ের এই মানুষদের রুটি-রুজির উপর মারাত্মক আক্রমণ নেমে এসেছে।

গরিব নিম্নবিত্ত মানুষদের যখন এমনই বিপন্ন অবস্থা, তখন তাদের দিকে না তাকিয়ে, এই কেন্দ্রের তৃণমূলী বিধায়ক সাড়ম্বরে হরেকরকমের মেলা, ইলিশ উৎসব, খাদ্য উৎসবের নামে প্রতিবছর বিপুল অর্থের অপচয় করে মোচ্ছব করে যাচ্ছেন। এখানকার ৮টি ওয়ার্ডই তৃণমূলের দখলে। কিন্তু পৌর পরিষেবার দিকে কারও নজর নেই। এরা ব্যস্ত আখের গোছাতে। তৃণমূলী কাউন্সিলররা যথেচ্ছভাবে বেআইনি নির্মাণে মদত দিয়ে প্রতি বর্গফুটে ৫০০ টাকা করে কাটমানি নিচ্ছে বলে এলাকায় অভিযোগ। বামফ্রন্ট আমলে ঠিকা টেনান্সি আইনে বস্তিবাসীদের বসবাসের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এদের আমলে সেই বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করে প্রোমোটাররাজ ও সিন্ডিকেটরাজে মদত দিচ্ছে শাসকদল। এর মধ্য দিয়ে বেআইনি উপায়ে বিপুল টাকার কারবার চলছে। অথচ বস্তিবাসীদের জন্য পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান - কোনো দিকেই নজর নেই ওদের। একদিকে দলীয় মদতে প্রোমোটারদের বেআইনি নির্মাণের সুযোগ তৈরি করা, অন্যদিকে বস্তি অঞ্চলে ন্যূনতম পরিষেবা না দিয়ে গরিব শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজি কেড়ে নেওয়া। এদের আমলে উন্নয়ন হলো, বিভিন্ন রাস্তায় সারি সারি মূর্তি বসানো আর আলো লাগানো।

২০১১ সালের পর থেকে এই কেন্দ্রের মানুষ শাসকদলের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের সাক্ষী থেকেছেন। তারই পাশাপাশি মানুষ দেখেছেন ২০১৫ সালের পৌর নির্বাচনে এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ব্যাপক সন্ত্রাস ও ভোট লুট। বিশেষ করে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের পর সিপিআই(এম)’র কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা-আক্রমণ, ঘরবাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা মারাত্মক আকার নেয়। প্রায় পাঁচ শতাধিক দুষ্কৃতীকে জড়ো করে তৃণমূলীরা পার্টিনেতা মৃণাল রায়চৌধুরীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। কয়েকবার আক্রান্ত হন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী রাজীব বিশ্বাস। তাঁর বাড়িতেও হামলা হয়েছে। এলাকায় এমন আরও অনেক হামলার ঘটনা ঘটেছে। বেপরোয়াভাবে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। সিপিআই(এম)-কে সমর্থন করার জন্য গায়ের জোরে হকার ও অটো চালকের রোজগার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এক কথায় মানসিক, শারীরিক ও আর্থিকদিক থে‍‌কে যেভাবে আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তৃণমূল, তা অনেক ক্ষেত্রেই সত্তরের দশকের আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। এর ফলে বিনষ্ট হয়েছে এলাকার সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ। এই অবস্থার মুখে দাঁড়িয়ে সিপিআই(এম) মানুষের রুটি-রুজির স্বার্থে, কর্মসংস্থান ও সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ অটুট রাখতে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনের পথে থেকেছে।

