E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ / ৭ পৌষ, ১৪২৯

মানবমুক্তির সংগ্রামে স্তালিনের ভূমিকা অক্ষয়

সুবিনয় মৌলিক


জোসেফ স্তালিন
জন্মঃ ২১ ডিসেম্বর, ১৮৭৯, মৃত্যুঃ ৫ মার্চ ১৯৫৩

পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার তাত্ত্বিক প্রবক্তারা অনবরত দুটি কাজ করে থাকেন, সেগুলির ওপরেই তাঁদের খাওয়া-পড়া নির্ভরশীল। এক, বিকল্প সমাজব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্র যে একটি অচল আধুলি সেটি প্রতিপন্ন করার জন্যে অবিরত অফুরন্ত প্রাণপাত পরিশ্রম। দুই, বিশ্বে সমাজতন্ত্র নির্মাণের যে ক’টি প্রকল্প ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে, মূলত সোভিয়েতে, চীনে এবং অন্যত্র, সেগুলির প্রধান রূপকারদের বিরুদ্ধে তত্ত্ব-টত্ত্ব শিকেয় তুলে নির্ভেজাল ব্যক্তিকুৎসা। ঠিক এই কারণেই তিন দশক হলো সোভিয়েত ব্যবস্থা অতীত, তবু ওঁদের হিটলিস্ট থেকে জোসেফ ভিসারিওনভিচ জুগাশভিলি অর্থাৎ স্তালিনের নাম ওঁরা মুছে ফেলতে পারেননি। এই তো হাতের কাছেই দেখছি হালফিল মানে ২০২২ সালেই সাম্রাজ্যবাদের আপন দেশ থেকে প্রকাশিত একটি বই, যার শিরোনাম হলো ‘‘স্তালিনের লাইব্রেরিঃ একজন স্বৈরশাসক এবং তার বইসংগ্রহ’’। খুঁজলে এরকম অগুন্তি নমুনা পাবেন।

যেহেতু স্তালিনের বিরুদ্ধে এই দুই প্রক্রিয়া মূলস্রোতের প্রচারমাধ্যমে নিরন্তর ক্রিয়াশীল, এবং তা বহুসময়েই প্রতিবাদহীন, তাই আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা বন্ধুবৃত্তেও দেখি এমন অনেক প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানুষজনও আছেন যাঁরা মনে করেন সাম্যবাদী আন্দোলন বিকশিত করার ক্ষেত্রে স্তালিন পর্বের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলি এতই মর্মান্তিক যে তা সমাজতন্ত্রের বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ সম্পর্কে মানুষকে গুরুতর বিরূপ এমনকী আতঙ্কিত করে তোলে। যে কারণে স্তালিন প্রসঙ্গ আলোচনায় গোড়ার থেকেই অনেকেই কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত এবং ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব গ্রহণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশে বিপর্যয়ের পর এই পরিবেশ স্বাভাবিকভাবেই আরও ঘনীভূত হয়েছে।

।। দুই ।।

সন তারিখের হিসেবে সোভিয়েত বিপ্লব সাধিত হয় ১০৫ বছর আগে, স্তালিন মারা গেছেন ৭০ বছর হতে চলল। কালপর্বের এই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আজকে কারো পক্ষে এই বোধে পৌঁছানো খুবই সহজ যে সেসময়ে খুব বড়ো বড়ো ভুল হয়েছিল, (এবং আমরা থাকলে অনেক ভালোভাবে সবকিছু করতে পারতাম!) কিন্তু ভুলে গেলে চলবেই না, সেই সময়ের সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ তখনকার পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদের ঘেরাটোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংসের থেকে বাঁচানোর জন্যে যা যা করা দরকার মনে করেছেন তাঁরা তাই করেছেন। এবং চরম নেতিবাদীরাও জানেন যে, এক দীর্ঘ ক্রান্তিকালের দুর্বিপাক মোকাবিলা করার লক্ষ্যসিদ্ধিতে তাঁরা সফল। তার মানে কখনোই এই নয় যে স্তালিন ত্রুটিমুক্ত অতিমানব বা তাঁর ত্রুটিবিচ্যুতি সমাজতন্ত্রের ভাবমূর্তিকে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। কিন্তু বিষয়গুলি নিয়ে আনতাবড়ি কথা না বলে একটু জেনে বুঝে নিয়ে ‘অবহিত বিতর্ক’ হোক। একথা অনস্বীকার্য যে, বিষয়গুলি নিয়ে আরও একটু প্রসারিত মীমাংসায় আসা খুবই প্রয়োজন। আরও বেশি প্রয়োজন কারণ, যে সব নবীনতর মুখগুলো প্রতিদিন আমাদের চারপাশে জড়ো হচ্ছে, তাদের কাছে স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন, বিশ্বে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন কোনো ঝাঁ চকচকে রেড রোড বেয়ে এগোয়নি। তার বিকাশের ধারায় ইচ্ছানিরপেক্ষভাবেই কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পর্বের মধ্যে দিয়ে চলতে বাধ্য হয়েছে। এই প্রেক্ষিতকে বিচারে রাখলে বলা যায় খুব সম্ভবত কমরেড স্তালিনের ভুলগুলির একইভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটা আজকের পর্যায়ে আর সম্ভব নয়।

