৬০ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ / ৭ পৌষ, ১৪২৯
শাসকের কুৎসিত কৌশল কি বাঁচাতে পারবে অনুব্রতকে!
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাজ্যের শাসন ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে শাসকদল কী কৌশলে দলের অভিযুক্ত নেতাকে আইনের নাগপাশ থেকে বাঁচায় তার একটা প্রকট উদাহরণ দেখা গেল রাজ্যে। অতি সম্প্রতি গোরু পাচার কাণ্ডে ধৃত মমতা ব্যানার্জির স্নেহধন্য ‘কেষ্ট’ ওরফে অনুব্রত মণ্ডলকে ঘিরে এই কুনাট্য মঞ্চস্থ হতে দেখা গেল। গোরু পাচার কাণ্ডে বিপুল পরিমাণ টাকা লুটের অভিযোগে তৃণমূলের ডাকসাইটে নেতা তথা বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল গ্রেপ্তার হবার পর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই তাঁর নানা কীর্তি ফাঁস হচ্ছিল। একটা পর্যায়ে তাকে দিল্লি নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। সেই অনুযায়ী ১৯ ডিসেম্বর দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালত ইডি-র আবেদন মঞ্জুর করে গোরু পাচার কাণ্ডে মানি লন্ডারিং মামলার তদন্তে কেষ্ট মণ্ডলকে দিল্লিতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পক্ষেই রায় দিয়ে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যু করে। এদিকে কেষ্টকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা যাতে জেরা করতে না পারে তারজন্য শাসকদল মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। বিশাল পরিমাণ অর্থ খরচ করে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিব্বালকে কেষ্টর আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ করেছিল শাসকদল। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। রাউস অ্যাভিনিউ আদালতের রায়ের পরই ইডি-র তরফে তৎপরতা শুরু হয়েছিল। ঠিক ছিল ২০ ডিসেম্বর সকালে আসানসোল জেল থেকে বের করে তাকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু তার পরেই ২০ ডিসেম্বর সকালে নাটকীয় ঘটনার মাধ্যমে কেষ্টকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে ইডি’র জেরার যাবতীয় উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়! রাজ্যবাসী তৃণমূল সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের এক সাজানো কুনাট্য প্রত্যক্ষ করেন।
প্রকাশ্যে দলের সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে যে নেতা পুলিশকে বোমা মারার হুমকি দিয়েছিলেন, প্রায় এক দশক হতে চলা সেই মামলায় সামান্য জেরা করার সাহসটুকুও দেখাতে পারেনি পুলিশ। তিনি এমনই দাপুটে নেতা যে, গোটা জেলা প্রশাসন তার ধমক চমকে ছিল সর্বদা তটস্থ। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, যখন তখন বিরোধী দলের সমর্থকদের মিথ্যা মামলা, গাঁজার মামলা দিতে অভ্যস্ত, এমন নেতাকেই ইডি’র জেরা থেকে রেহাই দিতে তার বিরুদ্ধেই মামলা সাজাতে হলো মমতা সরকারের পুলিশকে! এক তৃণমূল কর্মীর প্রায় দেড় বছর আগের একটি ঘটনা নিয়ে আচমকা দুদিন আগে পুলিশের কাছে করা অভিযোগের ভিত্তিতে দ্রুত এফআইআর এবং জেরা শেষে আদালতে তোলা হয় অনুব্রত মণ্ডলকে, সেইসঙ্গে সাতদিনের পুলিশ হেপাজতের নির্দেশও আসে দুবরাজপুর আদালত থেকে। লক্ষণীয় ঘটনা হলো, তৃণমূলী জমানায় এই প্রথম কোনো তৃণমূল নেতাকে আদালতে তুললেও দলের তরফে কোনও আইনজীবী জামিনের আবেদন পর্যন্ত করেননি!