এই অঞ্চলের মানুষের অভিজ্ঞতায় রয়েছে, করোনা সংক্রমণের প্রকোপে অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে গরিব শ্রমজীবী মানুষের যখন অসহায় অবস্থা, তখন পাশে ছিলেন একমাত্র বামপন্থীরাই। তখন সীমিত সাধ্য নিয়েই সিপিআই(এম) সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের কর্মীরা চাল, ডাল, তেলসহ শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়েছেন বিপন্ন মানুষদের বাড়িতে। একই সঙ্গে করোনা মোকাবিলায় বিজ্ঞানসম্মত প্রচার, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া এবং সুরক্ষা সরঞ্জাম তুলে দিয়েছেন বিভিন্ন অঞ্চলে। এছাড়া বস্তিবাসীদের জন্য রান্না করা খাবার বিলি করেছেন, অসুস্থ মানুষদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন, ওষুধ পৌঁছে দিয়েছেন। অথচ বামপন্থীদের এই মানবিক উদ্যোগেও বাধা দিয়েছে পুলিশ ও শাসকদল। এমনকি বিপন্ন মানুষদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেবার জন্যও পার্টি কর্মী ও সমর্থকদের নামে মামলা করেছে।

অনদিকে শাসকদল সরকার ও কর্পোরেশনের যে ন্যূনতম সাহায্য এসেছে তা নিজেদের নামে বণ্টন করেছে। সবকিছুই দেখেছেন মানুষ। মানুষ এটাও বুঝেছেন যে, বিপদে, দুঃসময়ে কারা থাকেন মানুষের পাশে।

এমনই একটি অবস্থায় সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে প্রকৃত উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও প্রচারে তুলে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় যে অপরিকল্পিত নির্মাণের ফলে পৌর পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে তার দিকে দৃষ্টিপাত করা, জল, নিকাশি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করা, প্রমোটাররাজকে মদত দিতে সুকৌশলে বস্তি উচ্ছেদ বন্ধ করা, বস্তিবাসীদের বসবাসের অধিকার সুনিশ্চিত করা, সিন্ডিকেট ও কাটমানির কারবার রদ করা ইত্যাদি।

এছাড়া বামপন্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি - ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত উপেন্দ্র মেমোরিয়াল হাসপাতাল, যা অনেকদিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে, সেটা পুনরায় চালু করা অথবা ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে থাকা এই হাসপাতালের জমিতে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব গড়ে তোলা যাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। বর্তমানে এই হাসপাতাল চত্বরে নানা অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে। ফলে এলাকায় পরিবেশও বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়াও বামপন্থীদের দাবি - বি সি রায় পোলিও হাসপাতালকে সময়ের প্রয়োজনে অর্থোপেডিক হাসপাতালে পরিণত করা। বেলেঘাটা খালের সংস্কারের দাবিও উঠেছে সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে।

এই দাবিগুলির পাশাপাশি সকলের জন্য রেশন ব্যবস্থা, সব শূন্যপদে নিয়োগ, কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দৈনিক ৭০০ টাকা, স্বাস্থ্যসাথির ধাঁধা তৈরি না করে সকলের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, একশো দিনের প্রকল্পকে রাজ্যের উদ্যোগে ১৫০ দিনে পরিণত করা এবং তা শহরাঞ্চলে প্রসারিত করা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখার দাবি নিয়ে এলাকায় এলাকায় প্রচার করছেন সংযুক্ত মোর্চার কর্মীরা। পার্টির নানা কর্মসূচির পাশাপা‍‌শি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে প্রার্থী রাজীব বিশ্বাসের সক্রিয় ভূমিকা এবং সমস্ত অংশের মানুষ বিশেষ করে গরিব শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে প্রতিনিয়ত জড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে তাঁর পরিচিতির পরিসর অনেকটাই বেড়েছে।

একদিকে তৃণমূলের অপশাসন, দুর্নীতি, নানা অপরাধমূলক কার্যকলাপ, গণতন্ত্র হত্যা; অন্যদিকে ‍‌বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতি - এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে সংযুক্ত মোর্চার প্রচারে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, মানুষের রুটি-রুজির সংস্থান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সর্বত্রই বিশেষ সাড়া মিলছে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে বিকল্প ভাবনার প্রকাশও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।