এই বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে স্টার্টিং পয়েন্ট কী হতে পারে? আমাদের মনে হয় সিপিআই(এম) তার ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ কংগ্রেসে গৃহীত মতাদর্শবিষয়ক প্রস্তাবে নির্দিষ্ট-করে এই বিষয়ে যা বলেছে সেটাই প্রাথমিকতম সূত্র হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সরাসরি প্রস্তাব থেকেই উদ্ধৃত করছিঃ ‘‘সিপিআই(এম), ১৯৬৮ সালে অনুষ্ঠিত বর্ধমান প্লেনাম থেকেই স্তালিনের নেতৃত্বের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলির বিষয়ে তার মূল্যায়ন বারবার স্পষ্ট করেছে। এই বিষয়ে ১৯৯০ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবে স্তালিনের অভ্যন্তরীণ-দলীয় গণতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক বৈধতার কিছু স্থূল লঙ্ঘনের তীব্র সমালোচনা করেও বলা হয়েছিলঃ ‘‘সিপিআই(এম) সেই পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করছে যা ব্যক্তিপুজো সংশোধন করার নামে, সমাজতন্ত্রের ইতিহাসকে অস্বীকার করে। লেনিনবাদকে রক্ষা করা, ট্রটস্কিবাদ এবং অন্যান্য মতাদর্শগত বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের নির্মাণ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয় এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সোভিয়েতকে পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী পদক্ষেপকে প্রতিহত করার উপযুক্ত শক্তি অর্জনের উপযোগী করে তোলায় জোসেফ স্তালিনের অবদান সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে অক্ষয়।’’ (অনুবাদ বর্তমান লেখকের)

এটাই আজ পর্যন্ত আমাদের কমরেড স্তালিন প্রসঙ্গে মৌলিক বোঝাপড়া।

।। তিন ।।

জোসেফ স্তালিন। সমস্ত বিতর্কচিহ্ন জড়িয়ে নিয়েও শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের ইতিহাসে এক মহিমান্বিত অধ্যায়ের প্রবাদতুল্য সেনাপতি। ইয়োরোপের এশীয় সীমান্তবর্তী জারশাসিত জর্জিয়ার ছোট্ট শহর গোরিতে মুচির ঘরে জন্ম। ১৮৭৯। মা ধোপানি।এই তাঁর শ্রেণিউৎস। সেমিনারি স্কুলের ধর্মীয় মতান্ধতায় আচ্ছন্ন ছেলেবেলা। গোপনে মার্কসীয় সাহিত্যপাঠের মধ্যে দিয়ে মাত্র পনেরো বছর বয়েসে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তি। ১৯১৭-র বিপ্লবের আগে বায়োডাটা পড়ে অনেক চায়ের কাপে তুফান তোলা আগমার্কা বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ভিরমি খেতে পারেনঃ সাতবার গ্রেপ্তার এবং সাইবেরিয়ায় নির্বাসন, পাঁচবার বন্দিত্ব থেকে পালিয়ে আসা। উনিশ বছর বয়েস থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে পার্টি কমিটির নির্দেশ পালন করেছেন। সতেরোটা ছদ্মনাম গ্রহণ করেছেন--কখনো কোবা, কখনো চিজিকভ - এইরকম আরও অনেক। পাসপোর্ট জাল করেছেন, ছোটো গোষ্ঠী নিয়ে পার্টির জন্যে হানা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। জারের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। মাটি কামড়ে রাশিয়ায় পড়ে থেকেছেন। শত নিপীড়ন নির্যাতনেও দেশ ছেড়ে যাননি।

