E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ / ৭ পৌষ, ১৪২৯

সাদা কলারে রক্তের দাগ

সরিৎ মজুমদার


কাজের চাপের জন্য উচ্চ রক্তচাপ, ব্লাড সুগার, ওবেসিটি ইত্যাদি এতদিন আমরা জানতাম, তথাকথিত, আমরা তো শ্রমিক নই, হোয়াইট-কলার চাকরিজীবীদের স্বাভাবিক Life style diseases, গোদা বাংলায় জীবনধারণ জনিত রোগ।

কিন্তু এই অর্থবর্ষের মাঝামাঝি থেকে আমেরিকা, ইয়োরোপ সহ আমাদের দেশেও এই তথাকথিত বেশি মাইনের, ইএমআই নির্ভর জনগোষ্ঠীর থরহরিকম্প অবস্থা। না, কোভিড বা নতুন কোনো মহামারীতে এরাই আক্রান্ত হচ্ছেন সেইরকম কিছু না। এই ব্যাধি পুঁজিবাদের আদি ও অকৃত্রিম ব্যাধি - গণহারে কর্মী ছাঁটাই।

সাম্প্রতিক মাসগুলিতে, বিশ্বের বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থাগুলি লক্ষাধিক কর্মী ছাঁটাই করছে। আনুমানিক শুধুমাত্র ২০২২ সালে ইতিমধ্যেই ১,২০,০০০ জনেরও বেশি কর্মীকে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রযুক্তির সবচেয়ে বড়ো সংস্থাগুলো যেমন - মেটা (Meta) (২০২২ সালের গোড়ায় ফেসবুকের মূল সংস্থার নাম পালটে এই নাম রাখা হয়), আমাজন (Amazon), নেটফ্লিক্স (Netflix) এবং শীঘ্রই গুগল (Google) (যাদের মূল সংস্থার নাম অ্যালফাবেট - (Alphabet) - এবং ছোটো সংস্থাগুলি এবং স্টার্টআপগুলির পক্ষ থেকেও ছাঁটাইয়ের ঘোষণা আসতে শুরু করেছে।

মেটাভার্স (Metaverse) নামক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখানো মার্ক জুকেরবার্গের সংস্থা ৯ নভেম্বর বুধবার জানায় যে, তারা ১৩ শতাংশ কর্মীদের বাদ দিচ্ছে,সংখ্যায় যার পরিমাণ ১১,০০০-এরও বেশি। স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ বিজনেসের অধ্যাপক জেফরি ফেফার চিন্তিত। তাঁকে প্রশ্ন করা হয় - কেন এত প্রযুক্তি কোম্পানি এখনই এত বিপুল লোকেদের ছাঁটাই করছে? তিনি উত্তরে বলেন - ‘‘প্রযুক্তি শিল্পের ছাঁটাই মূলত সামাজিক সংক্রমণের একটি উদাহরণ, যেখানে কোম্পানিগুলি অন্যরা যা করছে তা অনুকরণ করে। আপনি যদি কোম্পানিগুলির ছাঁটাই করার কারণগুলি সন্ধান করেন তবে যে কারণটি পাবেন সেটি হলো - অন্য সবাই এটি করছে। এই গণ-ছাঁটাই একটা অনুকরণমূলক আচরণের ফলাফল এবং এর বাইরে ছাঁটাইয়ের বিশেষ প্রমাণ-ভিত্তিক কোনো কারণ পাবেন না। একটা সামাজিক সংক্রমণ কোম্পানিগুলির বোর্ডে ছড়িয়ে পরে।

জেফরি বলেন যে, ছাঁটাই আক্ষরিক অর্থেই মানুষ খুন করে। নানাভাবে মানুষকে হত্যা করা হয়। ছাঁটাই আত্মহত্যার সম্ভাবনা আড়াই গুণ বাড়িয়ে দেয়। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও সত্য, এমনকী নিউজিল্যান্ডের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভালো সামাজিক নিরাপত্তা সম্পন্ন দেশগুলিতেও এই পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। ছাঁটাই-পরবর্তী ২০ বছরে মৃত্যুহার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করে।

ম্যানেজার পর্যায়ের কর্মীরা যারা মূলত এই ছাঁটাই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন, আশ্চর্যের বিষয় নয়, ছাঁটাই তাদেরও মানসিক চাপ বাড়ায়। মানসিক চাপ, অনেক মনোভাব এবং আবেগের মতোই, সংক্রামক। বিষণ্ণতা, অবসাদ উচ্চস্তরের আধিকারিকদের মধ্যেও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে।

