E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ / ৭ পৌষ, ১৪২৯

নাচায় বিজেপি-তৃণমূলে যথা দক্ষ আরএসএস-এ

দেবাশিস আচার্য


সম্প্রতি আরএসএস প্রভাবিত একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃণমূল এবং বিজেপি’র কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে আরএসএস তাদের উদ্দেশ্য সফল করছে এ রাজ্যে। পুতুলের আসল দড়ি নাগপুরের দক্ষ বাজিগরদের হাতে বাঁধা। অনেকে অবাক হলেও অচিরেই মানুষ বুঝতে পারবেন এ রাজ্যে তৃণমূলের জন্ম, এমনকী মমতা ব্যানার্জির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পেছনেও করপোরেট এবং আরএসএস’র অদৃশ্য হস্তক্ষেপ রয়েছে। সাধারণ মানুষের অনেক সময় শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল হলেও আরএসএস এব্যাপারে অন্তত দক্ষ। আরএসএস’র অন্যতম চিহ্নিত শত্রু কমিউনিস্টরা। স্বাভাবিকভাবেই ভারতে কিংবা বাংলায় তাদের দীর্ঘদিনের ঘোষিত শত্রু কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা। বিজেপি’র উপাস্য - জনসংঘী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির জন্ম ও কর্মভূমিতে রাজনীতি ও সমাজ সংস্কৃতিতে আরএসএস, জনসংঘ কিংবা বিজেপি অপ্রাসঙ্গিক থেকেছে। যার অন্যতম কৃতিত্ব বামপন্থী কমিউনিস্টদের হলেও একমাত্র কৃতিত্ব অবশ্যই নয়। এ রাজ্যের সমাজ-সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে এক ধরনের সম্প্রীতিবোধ সহজ লোকায়ত জীবনবোধ চৈতন্য-লালন, রবীন্দ্র-নজরুল প্রভাবিত বাঙালি জীবন, কৃষক আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন বাংলার মাটিকে সম্প্রীতির দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত করে। বামপন্থীরা তারই উত্তরাধিকার বহন করেছেন সযত্নে। চৌত্রিশ বছরের বামপন্থী সরকারের ভূমিকাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ফলত শ্যামাপ্রসাদের জন্মভূমিতে পদ্মের চাষ হয়নি কোনোদিনই। কিন্তু তাই বলে নাগপুর অধৈর্যে হাল না ছেড়ে শকুনের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওত পেতে ছিল সুযোগ সন্ধানে। তাদের সেই সুযোগ আসে ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের অন্তর্কলহে মমতার কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল গঠনের মধ্যে দিয়ে। জন্মের তিন মাসের মধ্যেই তৃণমূলকে একটা বড়ো ভোটের মুখোমুখি হতে হয় দেশের সাধারণ নির্বাচনে। কার্যত অর্থহীন, দপ্তরহীন একটি শিশু দলের পক্ষে রাজ্যের ৮০ শতাংশ আসনে প্রার্থী দেওয়া ও বাকি আসনে জোট সঙ্গীকে সহায়তা করার মতো কঠিন কাজ করতে হয়। একবার স্মৃতি হাতড়ান, প্রচার বহরে আর্থিক ব্যয়ে ক্ষমতাসীন বামপন্থীদের সাথে টক্কর দেয়। তৃণমূল নেত্রী হেলিকপ্টারে প্রচারের ঝড় তুললেন। কে বা কারা দিলেন সেই বিপুল অর্থ?

বামপন্থীদের মতো তাদের তো কেউ অর্থ সংগ্রহ করতে দেখেননি। মিডিয়াতে প্রচারিত নেত্রী অর্থহীন দরিদ্র টালিচালা নিবাসিনী। তখনো তো ছবি এঁকে দল চালানোর গল্প তো দূর অস্ত, তাঁর চিত্রকর দক্ষতা বা অদ্ভুত লেখনী শক্তির মুগ্ধ ক্রেতারাও বাজারে আসেননি। ফলে তৃণমূলের জন্মলগ্নের এতো বিপুল ফান্ডিং কে বা কারা করেন সেদিন?

এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই এখন সহজে অনুমেয়। আর দেশের প্রধান বিরোধী দল সহজেই কংগ্রেসের ভগ্নাংশের সাথে জোট করে বাংলা থেকে বামপন্থীদের অবসানের স্বপ্ন দেখেছিল। মনে রাখা দরকার সংখ্যালঘুদের ভোটের জন্য যতই তিনি হিজাব পড়ুন, খেয়ে দেয়ে ইফতারে যোগ দিন, রাজনৈতিক মঞ্চে পালা করে ‘‘লা ইলাহা থেকে ইনশাআল্লাহ’’ বলুন না কেন, তৃণমূলের সাথে বিজেপি’র জোট ১৯৯৮-এ। এর অনেক আগেই ১৯৯২-তে কলঙ্কিত ৬ ডিসেম্বরকাণ্ড সংঘটিত হয়। অথচ তিনি অকপটেই সেই কলঙ্কের ভাগীদারদের সাথে মঞ্চ শেয়ার করেছেন, ৬ ডিসেম্বরের অন্যতম নায়ক আরএসএস ঘোষিত লৌহ মানব আদবানির সাথে ব্যক্তিগত সখ্য গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে সেই আদবানিকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি সেই বিরল কৃতিত্বের দাবিদার, তাঁরই প্রকাশ্য সহযোগিতায় রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলা থেকে সর্বপ্রথম দুজন সাংসদ (দমদম ও কৃষ্ণনগর) লাভ করে আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। এই প্রসঙ্গে খুবই উল্লেখযোগ্য, জ্যোতি বসুর বিজেপি-কে ‘অসভ্য বর্বর’ শব্দবন্ধ। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীজি মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে জানতে চান - তিনি কেন তাঁদের অসভ্য বর্বর বলেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জ্যোতি বসুর সহজ অথচ দৃঢ় উক্তি ‘‘এর চেয়ে অন্য কোনো শব্দ বাংলা অভিধানে খুঁজে পাইনি অথচ যারা এইভাবে একটি বর্ষ প্রাচীন ঐতিহাসিক সৌধ ভাঙেন তাদের অসভ্য বর্বর ছাড়া আর কী বলা যায়’’। কবি প্রধানমন্ত্রী আর কথা বাড়াননি। অথচ একই সময়ে কোনো সরকারি সভা বা কর্মসূচি নয়, একেবারে ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী তৃণমূলের নেত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে যান, মমতা দেবীর মাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন, মালপোয়া খান। এইসব কথা ফলাও করে সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়। এই ঘটনাকে অনেকে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য বললেও, শুধুই কি সৌজন্যে! আরএসএস’র নির্দেশ ব্যতীত এই সৌজন্য প্রদর্শন কি বিজেপি নেতাদের পক্ষে সম্ভব! ২০০১ এর ২৪ আগস্ট বিজেপি’র সাথে সখ্যের সাফাই দিয়ে বিবিসি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মমতা বলেন, ‘‘বিজেপি আমাদের স্বাভাবিক মিত্র’’। ১৫ সেপ্টেম্বর দেশের রাজধানীতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আরএসএস’কে ‘সত্যিকারের দেশপ্রেমিক’ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘যদি আপনারা এক শতাংশ সাহায্য করেন, আমরা কমিউনিস্টদের সরাতে পারব’’। আরএসএস নেতাদের সামনে দাঁড়িয়ে বিজেপি সাংসদ বলবীর পুঞ্জ ‘‘আমাদের মমতা দিদি সাক্ষাৎ দুর্গা’’ বলে উল্লেখ করেন।

২০০৪ সালের ২৮ এপ্রিল মমতা বিজেপি’র এনডিএ জোটের ইস্তাহার প্রকাশিত হয়, তাতে রাম মন্দির নির্মাণ, গো হত্যা বন্ধের সাথে কয়লা খনি বেসরকারিকরণের মতো করপোরেটের স্বার্থবাহী নীতিগুলি মুদ্রিত হয়। মমতা তাতে স্বাক্ষর করেন, প্রকাশ অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতিতে বাজপেয়ী বলেন, রাম মন্দির জাতীয় ইস্যু, একে উপেক্ষা করা যায় না। সেদিন এর প্রতিবাদ করে সিপিআই(এম) নেতৃত্ব প্রকাশ কারাত-এর জবাব চেয়েছিলেন। মমতা এর প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘‘আরে ওইটা তো সাব জুডিসিয়াল ম্যাটার।’’ আজ অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও তিনি সেদিনের অবস্থানে অনড়।

সিপিআই(এম)’র তদানীন্তন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের বক্তব্যে ছিল এ বিষয়ে যথার্থ মূল্যায়ন - ‘‘আরএসএস- এর পরগাছা হয়ে রাজ্যে কাজ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস।’’ আসলে মমতার সেই কথা ‘বিজেপি অচ্ছুৎ নয়’ কিংবা ‘বিজেপি-কে ফ্রন্টে এনে লড়ব’ তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়।

২০০০ সালে কুখ্যাত গুজরাটে গণহত্যার পর যখন সারাদেশ মোদির নিন্দায় সরব, এমনকী বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীকেও মোদিকে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দিতে হয়, তখন সম্ভবত একজন রাজনীতিকই নীরব ছিলেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী নিন্দিত মোদি গুজরাটের নির্বাচনে জয়ী হলে মমতা তাঁকে ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানান। দপ্তরহীন মমতাকে মন্ত্রী করে বিজেপি।