এতো গেল এক ঝলকে বিপ্লবের আগের জীবনের কিছু কথা। আসুন এবার জাম্প-কাট করে চলে যাই লেনিন-পরবর্তী সোভিয়েত যুগে। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যু সোভিয়েত ইতিহাসে এক জলকপাট। তা শুধু এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করেনি, সোভিয়েত পার্টি ও জনগণকে কার্যত এক দিশাহীন অবস্থার সামনে ঠেলে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামনে তখন যেন দুটো পথ খোলা ছিল - হয় অতি দ্রুত নিজস্ব সামাজিক-বৈষয়িক-প্রযুক্তিগত ভিত্তি গড়ে তুলে শোষণমুক্ত সমাজের এক বাস্তব নিদর্শন রূপে জগতের সামনে উপস্থিত হতে হবে, নইলে গৌরবজনক ব্যর্থতার কিছু উজ্জ্বল অথচ সাময়িক স্মৃতিচিহ্ন রেখে ইতিহাসের ফসিলস্তূপে বিলীন হয়ে যেতে হবে। স্বপ্নপূরণের অধীর অপেক্ষায় পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষ, আর একইসঙ্গে দমবন্ধ আকাঙ্ক্ষা বুকে চেপে মৃত্যুপ্রহরের প্রতীক্ষায় দুনিয়ার শ্রমলুটেরার দল। এই পরিস্থিতিতে স্তালিন বলশেভিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক, লেনিনবিহীন সোভিয়েত রাষ্ট্রের কর্ণধার।

পরবর্তী ১৫ বছরে সোভিয়েত দেশে যে উথালপাতাল আলোড়ন ঘটে ইতিহাসে তাকে শুধু তুলনারহিত বললে অনেক কথাই ঊহ্য থেকে যায়। রাশিয়ার মতো পিছিয়ে-পড়া দেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণ দারুণ দুরূহ কাজ। যন্ত্রশিল্পের ভিত্তি দুর্বল, কৃষি অসংগঠিত। ১৯১৮-১৯২১ সাল পর্যন্ত তিন বছর যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের জরুরি পদক্ষেপের পর অর্থনীতির আরও বেহাল অবস্থা। মাঝখানে ‘নেপ’ (NEP) এনে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছেন লেনিন। যা নিঃসন্দেহে সমাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। কিন্তু অবশ্যত সাময়িক। এরপর কোন পথে উত্তরণ? প্রয়োজন দ্রুত অগ্রগতি। সমাজতন্ত্র নির্মাণের স্পষ্ট দিশা। শিল্পায়নের প্রশ্নে স্বচ্ছ মীমাংসা।

লেনিন কোনো বিপ্লবের মানেবইয়ে এসব প্রশ্নের রেডিমেড উত্তর লিখে দিয়ে যাননি। তাছাড়া প্রতিদিন নিত্যনতুন প্রশ্নের উদ্ভব ঘটছে যা লেনিনেরও ধারণার বাইরে। সর্বোপরি কিছু নেতা শুধু যে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করছেন তাই নয়, এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিপ্লবের আগে এবং বিপ্লবের পরে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের প্রাথমিক পর্বেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে লেনিনের মতকে সমর্থনই করেননি। সব মিলিয়ে নীতি নির্ধারণের কেন্দ্রে ভীষণ টালমাটাল অবস্থা। কীভাবে সমাজতন্ত্র বিকশিত হবে তার নির্ধারণ করার আগেই সমাজতন্ত্র এক দেশে নির্মাণ আদৌ সম্ভব কীনা তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। সবাই তাত্ত্বিক পণ্ডিত। একে অপরের ব্যাখ্যা মেনে নিতে নারাজ। এককথায় বললে, লেনিনের মৃত্যুর পর ১৯২০-র দশকে সময়ের দাবি ছিল এক সম্মিলিত নেতৃত্বের, কিন্তু বাস্তবে দেখা দিল তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব।