ঘটনায় প্রকাশ, অনুব্রত তথা কেষ্টর দলেরই দুবরাজপুর ব্লকের বালিজুড়ি পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান শিবঠাকুর মণ্ডলের অভিযোগ ছিল, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের সময় দুবরাজপুর পার্টি অফিসে ডেকে অনুব্রত নাকি তাকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। কারণ, সে বলেছিল দল করবে না। এই অভিযোগেই তড়িঘড়ি পুলিশ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭, ৩২৩, ৩২৫ ও ৫০৬ ধারায় মামলা রুজু করে। শুধু তাই নয়, দ্রুত ‘শোন অ্যারেস্ট’ করে রাত পেরোলেই আসানসোল জেল থেকে কেষ্টকে আনা হয় দুবরাজপুর আদালতে। এবং সাতদিনের পুলিশি হেপাজতে নেওয়া হয়।
এদিকে আশ্চর্যের বিষয় হলো, অভিযোগপত্র এবং এফআইআর দুটোতেই নানা অসংগতি রয়ে গেছে। অভিযোগপত্রে যেমন ঘটনার দিন ও সময় উল্লেখ ছিলনা, তেমনি এফআইআর-এ নির্দিষ্ট কলমে ঘটনার দিনের জায়গায় লেখা হয়েছে ‘মে মাসের যে কোনো দিন’, আর সময়ের জায়গায় লেখা হয়েছে ‘উল্লেখ নেই”।
গোটা ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে যায় কেষ্টকে ইডি’র জেরার কবল থেকে রক্ষা করতেই পুলিশের হেপাজতে নিতে এই নাটক সাজানো হয়েছিল। গত ১৭ ডিসেম্বর দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতে শুনানি শেষে যখন রায়দান ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত ছিল, তখনই শাসক দল বুঝে গিয়েছিল রায় কী যাচ্ছে। তাই ১৮ ডিসেম্বর সকাল দশটার আগেই দলীয় কর্মী সেই শিবঠাকুরকে দিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। আসলে বীরভূমের এই ডাকাবুকো নেতার গ্রেপ্তার ও তদন্তে নিত্যনতুন কেলেঙ্কারি যেভাবে বেরিয়ে আসছিল, তাতে শাসকদলের অস্বস্তিও ক্রমাগত বাড়ছিল। কারণ, কেষ্টর বেলাগাম দুর্নীতির কারবারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তৃণমূলের একেবারে শীর্ষ নেতৃত্ব সহ গোটা দল।
ইতিমধ্যে কেষ্টর নিরাপত্তা রক্ষী তথা গোরু পাচার কারবারের দীর্ঘদিনের সঙ্গী সায়গল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। ইডি সূত্রে প্রকাশিত হয়েছে, গোরু পাচার কাণ্ডে বিপুল পরিমাণ টাকা লুট হয়েছে। কেষ্টর একাধিক আর্থিক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। জানা গেছে, গোরু পাচারের টাকাতেই গাজিয়াবাদে বাংলো ও দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে তাঁর একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। কেষ্ট-কন্যা সুকন্যা ও হিসাব রক্ষক মনীশ কোঠারিকে জেরায় যে সমস্ত সূত্র পায় তাতেই ইডি দিল্লিতে এনে কেষ্টকে জেরার সিদ্ধান্ত নেয়। ইডি-সূত্রেই আরও জানা গেছে, কেষ্ট-কন্যা সুকন্যা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বিদ্যুৎবরণ গায়েনের নামে দু’টি কোম্পানির হদিশ মেলার পরই মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আরও প্রকট হয়। দু'টি কোম্পানি কার্যত কাজ করত শিখণ্ডি হিসেবে। কেষ্টর টাকা খাটত এই দু'টি সংস্থায়। আবার এই সূত্রেই সামনে চলে আসে বিনয় মিশ্র-এনামুল হক-বিকাশ মিশ্রের যৌথ উদ্যোগের আরও তিনটি সংস্থা। স্বয়ং মমতা ব্যানার্জির মদতে ও তাঁর সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে বীরভূমের দাপুটে নেতা কেষ্ট মণ্ডল এভাবেই দুর্নীতির সাম্রাজ্য চালিয়ে শাসকদলকে বিপুল অর্থ-সম্পদে পরিপুষ্ট করে গেছেন। তাই এই হেন নেতাকে রক্ষা করতে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হলো।
সর্বশেষ ঘটনায় জানা গেছে, রাউস অ্যাভিনিউ আদালতের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে যে মামলা হয়েছিল,তা পিছিয়ে গিয়ে পরবর্তী তারিখ স্থির হয়েছে ২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি। অর্থাৎ কেষ্টকে আপাতত তাঁর নিজের জেলা বীরভূমে কার্যত সরকারি আতিথেয়তায় থাকার সুযোগ হয়ে গেল। ফলে গোরু পাচার কাণ্ডে আপাতত তাঁর দিল্লি যাত্রা স্থগিত রইলো। সংবাদমাধ্যম সূত্রেই জানা গেছে, বর্তমানে দুবরাজপুর থানায় কেষ্টর থাকার জন্য একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বিশেষ বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেখানে তাঁর জন্য আলাদা পাচক রেখে পছন্দের খাবার তৈরি হচ্ছে। এভাবে বহাল তবিয়তেই কাটাচ্ছেন গোরু পাচার কাণ্ডের অন্যতম পান্ডা অমিত ক্ষমতাবান তৃণমূলের জেলা সভাপতি কেষ্ট ওরফে অনুব্রত মণ্ডল।
এদিকে রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে শাসকদলের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় ও আড়াল করার মতো কুৎসিত ঘটনায় নানা মহলে প্রতিবাদ ও ধিক্কার উঠেছে। এর পাশাপাশি ইডি-সিবিআই প্রভৃতি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা সম্পর্কেও নানা প্রশ্ন উঠেছে। এই বিশাল দুর্নীতির যথাযথ তদন্ত দ্রুত শেষ করে দোষীদের উপযুক্ত সাজা কবে হবে এখন সেই অপেক্ষায় আছেন রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ।