৬০ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ / ৭ পৌষ, ১৪২৯
মোদি সরকারকে হটানোর আহ্বান জানিয়ে শেষ হলো সারা ভারত কৃষক সভার সর্বভারতীয় ৩৫তম সম্মেলন
সুপ্রতীপ রায়
সারা ভারত কৃষক সভার সর্বভারতীয় ৩৫তম সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশ।
মোদি সরকারকে হটানো জরুরি। আগামী ২০২৩ সাল সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ বছর। স্বাধীনতার পর এত কৃষক বিরোধী সরকার দেশে আসেনি। সারা ভারত কৃষক সভার সর্বভারতীয় ৩৫তম সম্মেলনে প্রতিনিধিদের আলোচনার শেষে জবাবি ভাষণে একথা বলেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা।
গত ১৩ ডিসেম্বর সারা ভারত কৃষক সভার সর্বভারতীয় ৩৫তম সম্মেলনে খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন হান্নান মোল্লা। খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের উপর বিভিন্ন রাজ্যের ৬২ জন প্রতিনিধি আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। প্রতিনিধিদের আলোচনা উন্নত ছিল।
হান্নান মোল্লা বলেন, প্রতিনিধিদের আলোচনা শিক্ষণীয়। তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলাই আমাদের বোঝাপড়া। একতাবদ্ধতা জরুরি। কিন্তু শ্রেণি আন্দোলনের সঙ্গে কোনো আপস করা হবে না। সংগঠনের নিজস্ব শক্তি যেমন বাড়াতে হবে, স্বাধীন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তেমনি কৃষি ও কৃষককে বাঁচানোর সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক সব সংগঠনকে নিয়ে ভারতব্যাপী আরও তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দিল্লির ঐতিহাসিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নতুন পর্যায়ে দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ কৃষক আন্দোলনে শামিল হয়েছেন গত ২৬ নভেম্বর। বর্তমান সময়ে যৌথ আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন সরকার বিরোধী পরিবেশ রচনা করেছে।
মোল্লা বলেন, মোদি সরকারের ভয়ংকর কৃষক বিরোধী নীতিকে প্রতিহত করতে হলে যৌথ আন্দোলনই একমাত্র পথ। এক্ষেত্রে কোনো সংকীর্ণতা রাখার অর্থ শত্রুপক্ষকে সুবিধা করে দেওয়া।
তিনি বলেন, দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের শিক্ষা কী? সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতৃত্বে যৌথ আন্দোলনই ঐতিহাসিক জয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে। পরিস্থিতির সঠিক উপলব্ধি করতে না পারলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল হয়। বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করে পথ ও পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হয়। শত্রুর তীব্র আক্রমণ থেকে বাঁচার একটিই পথ - একতা। তিনি বলেন, আমরা এককভাবে আন্দোলন করব আবার যৌথ আন্দোলনও করব। হান্নান মোল্লা স্মরণ করিয়ে দেন, সংযুক্ত কিষান মোর্চা কোনো রাজনৈতিক দল নয়। সারা ভারত কৃষক সভাও কোনো রাজনৈতিক পার্টি নয়। আমরা কিষান রাজনীতি করি। কৃষিক্ষেত্রে কোম্পানি রাজ প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত রুখতেই হবে।
হান্নান মোল্লা জবাবি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, দেশে সাম্প্রদায়িক -করপোরেট সরকার চলছে। এ সরকার ফ্যাসিস্টধর্মী। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই আরও জোরদার করতে হবে। শ্রেণিশোষণের পাশাপাশি সামাজিক শোষণ চলছে।আমাদের সমাজ আর ইয়োরোপীয় সমাজ এক নয়। ভারতীয় সমাজ নানাভাবে বিভক্ত। বিজেপি শাসনে দলিত ও আদিবাসীরা আক্রান্ত। মহিলারা ধর্ষিতা হচ্ছেন, খুন হচ্ছেন। সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইকে আরও ব্যাপক রূপ দিতে হবে। দুর্বল অংশের মানুষের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটলে আমাদের ঘটনাস্থলে যেতে হবে ও হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