এই দ্বন্দ্বে স্তালিনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ব্যক্তিটি ছিলেন লিওন ট্রটস্কি। তুখোড় লেখক, আগুনখোর বক্তা, এবং শীর্ষতম নেতৃত্বের বাড়াবাড়ি রকম দাবিদার। ট্রটস্কি এবং তার অনুগামী ট্রটস্কিবাদীরা পুঁজিবাদী বেষ্টনীর মধ্যে এক দেশে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার সম্ভাবনাকেই বাতিল করতে চান। তাদের মতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হওয়া উচিত অন্য দেশে বিপ্লব রপ্তানি। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ট্রটস্কি এবং পরে জিনোভিয়েভ দাবি করলেন, দ্রুত শিল্পায়নের জন্য এবং বিদেশে বিপ্লবী আন্দোলনের বৃহত্তর বৈষয়িক সমর্থনের লক্ষ্যে সম্পদ সংগ্রহের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে বৃহৎ আকারে শস্য দখল করতে হবে কারণ একটি দেশে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা অসম্ভব।তার জন্যে সোজা কথায় গোটা অবিপ্লবী কৃষক সমাজের ‘‘স্ক্রু টাইট’’ করতে হবে, গ্রাম দোহন করেই বিপ্লবের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে এবং সমাজের ওপর আরোপিত হবে প্রশাসনিক ও সামরিক শৃঙ্খলা। দৃশ্যত লক্ষ্য শুধু স্তালিন বিরোধিতা নয়, লেনিনবাদকেই নস্যাৎ করা এবং সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে, বিপ্লবের ভবিতব্যকে বিপন্ন করে তোলা। নিজেদের তত্ত্বের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার স্বার্থে এঁরা দেশের বিপ্লবকে পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুতি নিয়েছেন। এর বিরুদ্ধেই নিরলস সংগ্রাম চালাতে হয়েছে স্তালিনকে।

এবং এই সংগ্রামের অতি তিক্ত আবহে এমন অনেক কিছুই ঘটেছে যা কোনভাবেই কাম্য ছিল না। নিকোলাই বুখারিনের সঙ্গে যৌথকরণ নিয়ে তীব্র বিরোধের কথা ধরা যাক। বুখারিন যখন সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলছেন ধীরে চলো, কৃষককে বলছেন ধনী হও, তাঁর বক্তব্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন যে এখুনি কুলাকদের দমন করার প্রয়োজন নেই সেই মুহূর্তে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র তিন দিক থেকে আক্রান্ত - যেকোনো সময়ে শহরে খাদ্য দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠতে পারে, পেছনে তাড়া করছে দুর্ভিক্ষ, কুলাকরা বিপজ্জনক মাত্রায় শক্তি সঞ্চয় করছে - ফলে শিল্পায়ন পরিকল্পনা বিঘ্নিত হওয়ার মুখে, লন্ডন মস্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে - সোভিয়েত আকাশে জমেছে যুদ্ধের মেঘ।

এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই গ্রামের কৃষিজাত উদ্বৃত্ত শহরে আনতে চেয়ে কুলাকদের “শোষণপ্রবণতা” নিয়ন্ত্রণ করা ও পরবর্তীকালে কুলাকদের “শ্রেণিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করে” যৌথখামার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত। বলা হলো, এই যৌথকরণের নেতৃত্বে থাকবেন গরিব কৃষক এবং কোনভাবেই মধ্য কৃষককে বৈরিতার পথে ঠেলে দেওয়া যাবে না। বাস্তবে তা সবটা হলো না। বাধ্যতামূলক যৌথখামার অভিযান মধ্য কৃষকের একাংশকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিল, কুলাক বিরোধিতাকে দমন করতে শুরুতে লালফৌজের ব্যাপক শক্তিপ্রয়োগ বিপর্যয়কর সংঘর্ষের রূপ নিল যার থেকে শ্রেণিমিত্ররাও রেহাই পেলেন না।