এমনকী কোম্পানিতে টিঁকে যাওয়া কর্মচারীরাও সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। এরপরে হয়ত তার পালা! বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে এই সামগ্রিক প্রক্রিয়া আদতে কর্মীদের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে, যা আদতে কোম্পানিরই ক্ষতি করে।

মেটা (Meta) প্রসঙ্গেই উনি বলেন - মেটার প্রচুর টাকা আছে। এই সব কোম্পানি অর্থ উপার্জন করছে, মুনাফা করছে তাও এরা ছাঁটাই করছে, কারণ অন্যান্য কোম্পানি এটা করছে। কার্ল মার্কস ‘ক্যাপিটাল’-এ অর্থনীতিবিদ টিজে ডানিংকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেনঃ ‘‘যথেষ্ট মুনাফার ক্ষেত্রে পুঁজি সাহসী হয়। দশ শতাংশ মুনাফায় পুঁজি যে কোনো জায়গায় বিনিয়োগ সম্ভব করবে; সুনিশ্চিত কুড়ি শতাংশ মুনাফায় সৃষ্টি হবে আগ্রহ; ৫০ শতাংশ তার ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়াবে, ১০০ শতাংশ তা সমস্ত মানবিক নিয়ম পদদলিত করতে প্রস্তুত থাকবে; ৩০০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত হলে এমন অপরাধ নেই যাতে সে কুণ্ঠিত, এমন ঝুঁকি নেই যা সে নেবে না, এমনকী পুঁজির মালিকের ফাঁসি হতে পারে জেনেও ছুটবে লাভের অদম্য লালসায়। যদি হাঙ্গামা ও সংঘর্ষে মুনাফা আসে, তবে অবাধে উসকানি দেবে সে।’’

হাল আমলের ডিএইচএফএল দুর্নীতি, আগের সত্যম কম্পিউটার দুর্নীতিতেও আমরা দেখেছি পুঁজির মুনাফা কামানোর এই অদম্য লালসা।

বহুজাতিক সংস্থাগুলোর ছাঁটাইয়ের চিত্র

মেটার কথা আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি। এবারে অন্য কিছু দৈত্যাকার প্রযুক্তি সংস্থার বিশ্বব্যাপী চিত্রটা লক্ষ করা যাক -

টুইটারঃ প্রায় ৩,৭০০ চাকরি ছাঁটাই। সিএনবিসি দ্বারা প্রাপ্ত অভ্যন্তরীণ সূত্র অনুসারে, গত মাসের শেষের দিকে ৪৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে টুইটার কেনার পরেই মার্কিন ধনকুবের এলন মাস্ক প্রায় ৩,৭০০ টুইটার কর্মচারীকে ছেঁটে ফেলেন। এটি সংস্থার প্রায় অর্ধেক কর্মীর সমান সংখ্যা।

৪ নভেম্বর একটি পোস্টে মাস্ক বলেছিলেন যে, কর্মীদের ছাঁটাই করা ছাড়া ‘কোনো বিকল্প নেই’ এবং যোগ করেন যে, তাদের তিন মাসের সময় দেওয়া হয়েছে কাজ ছাড়ার জন্য।

মাস্ক বলেন, টুইটার প্রতিদিন ৪ মিলিয়ন ডলারের বেশি লোকসানের কারণে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ Investopedia-র ডিসেম্বর ২০২২-এর হিসাব দেখাচ্ছে এলন মাস্ক বিশ্বের দ্বিতীয় ধনীতম মানুষ (ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণঃ ১৬৮.৫ বিলিয়ন ডলার)।

জুন মাসে, Coin base ঘোষণা করেছে যে, এটি ১৮ শতাংশ পূর্ণ-সময়ের পদের বিলোপ করেছে, সংখ্যায় যা প্রায় ১,১০০।

জুলাই মাসে, Shoplift ঘোষণা করেছে যে, এটি ১,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে, যা তাদের বিশ্বব্যাপী ১০ শতাংশ কর্মীর কাছাকাছি।

গত মে ও জুন মাস মিলিয়ে নেটফ্লিক্স প্রায় ৪৫০ কর্মী ছাঁটাই করেছে রোজগার কমার অজুহাতে।

অক্টোবরে, মাইক্রোসফ্ট জানায়,তারা মোট কর্মীর ১ শতাংশকে ছাঁটাই করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তির উদ্ধৃতি দেওয়া অ্যাক্সিওসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাঁটাইয়ে সরাসরি ১,০০০ জনেরও কাছাকাছি মানুষকে প্রভাবিত করেছে।

