E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২৩ এপ্রিল, ২০২১ / ৯ বৈশাখ, ১৪২৮

কমরেড লেনিনের শিক্ষা

চাই জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক

অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়


জন্মঃ ২২ এপ্রিল ১৮৭০    মৃত্যুঃ ২১ জানুয়ারি ১৯২৪

সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির অত্যাবশ্যকীয় কাজের অঙ্গ বলে মনে করতেন বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিন। তিনি বলতেন, পার্টির কাজ হচ্ছে জনগণকে পরিচালিত করা। দেশের ব্যাপক জনগণকে আন্দোলনের মধ্যে নিয়ে আসা। তাই যেখানেই জনগণকে পাওয়া যাবে সেখানেই পার্টিকে কাজ করতে হবে, তাদের সংগ্রামের মধ্যে টেনে আনতে হবে। আর জনগণের চেতনার স্তরটা ভালভাবে বুঝতে হবে। পার্টির কাছে যে-পন্থাটা অচল, জনগণের কাছেও সেই পন্থাটা অচল বলে ধরে নেওয়াটা হবে মারাত্মক ভুল। সব সময়েই লক্ষ্য করতে হবে, জনগণের চেতনার স্তরটা কোথায়। তাদের চেতনার স্তর অনুযায়ীই পার্টিকে আশু কর্মপন্থা নির্ণয় করতে হবে। নিজ নিজ দেশের বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে, জনগণের চেতনার মানের দিকে লক্ষ রেখেই বাস্তব পরিস্থিতি উপযোগী কৌশল ও কর্মপন্থা নির্ণয়ের শিক্ষা দিয়েছেন লেনিন।

পার্টিকে কোথায় কাজ করতে হবে, এ সম্পর্কে লে‍‌নিনের শিক্ষা হলোঃ ‘‘যেখানেই জনসাধারণ আছে নিশ্চিতভাবে সেখানেই কাজ করতে হবে। বিশেষ করে যে-সব প্রতিষ্ঠান, সমিতি ও সংগঠনে শ্রমিক ও আধা-শ্রমিক জনতা আছে - তা সে যতই প্রতিক্রিয়াশীল হোক - সেখানেই প্রচণ্ডতম বাধাকে অতিক্রম করেও নিয়মিত অধ্যবসায়ের সঙ্গে, অবিচল ও ধীরভাবে প্রচার ও আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য, সব ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’’ (বামপন্থী কমিউনিজম - শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা)। অগ্রণী বাহিনী হিসাবে পার্টি যতই চমৎকার ও সুসংগঠিত হোক না কেন, পার্টির বাইরের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে এই সম্পর্ক বহুগুণ বাড়াতে ও নিবিড় করতে না পারলে পার্টি বাঁচতে পারে না বা বাড়তে পারে না। এ সম্পর্কে লেনিনের শিক্ষা হলোঃ ‘‘পার্টি অপরাজেয় হতে পারে যদি পার্টি মেহনতি জনগণের সঙ্গে ব্যাপকতম সংযোগ রাখতে পারে - প্রধানত সর্বহারা শ্রেণির সঙ্গে হলেও, সর্বহারা শ্রেণি ছাড়াও জনগণের অন্যান্য অংশের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে এবং প্রয়োজনমতো কতক পরিমাণে সর্বহারা, অ-সর্বহারা সমগ্র জনগণের সঙ্গে এক হয়ে যেতে পারে।’’ (বামপন্থী কমিউনিজ...)

জনগণকে পরিচালিত করতে হলে পার্টিকে জনগণের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, তাদের শ্রেণি চেতনার স্তরটা বিচার করে দেখতে হবে। জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সংযোগ রেখেই পার্টিকে তার আশু কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। লেনিন বারবার এই কথাই বলেছেন যে, ‘‘বিশেষ বিবেচনার সঙ্গে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে সমগ্র শ্রেণির (শুধু ঐ শ্রেণির অগ্রগামী কমিউনিস্টদের নয়) শ্রেণি চেতনা ও প্রস্তুতির প্রকৃত অবস্থাকে’’। (বামপন্থী কমিউনিজম...)

এ সম্পর্কে জার শাসিত রাশিয়ায় বিভিন্ন সময়ে সেখানের ডুমা বা পার্লামেন্টে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার অভিজ্ঞতাকে তিনি উদাহরণ হিসাবে আমাদের কাছে রেখে গেছেন। বাস্তব পরিস্থিতি এবং জনগণের চেতনার স্তর সঠিক অনুধাবন করেই লেনিন বিভিন্ন সময়ে কর্মপন্থা নির্ণয় করেছিলেন। লে‍‌নিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা ১৯০৫ সালে জারের পরামর্শদাতা পার্লামেন্ট বয়কট করেছিল। সেই কৌশল গ্রহণের নানাবিধ কারণের সাথে লেনিন এটাও উপলব্ধি করেছিলেন যে, সেই সময় জনগণ জারের পার্লামেন্টের প্রতি কোনো আস্থা রাখতে রাজি ছিল না এবং তারা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মেনশেভিক এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলি জারের পার্লামেন্টে অংশ নিয়েছিল। অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছিল, ১৯০৫ সালের অক্টোবর বিপ্লবের বন্যায় সেই পার্লামেন্ট ভেসে গিয়েছিল। লেনিন যে-বাস্তব পরিস্থিতি এবং জনগণের মেজাজ বুঝে বয়কটের স্লোগান দিয়েছিলেন, তা হলো, লেনিনের কথাতেই ‘‘আমরা বাস্তব অবস্থাটা ঠিক ধরতে পেরেছিলাম। যে-অবস্থা গণধর্মঘটগুলিকে তাড়াতাড়ি রাজনৈতিক ধর্মঘটে রূপান্তরিত করছিল, তাকে আবার নিয়ে যাচ্ছিল বিপ্লবী ধর্মঘটে এবং শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র অভ্যুত্থানে।’’

১৯০৫ সালে পার্লামেন্টের বলশেভিক বয়কট বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণিকে অতি মূল্যবান রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছিল, দেখিয়েছিল যে, আইনসম্মত এবং বেআইনি, পার্লামেন্টীয় পদ্ধতির প্রত্যাখ্যান প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, এমন কি হয়ে পড়ে অনিবার্য। কিন্তু অন্য অবস্থায় ও অন্য পরিস্থিতিতে এই অভিজ্ঞতার অন্ধ অনুকরণ ও নির্বিচার প্রয়োগ নিশ্চিতভাবেই অত্যন্ত বড়ো রকমের ভুল।

এই ভুল ১৯০৮ সালে বলশেভিক পার্টির একাংশ যারা নিজেদের ‘বামপন্থী’ বলতেন তারা করেছিলেন। ১৯০৫ সালের অভিজ্ঞতাকেই তারা অন্ধভাবে অনুকরণ করতে গিয়েছি‍‌লেন। তখন পরিস্থিতি যে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল, ১৯০৫ সালের ম‍‌তো ছিল না, জনগণের মানসিকতা ও প্রস্তুতি যে একই রকম ছিল না - এ সব কথা তারা বুঝতে চাননি। বাস্তব পরিস্থিতি এবং জনগণের চেতনা বুঝতে না পারার এই ভুল ছিল বামপন্থী বিচ্যু‍‌তি। লেনিন তখন ঐ বিচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াই করে, পার্টিকে সামাল দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, জনগণের চেতনাকে উন্নত করতেই লড়াইয়ের আইনসঙ্গত এবং আইন বহির্ভূত রূপগুলিকে মিলিত করাটাই আবশ্যিক। প্রয়োজনে চরম প্রতিক্রিয়াশীল সংসদেও কমিউনিস্টদের অংশ নিতে হয় যদি জনগণের চেতনা বৃদ্ধিতে এবং তাদের সংগঠিত করতে তা উপযোগী হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্র্টির ইতিহাস (বলশেভিক) পুস্তকে এ সম্পর্কে বিস্তৃত লিপিবদ্ধ করা আছে।

লেনিন এই শিক্ষা‍‌ই দিতে চেয়েছেন, পার্টি যদি জনগণের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়, তবেই পার্টি জনগণকে সঠিকভাবে এবং সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। জনগণের কাছ হতে শিক্ষা গ্রহণের অর্থ হলো, জনগণকে অনুকরণ করা নয়, জনগণের ব্যবহারিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে, আন্দোলনের ক্ষেত্রে যা কিছুরই উদ্ভব ঘটে সেগুলি বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা এবং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জনগণ যে-জ্ঞান অর্জন করেছে সেই জ্ঞান আত্মস্থ করা। জনগণকে শিক্ষাদান করার উদ্দেশেই জনগণের কাছ থেকে শিখতে হবে। জনগণকে শিক্ষাদান করার অর্থ হলো তাকে শ্রেণি সচেতন করা, তাদের জীবনের শোষণ-বঞ্চনার জন্য দায়ী কারা, বর্তমান শ্রেণিশাসনের পরিবর্তন কেন প্রয়োজন ইত্যাদি সম্পর্কে তার বোধ জাগ্রত করা এবং শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত হতে শেখানো। তার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনার স্ফূরণ ঘটানো। শ্রমিকশ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন থেকে সমাজতান্ত্রিক চেতনা গড়ে উঠতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ গড়ে উঠতে পারে বিজ্ঞান থেকে। রাজনৈতিক জ্ঞান, বিপ্লবী তত্ত্ব, সমাজতান্ত্রিক চেতনা বাইরে থেকে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে প্রবিষ্ট করতে হয়। লেনিন তাঁর ‘কি করতে হবে’ বইতে লিখেছেন, সমাজতান্ত্রিক চেতনা এমনই একটা বস্তু যাকে সর্বহারার শ্রেণি সংগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে বাইরে থেকে। এর ভিতর থেকে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে ওঠেনি। শ্রমিকশ্রেণিকে অর্থনৈতিক আন্দোলনের গণ্ডি থেকে বার করে এনে তার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা সঞ্চারিত করলেই তবে সে বিপ্লবী সংগঠনের মধ্যে সমবেত হবে এবং অগ্রণী শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা পালন করতে পারবে। শ্রমিকদের সংগঠনের মধ্যে থেকেই শ্রেণি সচেতন এবং সমাজতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে-ওঠা শ্রমিকদেরই বিপ্লবী সংগঠনে, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টিতে টেনে আনতে হবে। এই হচ্ছে সংক্ষেপে কমিউনিস্ট পার্টির মার্কসীয়-লেনিনীয় নেতৃত্বের মূল কথা।

এবছরের ২২ এপ্রিল লেনিনের ১৫২তম জন্মদিবসে তাঁর বিপ্লবী শিক্ষাসমূহকে স্মরণ করা একান্ত প্রয়োজনীয়।