প্রশ্ন হলো, স্তালিন কি উদাসীন ছিলেন? কখনোই নয় । এই ‘উপর থেকে বিপ্লব’ যে জোরজুলুমের পরিবেশ তৈরি করেছে তার সম্পর্কে তার প্রখর আত্মসমালোচনামূলক লেখা “Dizzy with Success” (১৯৩০) পড়ে নেওয়া যেতে পারে। তাঁকে দায়মুক্ত করার কোনো দায় আমাদের নেই, কিন্তু স্তালিনকে ধিক্কৃত করার নামে ইতিহাসকে অস্বীকার করার অধিকার কিংবা ক্ষমতাও কারো আছে বলে আমরা মনে করিনা। সীমায়িত পরিসরে প্রসঙ্গ ধরে ধরে পূর্ণাঙ্গ আলোচনার সুযোগ নেই। আগ্রহী অনুসন্ধিৎসু বন্ধুরা সেই বিষয়ে উৎসাহিত হলে এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য সফল হবে।

কিন্তু ঠিক এই জায়গা থেকেই আমরা আমাদের বক্তব্যের চুম্বকরূপ দিতে চাই। স্তালিনের ভুলত্রুটি ছিল না, থাকতে পারেনা - এইরকম মৌলবাদী প্রলাপ নিশ্চয় আমাদের জন্যে নয়। কিন্তু যারা স্তালিন বলতে পাসতেরনাক, মস্কো ট্রায়াল, পারজিং, অগপু, কেজিবি আর গুলাগ বোঝেন, তাদেরকে আমরা বলব, মান্যবর ক্ষমা করবেন। আমরা একমত হতে পারলাম না। এভাবে বলতে গেলে কেউ বলতেই পারেন স্তালিন মানে গসপ্ল্যান, স্তালিন মানে স্ট্যাখানভ, স্তালিন মানে বলশয় থিয়েটার, আইজেনস্টাইন, শলোকভ, পারমাণবিক ও মহাকাশ বিজ্ঞানে উত্তুঙ্গ অগ্রগতি, স্তালিন মানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লালফৌজের বিজয়, সোভিয়েত জনগণের অপরিসীম আত্মত্যাগের গৌরবগাথা , পরিশেষে তৃতীয় রাইখের পতন। মানব সভ্যতার রাহুমুক্তি। স্তালিন মানে ১৯৩৬-র তৃতীয় সোভিয়েত সংবিধান - এক দলিলে লিখিতপড়িতভাবে এতো নাগরিক অধিকার আর স্বাধীনতা অন্য কোনো রাষ্ট্র তার জনগণকে দেয়নি কখনো। এক কথায় স্তালিন মানে সোভিয়েত ইউনিয়ন বলতে যা বোঝাত তার বস্তুগত ভিত্তির নির্মাণ - এসব কি বিস্মৃতির বাণে ভেসে যাবে!

আমরা মনে করি না শুধুমাত্র পাটিগণিতের নিয়মে ইতিহাস বোঝা যায়।

নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির গর্ভজাত পোস্ট-ট্রুথ জমানায় স্তালিন ও তাঁর উজ্জ্বল উত্তরাধিকার প্রতিদিন আক্রান্ত হবে এমনটাই স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার। স্তালিনের সময়ের নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলির সমালোচনা - পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের মারাত্মক লঙ্ঘন, নেতৃত্বের ওপর দেবোপম পবিত্রতা আরোপ করে ব্যক্তির প্রতি গভীর ভক্তিবাদ, শ্রেণিশত্রু দমনের প্রক্রিয়ায় বিক্ষুব্ধদের প্রতি সমান বৈরিতামূলক আচরণ, নিরপরাধ পার্টিকর্মী বা নাগরিকদের নির্যাতন, এমনকী তত্ত্বগত বিচারে অষ্টাদশ কংগ্রেসে ‘জনগণের রাষ্ট্র’ ঘোষণা - আমাদের আছে ও থাকবে। তবে স্তালিন-উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে নিকিতা ক্রুশ্চেভ কিংবা গরবাচভের সময়ে গৃহীত নিঃস্তালিনীকরণের পথ আমাদের পথ নয়। আমাদের সঙ্গে থাকবে আরও অনেক, অনেক কিছু। শুভ্র মানবিক বিকল্প সমাজব্যবস্থা রূপে সমাজতন্ত্রের বিকাশের পথের দিশারিদের সারি থেকে স্তালিনকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কারণ তা হবে ইতিহাসের সার্বিক বিকৃতি।