হান্নান মোল্লা বলেন, মহিলাদের আরও বেশি বেশি করে সংগঠনে আনতে হবে। আমাদের আন্দোলনগুলিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু সংগঠনের দায়িত্বে বেশি সংখ্যাতে তাঁদের আনতে পারছি না। এ দুর্বলতা কাটাতে হবে। সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
হান্নান মোল্লা বলেন, স্থানীয় স্তরের আন্দোলন আরও বাড়াতে হবে। রাজ্যে রাজ্যে আন্দোলন করতে হবে। তিনি বলেন, কর্মসূচি আর আন্দোলন এক নয়।আন্দোলন তাকেই বলব যা শত্রুপক্ষের বুকে কাঁপন ধরাবে। আন্দোলন মানে কেবল সভা, মিছিল নয়। আন্দোলন মানে দাবি আদায়। আন্দোলনের ঢেউ তুলেই ২০২৪ সালে মোদিকে হটানো সম্ভব। লড়াই, সংগ্রাম বাড়লে কৃষকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াবে আর তাতেই বিজেপি’র পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
হান্নান মোল্লা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে কৃষির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এসমস্যা আরও বাড়বে।এনিয়ে কৃষক কর্মীদের প্রচারে যেতে হবে ও কৃষকদের সচেতন করতে হবে।
তিনি বলেন, গত বছর প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। তার মধ্যেও সদস্য বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সন্ত্রাসের কারণে সব গ্রামে কর্মীরা পৌঁছাতে পারছেন না। আক্রান্ত হচ্ছেন নেতৃত্ব। তার মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গে সদস্য বেড়েছে। ত্রিপুরাতেও সন্ত্রাসের কারণে অনেক গ্রামে কিষান নেতৃত্ব পৌঁছাতে পারছেন না। তিনি বলেন, সারা দেশে আরও সভ্য বাড়াতে হবে। সদস্যপদ বৃদ্ধির প্রশ্নে রাজ্য স্তরে, জেলা স্তরে, স্থানীয় স্তরে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে। সারা বছর সদস্য সংগ্রহ নয় - বছরের নির্দিষ্ট কিছুদিন সদস্য সংগ্রহের জন্য রাখতে হবে। সদস্যপদের গুণ বৃদ্ধি করতে হবে, সদস্যদের সক্রিয় করতে হবে। সদস্যদের নিয়ে বছরে অন্তত একটি সাধারণ সভা করতে হবে। সদস্য তালিকা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। সদস্য সংগ্রহ মানে চাঁদা সংগ্রহ নয়। সদস্যদের রাজনীতি দিতে হবে।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ইউনিট স্তরের কমিটি গড়ে তোলা, সচল করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রাজ্য স্তরে, জেলা স্তরের কমিটি বেড়েছে কিন্তু ইউনিট স্তরের সভা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। ইউনিট কমিটির কাজের চেক আপ বাড়াতে হবে।
হান্নান মোল্লা দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, সর্বক্ষণের কর্মীর অভাব আছে। সর্বক্ষণের কর্মীর সংখ্যা বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, ২০২৩ সালে আন্দোলন আরও তীব্র হবে। কৃষকদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার তাদের প্রতিশ্রুতিগুলি পূরণ না করলে চরম পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।
১৫ এপ্রিল সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সভানেত্রী কে হেমলতা। তিনি বলেন, ৫ এপ্রিল দিল্লি অবরুদ্ধ করবেন মেহনতি জনগণ। ওইদিন দিল্লি অবরুদ্ধ করবে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের সংগঠন। এই তিনটি সংগঠনের নেতৃত্বে শ্রমজীবী মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়বে দিল্লিতে।
হেমলতা বলেন, ২০১৮ সালে বৃহৎ সমাবেশ হয়েছিল দিল্লিতে। এবার ৫এপ্রিলের সমাবেশ সাড়া দেশে আলোড়ন ফেলবে। শ্রমজীবী মানুষের একতাই ভেঙে ফেলবে মোদির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে। হেমলতা বলেন, শ্রমকোড সহ শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও ব্যাপকতা লাভ করবে। শ্রমকোডের ফলে ঠিকাশ্রমিকের সংখ্যা বিপুলহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠবে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী।