আগস্টের শেষের দিকে, স্ন্যাপ (Snapchat-এর মূল সংস্থা) ঘোষণা করেছে যে, এটি তার কর্মীদের ২০ শতাংশ ছাঁটাই করেছে,সংখ্যাটা ১,০০০-এরও বেশি কর্মচারীর সমান। ‘‘কোম্পানির আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য তার ব্যবসার পুনর্গঠন করা দরকার’’।

জুন মাসে, টেসলা সিইও এলন মাস্ক সমস্ত কর্মীদের একটি ইমেলে লিখেছেন যে, সংস্থাটি বেতনভোগী কর্মীদের ১০ শতাংশ ছাঁটাই করবে, কারণ সংস্থায় নাকি অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করা হয়ে গেছে।

এটা গেল গোটা বিশ্বের চিত্র। ভারতের অবস্থা কেমন? বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির বাজারে কোনো দেশই এর প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষাবলয় আছে সেখানে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের কিছু সময়ের জন্য হলেও আর্থিক সুরক্ষা, মেডিক্লেম এইসবের সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে। আমাদের দেশ মোদি জমানায় শ্রম আইনের আদ্যশ্রাদ্ধ করে ৪টে শ্রম কোড করেছে, যেখানে আসলে সব কোডই মালিকপক্ষের সুবিধা করার অস্ত্র হয়ে উঠেছে। সে আপনি এসি অফিসে বসে হোয়াইট কলার জবই করুন বা কারখানায় ফার্নেসের সামনে কয়েক হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজই করুন। আসলে আপনারা দুজনেই একরকম শোষণের শিকার।

লেখাটা যেহেতু বহুজাতিকের কর্মীদের নিয়ে আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ তখন এদেশের তথাকথিত মোদি-সরকার-প্রশংসিত স্টার্টআপ সংস্থাগুলোর বাস্তবটা আলোচনা করেই এই লেখা শেষ করা হবে।

‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার একাধিক প্রতিবেদন অনুসারে ভারতীয় স্টার্টআপ ক্ষেত্রে ছাঁটাইয়ের খবর প্রধানত EDtech, বা শিক্ষাগত প্রযুক্তি প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোতেই দেখা যাচ্ছে। কোভিড মহামারী হ্রাসের পর থেকে শিক্ষামূলক ওয়েবসাইটগুলিতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অংশগ্রহণ হ্রাস পাওয়াকে এর একটি কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

Inc42-এর একটি ভারতীয় স্টার্টআপগুলোতে কর্মসংস্থান ও ছাঁটাইয়ের হিসাব রাখে। তারা দেখিয়েছে যে, ভারতে ১৫,৭০০-রও বেশি কর্মচারীকে ২০২২ সালে বিভিন্ন স্টার্টআপের মূলধনের সংকোচনের কারণে ছাঁটাই করা হয়েছে। Inc42-এর মতে, Byju's, Chargebee, Cars24, Ola, Innovaccer, Udaan, Unacademy, Vedantu এই সংস্থাগুলোতেই সর্বাধিক ছাঁটাই হয়েছে।

নভেম্বরের গোড়াতেই Byju's আগামী ছয় মাসে ২,৫০০ কর্মী ছাঁটাই করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। সিইও বাইজু রবীন্দ্রান বলেছেন যে, সামগ্রিক প্রতিকূল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে কোম্পানি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এই একই সময়ে জুন ২০২২ নাগাদ Byju's BCCI এর সাথে ৫৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ১৮ মাসের জন্য ভারতীয় ক্রিকেট দলের স্পনসরশিপ পুনর্নবীকরণ করেছে। CC-এর সাথেও এরা চুক্তিবদ্ধ। সদ্যসমাপ্ত কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলেও অন্যতম স্পনসর ছিল এরা - এইসব ক্ষেত্রে এদের কোনো আর্থিক সংকট হয় না অর্থের জোগানেও অভাব হয় না।

আসল বিষয় হলো - ওই প্রথম দিকেই যেটা বলা হয়েছে - জামার কলার সাদা, নীল, কালো যাই হোক আমার আপনার রক্তের বিনিময়েই পুঁজি তার মুনাফার পরিমাণ বাড়িয়ে চলে, তাই প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের লড়াই একটাই - পুঁজির শোষণ থেকে ঐক্যবদ্ধ মুক্তির লড়াই।