E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ / ৭ পৌষ, ১৪২৯

প্রতিস্পর্ধী হয়েই কমরেড মানব মুখার্জি হয়ে উঠেছিলেন স্বাভাবিক নেতা


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ মতাদর্শের কঠিন বিষয়কে সহজ করে সামনে আনার মতো বিরল গভীরতা ছিল তাঁর। মার্কসবাদকে আত্মস্থ করেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন সৃজনশীল। স্পষ্টবক্তা। স্বকীয়তায় এগিয়ে থাকা সংগঠক ছিলেন মানব মুখার্জি। ১৬ ডিসেম্বর কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে আয়োজিত মানব মুখার্জির স্মরণসভায় একথা বলেন নেতৃবৃন্দ।

সভায় সভাপতিত্ব করেন সিপিআই(এম) কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক কল্লোল মজুমদার। প্রয়াত কমরেড মানব মুখার্জির প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম, রামচন্দ্র ডোম, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, আভাস রায়চৌধুরী, রবীন দেব, প্রশান্ত চ্যাটার্জি, শমীক লাহিড়ী, কল্লোল মজুমদার, মালিনী ভট্টাচার্য, অনাদি সাহু, মৃদুল দে, চন্দনা ঘোষদস্তিদার, আনোয়ারা মির্জা, দেবাশিস চক্রবর্তী, জামির মোল্লা প্রমুখ। স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, ঈশিতা মুখার্জি, রূপা বাগচী, গৌতম গাঙ্গুলী প্রমুখ।

মহম্মদ সেলিম বলেন, কমিউনিস্টরা যখন স্মরণসভায় কাউকে স্মরণ করে তখন কোনো ব্যক্তির মুল্যায়ন করে না। করা সম্ভব নয়। সেটা উদ্দেশ্যও নয়। একজন ব্যক্তির সামাজিক সত্তা এবং রাজনৈতিক সত্তা গড়ে ওঠে বিভিন্ন ঘটনা এবং তার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। স্মরণসভায় আমরা সেই কমরেডের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক দক্ষতা, আন্দোলনের নির্মাণ, তার বিভিন্ন পর্যায়ের অভিজ্ঞতা, কমরেডদের সঙ্গে মেলামেশা, জীবনবোধ, জীবন চর্চা-চর্যা থেকে আকর গ্রহণ করি।

কমরেড মানব এবং আমরা সত্তরের সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যারা একাত্তরে মুক্তি যুদ্ধ থেকে একটি জাতির জন্ম দেখেছি, দেখেছি আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস, খুন, মিথ্যা মামলা। ওই প্রতিকূলতার সঙ্গে প্রজন্মের একটা বড়ো অংশ যুঝতে শেখে। কালাকানুন, জেল শেষ কথা নয়- তা উপলব্ধিতে আসে, সঞ্চারিত হয় আশাবাদ।

তিনি বলেন, ৭৮ সালে একটা ঘটনাবহুল সময়ে এসএফআই’র মধ্যদিয়ে আমাদের যোগাযোগ হয়। সমবয়সী ছিলাম না আমরা, তবে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সমব্যথী হয়ে আমাদের সমবয়সী করে নেয় ও। তবে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক সব বিষয়ে আমরা একমত হতাম না। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কে তার প্রভাব পড়তো না। আবার ব্যক্তিগত সম্পর্কের বন্ধুত্ব এবং মাধুর্যের ছাপ রাজনীতি ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও পড়তো না। মানব তার বক্তব্য যুক্তি তর্ক দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পারত যেমন, তেমনই ভুল ধরিয়ে দিলে তা গ্রহণ করত। আবার ‘তুই ভুল করেছিস’ এ কথাটাও বলতে পারত। তার ব্যতিক্রমী ব্যক্তিসত্তা রাজনৈতিক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে, আচরণের মধ্যে দিয়ে বারবার ফুটে উঠেছে।

তিনি বলেন, ৭৮ সালের পরবর্তী সময়ে আসামে যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দানা বেধেছে তখন মানব মুখার্জির লেখনি, তার স্লোগান, তার লেখা কবিতার লাইন লড়াইকে আরও শানিত করেছে। ৮০ সালে বিজেপি প্রতিষ্ঠার পর যখন পুনর্জাগরণ বা পুনরুত্থানবাদী কথাবার্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তখন তাকে মিটিং-জনসভায় স্পষ্ট ভাষায় তীব্রভাবে আক্রমণ করতেন মানব। তার বোঝাপড়াটা ছিল স্পষ্ট - বলতেন, এক্ষেত্রে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলার কোনো মানে নেই।

আটের দশকের পরিস্থিতিতে ছাত্র-যুব আন্দোলনে মানব মুখার্জির ভূমিকা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ৮০সালে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে আসার পর কমিউনিস্টদের ওপর কংগ্রেসের আক্রমণ বাড়ে। ইন্দিরা গান্ধীকে দেবী সাজানো হয়। এই সময় আরএসএস নেপথ্যে থেকে কমিউনিস্ট-বিরোধী ভূমিকা পালন করে। সেই ভূমিকার প্রোডাক্ট আজকের নেতা-নেত্রীরা ৮৪সালের লোকসভা নির্বাচনে এমনি এমনি জিতে গেছিলেন তা নয়।

তিনি বলেন, বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে সৃজনশীলভাবে মার্কসবাদের প্রয়োগ ঘটাতে হয়। এক্ষেত্রে চাহিদা এবং প্রয়োজন উপলব্ধি করে সময়ের চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে হয়। নেতৃত্ব মানে তাই। তাঁরা সেটা পারেন। ঘটনাক্রম যা গড়ে উঠছে, বিকশিত হচ্ছে, ক্রমশ সামনে আসছে তার থেকে রসদ সংগ্রহ করতে পারে স্বাভাবিক নেতারা (ন্যাচারাল লিডার)। সেই সব কথা মানুষকে শোনাতে হয়, কারণ মানুষ শুনতে চায় সে কথা। এই কথা বলার জন্য সক্ষমতা অর্জন করতে হয়। তবেই একজন নেতা হয়ে ওঠে। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেই মানব মুখার্জি নেতা হয়ে উঠেছিলেন।

মানব মুখার্জির সৃজনশীলতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মহম্মদ সেলিম বলেন, আটের দশকের সময় যে প্রজন্ম সামনে আসছিল, তাদের ভেতরে নাটক গান সিনেমা কবিতা ইত্যাদি সৃজনশীল বিষয়গুলোর চর্চা বেশি করে হচ্ছিল। পার্টিতে সিদ্ধান্ত করা হয় যে, কমরেডদের সফট স্কিল বাড়াতে হবে। সেই আহ্বানের পথ ধরেই ৮৬ সালে যুবশক্তির সম্পাদক হলো মানব। তাঁর লেখনি, লিফলেট, কবিতা, স্লোগান সবকিছুর মধ্যেই দক্ষতার পাশাপাশি সৃষ্টিশীলতা অর্জনের ছাপ ছিল।

তিনি বলেন, সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর যখন ‘এন্ড অফ হিস্ট্রি’ লেখা হচ্ছে, তখন যুব সম্মেলনে আমরা যুব ফেডারেশনের পক্ষ থেকে স্লোগান দিয়েছিলাম ‘সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ আমাদের’। এ স্লোগানের তাৎক্ষনিক কার্যকারিতা বিষয়ে সংশয় ছিল অনেকের। কিন্তু সভায় রাখা বক্তব্যে দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের স্বার্থে এই স্লোগান যে সুপ্রযোজ্য - একথা প্রতিষ্ঠা করেছিল মানব।

মানব মুখার্জির স্পষ্টবাদিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, মানব সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট কথা সোজাসুজি বলতে পারত। ও চাইত, সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে প্রথম পক্ষ এবং দ্বিতীয় পক্ষের কথোপকথন হোক সরাসরি, কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নয়। আমাদের দোষ হচ্ছে, আমরা স্পষ্ট কথা শুনতে চাই না।

তিনি বলেন, অসুস্থতার মধ্যেও লড়াকু মনোভাব নিয়ে মানব মুখার্জি একাধিক সভায় যোগ দিয়েছেন। এ রাজ্যে পার্টি যখন আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত তখন যাঁরা নেতৃত্ব দিতে পারতেন সামনে দাঁড়িয়ে, তাঁদের অন্যতম মানব মুখার্জি।

সভায় কল্লোল মজুমদার বলেন, মতাদর্শগত বিষয়ের পাশাপাশি যে কোনো বিষয়কে মানুষের কাছে সহজভাবে হাজির করতে পারতেন মানব মুখার্জি। সাতের দশকের আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস সে সময়ের তরুণদের মধ্যে ছাপ ফেলেছিল। তখন গণতান্ত্রিক কাজ করা যাচ্ছে না এমন পরিস্থিতিতে সরাসরি রাজনীতির ছাপ নেই এমন কর্মসূচি নেওয়ার অভিনব পরিকল্পনা রুপায়ণে নেতৃত্ব দিতেন মানবদা। গণআন্দোলন ও শ্রেণি আন্দোলনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এটা পারতেন। আলাপের শুরুতেই নজর টানতে পারতেন তিনি। ৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পরেও মধ্য কলকাতা জুড়ে গণতান্ত্রিক অভ্যাস প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। ছাত্র নেতা এবং পরে যুবনেতা হিসেবে স্বকীয়তায় অনন্য ছিলেন তিনি।