১৫ ডিসেম্বর কৃষি বিষয়ক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনটি কমিশন গঠন করে সুনির্দষ্ট আলোচনা হয়। যে তিনটি বিষয়ে কমিশন করে আলোচনা হয় সেগুলি হলো - ‘গ্রামীণ ভারতে জমিনীতিতে নতুন প্রবণতা’, ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চিতিকরণ’, ‘ভারতীয় কৃষিতে লগ্নিপুঁজি এবং করপোরেট অনুপ্রবেশ’। এই তিনটি কমিশনে সারা দেশের প্রতিনিধিরা আলোচনা করেন। বিশেষজ্ঞদের মতামত উঠে এসেছে এবং মাঠে চাষের সঙ্গে যুক্ত চাষিদের দুর্দশার চিত্রও উঠে এসেছে। আলোচনায় উঠে এসেছে জমি করপোরেট হাঙররা গ্রাস করছে। গ্রামীণ ভারতে বিপুল পরিমাণ জমি উদ্বৃত্ত থাকলেও তা বিলি করছে না। জমি সিলিং ভেঙে বেসরকারি পুঁজির মালিকদের দেওয়া হচ্ছে। আদিবাসীরা বনের অধিকার হারাচ্ছে। যারা জমিহারা হচ্ছেন তাদের ক্ষতিপূরণ যথাযথ নয়। গ্রামীণ ভারতের মানুষ ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন। মহাজনি ঋণ বাড়ছে, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ কমছে। কৃষক উৎপাদিত ফসলের দাম পাচ্ছেন না। এমএসপি কৃষকদের কাছে মরীচিকা। কেরালার বাম ও গণতান্ত্রিক সরকার বিকল্পের পথ দেখাচ্ছে।
সম্মেলনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এগুলি হলো - কৃষকের ঋণ মুক্তি চাই, বনাঞ্চলের অধিকার আইন, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভারতীয় কৃষি, দুগ্ধ চাষিদের সমস্যা, খাদ্য নিরাপত্তা ও গণবণ্টন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, ফসল বিমা, রঙ্গরাজন কমিটির সুপারিশ কার্যকর করার বিরুদ্ধে ও স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার পক্ষে, রাষ্ট্রের সম্পদ বিক্রির বিরুদ্ধে, সার শিল্পের সংকট, আপেল চাষিদের সংকট, বিদ্যুৎ সংশোধনী (বিল) বাতিল করো।
সারা ভারত কৃষক সভার সংবিধানের দুটি সংশোধনী সম্মেলন কক্ষে গৃহীত হয়েছে। একটি সদস্যপদ অ্যাফিলিয়েশন ফি বিষয়ক অন্যটি শস্যভিত্তিক ফেডারেশন গড়ে তোলা বিষয়ক।
সম্মেলনে মোট ৬৬৯ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। প্রতিনিধিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সের প্রতিনিধি মাল্লা রেড্ডি (৮৫) ও মতিলাল সরকার (৮৩)। কম বয়স্ক প্রতিনিধি শুভজিৎ দে (২৫), গুরু সেবক সিং (২৫)। সবচেয়ে বেশি দিন জেল খেটেছেন দেবেন্দ্র সিং (৯ বছর)।
সম্মেলন থেকে ১৪৯ জনের সর্বভারতীয় কিষান কাউন্সিল নির্বাচিত হয়। কাউন্সিল ৭৭ জনের কেন্দ্রীয় কিষান কমিটিকে নির্বাচিত করে। সভাপতি হিসাবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন অশোক ধাওয়ালে, সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন বিজু কৃষ্ণান।
সম্মেলনে প্রতিনিধিরা ৩৫ তম সম্মেলন একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন। সম্মেলন বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ করে আগামীদিনে কৃষি আন্দোলনে সঠিক দিশা দেখিয়েছে এবং সঠিক স্লোগান নির্দিষ্ট করেছে, “Struggle, Consolidate, Advance for an Alternative”.
আগামীদিনের কাজ হিসাবে সম্মেলন নির্দিষ্ট করেছেঃ
ক) জনবিরোধী, কৃষক বিরোধী মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি।
খ) স্বাধীন আন্দোলন গড়ে তোলার সাথে সাথে অন্যান্য কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলা। এমএসপি, কৃষি মজুরদের মজুরি বৃদ্ধি, কৃষকদের ঋণ ছাড় ইত্যাদি দাবিগুলির ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
গ) সিআইটিইউ, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের সঙ্গে যৌথ আন্দোলন তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে।
ঘ) নয়া উদারবাদী অর্থনীতির হাত ধরে কৃষিক্ষেত্রে যে আক্রমণ নেমে এসেছে সে বিষয়ে আরও ব্যাপক প্রচার সংগঠিত করা হবে। নয়া উদারবাদী নীতিসমূহের বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রদায়িক বিপদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আরও জোরদার করা হবে।
ঙ) ইউনিট স্তরকে আরও সক্রিয় করা হবে।