E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা / ২৩ এপ্রিল, ২০২১ / ৯ বৈশাখ, ১৪২৮

মোদীজি’র ওড়াকান্দি গমন এবং কিছু প্রশ্ন উত্থাপন

নীতীশ বিশ্বাস


আমার বাড়ি ওড়াকান্দির উত্তর পূর্বে সাড়ে তিন মাইল দূরে মাঝিগাতি গ্রামে। আমি ওড়াকান্দি মিড হাইস্কুলে ১৯৬২ সালে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই। হোস্টেলে থাকতাম। এ স্কুলের গৌরবগাথা আমাদের হৃদয়ে গাথা হয়ে আছে।

এই ওড়াকান্দিতে এবার গিয়েছিলেন (২৭ মার্চ, ২০১১) ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরএসএস’র মহাসেবক, বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী মহাশয়। যা আমাদের কাছে বিশেষ ব্যাপার। এই সূত্রে বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে ঠাকুরনগরের সঙ্গে ওড়াকান্দিও জায়গা করে নিল। এ আমাদের আনন্দের কথা। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল এই ভেবে যে, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ তৎকালীন সময়ের সামাজিক নিষ্পেষণের যে অন্ধকার থেকে পতিত জাতি-সম্প্রদায়গুলিকে উদ্ধার করেছিলেন তার মুখ্য প্রতিবন্ধক ছিল বর্ণবাদ বা মনুবাদ। আজ ভারতীয় রাজনৈতিক আকাশ সেই মনুবাদের গেরুয়া আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে। তার প্রধান প্রতিনিধি ঘুরে গেলেন আমাদের স্বপ্নের পুণ্যভূমি ওড়াকান্দিতে। যার পেছনে আছে রাজনীতি। আছে পশ্চিমবঙ্গের চলমান আট দফা ভোট (মার্চ-এপ্রিল, ২০২১)। যার সরাসরি লক্ষ্য এই উদ্বাস্তু মতুয়া ভোট। যার নমঃশূদ্র জনসংখ্যাই ৩৫,০০,০০০। (সূত্রঃ জনগণনা ২০২১)।

মতুয়া রাজনীতিঃ প্রত্যক্ষত গত ২০০৮ থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটের হিসাব-নিকাশ একটি জটিল অঙ্ক হয়ে উঠেছে। সেই সব উত্থান-পতনের মধ্যে গত ২০১৯’র ৩০ জানুয়ারি, ভারতে মতুয়া সম্প্রদায়ের হেড কোয়ার্টার পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী। তাঁর মতো কোনো বড়ো পদাধিকারী এর আগে কখনো সেখানে আসেননি। এসে প্রতিশ্রুতি দেন লোকসভা নির্বাচনে জিতলেই উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তা দেওয়া হয়নি। যা নিয়ে ঠাকুর বাড়ির দু’পক্ষই ইতিমধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এখানে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে একথা বলা অবান্তর হবে না যে, এই বিজেপি-ই ২০০৩ সালে নাগরিক আইনের যে সংশোধনী পাশ করেছিল, তা ছিল বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্য এ যাবৎকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক অন্যায় আক্রমণ, এবং এরফলেই ১৯৪৮-এর পরে আসা বাঙালি উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে পড়ে। অর্থাৎ যে বিজেপি অন্যায়ভাবে এই সর্বনাশ করলো বা প্রাণ নিলো, আর আজ সেই তারাই এসেছে প্রাণদাতার ছদ্মবেশে। সে ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের মতুয়াদের বড়ো এক অংশ ভোট দিয়ে লোকসভায় জিতিয়ে দিল এই হন্তারক বিজেপি-কেই। এই ভোট পাওয়ার অপকৌশল মোদীজিকে পেয়ে বসেছে, তাই ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে শুরুতেই তিনি আর একটি কূট-কৌশলী চাল দিলেন - মতুয়া ধর্মের আদি কেন্দ্র তথা মহাধাম বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ মহকুমার কাশিয়ানি থানার অধীন এই মতুয়াদের আদিধাম ওড়াকান্দিতে। সেখানে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিলেন ওড়াকান্দি গ্রামে একটি প্রাথমিক স্কুল করে দেবেন। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা উন্নত টেকনোলজির কোনো সেন্টার অব একসেলেন্স নয়। একটি প্রাথমিক স্কুল। হায়, দলিতদের প্রতি ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এমন উপেক্ষা! তাঁদের এখনও ওরা কী কাঙাল ভাবেন?

মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুরের (১৮১২-১৮৭৭) কর্মক্ষেত্র ছিল এই ওড়াকান্দি। তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৬-১৯৩৭) ছিলেন পিতার যথার্থ দার্শনিক উত্তরাধিকারী ও মহান কর্মযোগী। মানবতাবাদী ও কর্মই ধর্ম ভিত্তিক মতুয়া ধর্মে ছিল না জাত ও ধর্মের নামে বিভাজন। এই বিশাল মাপের সংগঠকের ধ্যান-জ্ঞান ছিল ভৌগোলিক ও প্রশাসনিকভাবে কাদাজলে ডোবা এই অশিক্ষা ও বর্ণ নির্যাতনের অন্ধকারে ডুবে থাকা দলিত দরিদ্র সর্বহারা মানুষদের জাগরণ ও সার্বিক উন্নয়ন। সে সময় বাংলায় নমঃশূদ্র বা চণ্ডালদের সংখ্যা ছিল ১৬-১৭ লক্ষ। তার সঙ্গে ছিল ধর্মান্তরিত মুসলমান ও অন্যান্য অনগ্রসর অবর্ণ হিন্দুরা। সবাইকে তিনি ঐক্যবদ্ধ ও উন্নত করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ বহুত্ববাদীদের মিলন কেন্দ্র ছিল হরিচাঁদের এই মহাধাম।

বিশ্বের প্রথম দীর্ঘতম অহিংস সাধারণ ধর্মঘটঃ সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে, তাদের প্রভাবে ১৮৭৩ সালে ফরিদপুর ও বরিশাল জেলার চণ্ডালের সাম্য, বৈষম্যহীনতা ও আত্মমর্যাদার জন্য প্রায় ৬ মাসের অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন। ইতিহাসে যা বিশ্বের প্রথম অহিংস সাধারণ ধর্মঘট বলে আজও স্বীকৃত।

প্রথম তেভাগা আন্দোলনঃ ১৯০০ সালেই গুরুচাঁদ ঠাকুর পূর্ববাংলার এইসব অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন শুরু করেন গরিব হিন্দু-মুসলমান ভাগচাষিদের স্বার্থে। তিনি ১৯০৬ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসামের গভর্নর স্যার ল্যান্সলট হেয়ারের সঙ্গে দেখা করে চণ্ডালদের শিক্ষা ও চাকুরির দাবি উত্থাপন করেন। এর ফলে প্রথমে নমঃশূদ্রদের সে সাফল্য আসে ও পরে ৩১টি অনুন্নত অন্য শ্রেণি সে সুযোগ পায়। তিনি বলতেনঃ ‘‘নমঃশূদ্র কূলে জন্ম হয়েছে আমার/ তবু বলি আমি নহি নমঃর একার। ..শিক্ষা হারা, দীক্ষা হারা, ঘরে নাহি ধন। / এসবে জানি আমি আপনার জন।/’’ এসব কাজই তাঁর প্রাণ।

আমূল ভূমি সংস্কারের দাবি উত্থাপনঃ এরপর ১৯২২ সালে জুন মাসে বরিশালের পিরোজপুরে বিশাল কৃষক সম্মেলন করে বাংলায় সর্বপ্রথম সংগঠিতভাবে আমূল ভূমি সংস্কারের দাবি তোলেন। ১৯৩৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের ঘাটালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। গুরুচাঁদের চেষ্টায় চণ্ডালের বদলে লোকগণনায় নমঃশূদ্র লেখা শুরু হয় ১৯১১ সাল থেকে। ফরিদপুরের হিন্দু জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ এরা, তখন জেলার নমঃশূদ্র জনসংখ্যা তিন লক্ষ ৫৭ হাজার ৩৫৭ জন।

আগে কারাবাসের সময় জেলের ভিতরে নমঃশূদ্রদের দিয়ে মলমূত্রাদি বহনের বা পরিষ্কারের সব কাজ অন্যায়ভাবে করানো হতো। গুরুচাঁদের চেষ্টা ও আন্দোলনের ফলে তাও রোধ হয়। তিনি গরিব নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ঘরে বাল্যবিবাহ রোধ ও বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন।

বর্তমান গবেষক পণ্ডিতদের অভিমত হলো, হরি-গুরুচাঁদ ছিলেন গ্রামবাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। কারণ তাঁরাই বর্ণলাঞ্ছিত সমাজে তথা গ্রামের কাদাজলে শিক্ষা, সামাজিকন্যায় এবং আধ্যাত্মিক মানবতাবাদী চেতনার আগুন জ্বেলেছিলেন। পিছিয়ে রাখা সমাজের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মর্যাদা বা আত্মসম্মানবোধের নানামুখী প্রয়াস তাঁরাই শুরু করেন। শিক্ষা না দেবার হিন্দুধর্মের মনুবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাঁদের গার্হস্থ্য ধর্মের ডাক সমাজে এক বিপ্লবী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যার ফলে ঘরে ঘরে যেন শিক্ষার আলো।

বাংলার এই বিপ্লবী ধর্মমতের পীঠস্থানে গেলেন এমন এক মতাদর্শের মানুষ যাদের গুরু এমএস গোলওয়ালকর। ১৯৬০ সালে গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে, যেকোনো বর্ণের বিবাহিত মহিলার প্রথম সন্তানের বাবা হওয়া উচিত একজন নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ। যা ১৯৬১ সালে আরএসএস’র পত্রিকা অরগানাইজারেও ছাপা হ‌য়। হায়! এইসব হিটলারপন্থীদের থেকে আজকের এনকাউন্টারে খুনের সম্রাট যোগীদের যে দলিত ও নারী বিদ্বেষী ভূমিকা তা আমরা নির্মমভাবে প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করছি সারা দেশে। দলিত, সংখ্যালঘু, নারী নির্যাতন ও নিধনে তারা ভারতকে বিশ্বের কাছে নিচু করে দিচ্ছে। যা কুখ্যাত হয়ে আছে গুজরাট দাঙ্গা থেকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার মতো অজস্র ঘটনায়। এইসবের নাটের গুরু অভিনেতা প্রধানমন্ত্রী ওড়াকান্দি গিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন তা তো মতুয়া ধর্মমত নিয়ে পাহাড় প্রমাণ অজ্ঞতায় ভরা। কেবল তাই নয়, এই শম্বুক হত্যাকারী রাম-ভক্ত মোদীজি তাঁর মনের মধ্যে নিহিত বর্ণবাদী সংস্কার থেকে একগাদা নির্লজ্জ কাদা ছুঁড়ে দিলেন সেখানকার ভক্তদের মুখের উপর। কারণ, তিনি বললেন ওড়াকান্দি গ্রামের স্কুলের শ্রীবৃদ্ধি করবেন। আর উপহার দেবেন মাত্র একটি প্রাইমারি স্কুল।

উপসংহারঃ মতুয়া ভক্তরা একটু ভাবুন দুই বাংলা জুড়ে হরি-গুরুচাঁদের কৃপাধন্য শিষ্যরাই যেখানে হাজার হাজার স্কুল, কলেজ এমনকি আজ তাদের নামে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অন্য দেশে গিয়ে উপহার ঘোষণা করলেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটা বর্ণবাদী প্রধানমন্ত্রীর উপযুক্ত মনে হতে পারে। কিন্তু শিক্ষাগুরু গুরুচাঁদ ঠাকুর, যিনি তাঁর সময়েই ৩৯৫২টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন, সেই মহাধামে গিয়ে সেখানকার মানুষদের এবং সেই মহান ঐতিহ্যকে কি এ অপমান করা নয়? জানি না এরপরও দুই বাংলা ও সারা ভারতের একনিষ্ঠ মতুয়া ভক্তরা এই চপেটাঘাত কিভাবে গ্রহণ করবেন এবং কোন্‌ ভাষায় তাঁদের মহামানবের অপমানের উত্তর তারা প্রদান করবেন? এবং কবে? আমরা যারা সাধারণ মতুয়া অনুরাগী তারা এই বর্ণবাদী আচরণের তীব্র নিন্দা না করে পারছি না। পারছি না এই বর্ণবাদী আচরণের দ্বারা আমাদের মহামানবদের ঐতিহ্যের প্রতি এমন উপেক্ষাকে সহ্য করতে। জানি না আজ গুরুচাঁদ ঠাকুর বেঁচে থাকলে তিনি নিজে কি করতেন, আর আমাদের কি করতে বলতেন?