১৯৯৮-৯৯ বিজেপি সরকারের মন্ত্রী, ২০০৪ সালে লোকসভা, নির্বাচনে তৃণমূল বিজেপি’র প্রকাশ্য সখ্য ছিল। কলকাতা পৌরসভা দখল করেন জোট বেঁধে। মেয়র তৃণমূলের সুব্রত মুখার্জি, সহকারী বিজেপি’র মীনা দেবী পুরোহিত।

এরপর প্রকাশ্য ছন্দপতন হলেও প্রয়োজন পড়লেই বিজেপি মমতার সাথে থেকেছে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে সাথে থেকেছে। রাজনাথ সিং মমতার অনশন মঞ্চের পাশে বসে গোপন পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকী ২০০১ সালে ক্ষমতা লাভের পর গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মমতাকে পুরনো কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘প্রথম রাতে বিড়াল (পড়ুন কমিউনিস্ট) মেরে দিন।’’ আর মোদির সেই পরামর্শ যে তিনি মানেন তা রাজ্যজুড়ে বামপন্থী নেতা কর্মীদের খুন, নিগ্রহ, ঘরছাড়া, মিথ্যে মামলায় জেলে পোরা, পার্টি অফিস পুড়িয়ে পালন করেন। আসলে আরএসএস জানে এ রাজ্যে তাদের বিস্তার ঘটাতে হলে তা মমতা ব্যানার্জিকে সামনে রেখে করতে হবে। মমতা স্ট্র্যাটেজি চেঞ্জ করে আরএসএস-কে এ রাজ্যের মাটিতে স্থান দিতে শুরু করেন প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি। আরএসএস’র দেবী দুর্গা একই সঙ্গে মুসলিম মৌলবাদীদের ধাত্রী হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলায় রচিত হয় সাম্প্রদায়িকতার পঙ্কশয্যা। তিনি আরএসএস’র মতোই রাজনীতি এমনকী সরকারের সাথে ধর্মকে মিশিয়ে ফেলেন। ধর্মের নামে যারা অশান্তি সৃষ্টি করে তাদের চূড়ান্ত বাড়বাড়ন্ত হয় তাঁর এক দশকের কুশাসনে। তার আগে রাজ্যের কোনো মুখ্যমন্ত্রী এমনকী নেতাদের ভজনালয়ের মিনারে কিংবা চূড়ায় উঠে ধ্বজা ওড়াতে হয়নি। নামাবলি পরে কিংবা হিজাব পরে মন্ত্র উচ্চারণ, খোদা হাফেজ বলতে হয়নি। আরএসএস’র নেতাদের সাথে তাঁর যেমন সখ্য, তেমনি পার্লামেন্টে পাঠালেন নিষিদ্ধ সংগঠন সিমির সন্দেহভাজন কর্তাকে। আর এসব আচরণে সুবিধা হলো আরএসএস’র। খাগড়াগড়ে সন্ত্রাসীরা তৃণমূলের অফিসের ওপর যেমন আশ্রয় পান, অন্যদিকে এ রাজ্যে গ্রাম শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠল আরএসএস’র শাখা, তাদের অনুমোদিত সাংস্কৃতিক সংগঠন অজস্র স্কুল। উভয়ক্ষেত্রেই সরকার নীরব। ক্ষমতা দখলের জন্য ভোট ব্যাংক তৈরি করতে তিনি উসকে দিতে থাকলেন ধর্মীয় ভেদাভেদের অগ্নি কেন্দ্রগুলি।

অথচ এই বাংলা ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার পরে তেভাগার লড়াইয়ে কৃষকদের ঐক্য দেখেছে। পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু বাঙালিরা এরাজ্যে দলে দলে আসলেও এ রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বড়ো অংশ এরাজ্যেই থেকে গেছেন। ডান কিংবা বাম সরকার বদল হলেও ১৯৪৭ থেকে ২০১১ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি মূলত ধর্মবিযুক্ত থেকেছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়েছে, আজান- কীর্তন হয়েছে নিরাপদে। কিংবা সেই ধর্মীয় বৃত্ত, মন্দিরের চৌকাঠে কিংবা মসজিদের চাতাল স্পর্শ করেনি রাজনীতি। আবার রাজনীতির মঞ্চে স্থান পায়নি ধর্মীয় স্লোগান। এমনকী ৯২ সালেও এতো জয় শ্রীরাম ধ্বনি উচ্চারিত হয়নি, যা এ ক’বছরে রাজনীতির রণধ্বনীতে পরিণত হয়। আসলে আরএসএস’র পথকে সহজ করে দিলেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ধর্মীয় পরিচয়, পরিচিতিসত্তার রাজনীতিকে উসকে দিলেন তৃণমূল নেত্রী। মনে করুন কয়েক বছর আগে ত্রিপুরার কাহিনি, তখন বামফ্রন্ট সরকার, কংগ্রেসের বিধায়ক বিরোধী দলনেতা সহ তৎকালীন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের উপস্থিতিতে তৃণমূল হয়ে গেল। আবার বছর ঘুরতে না ঘুরতে গোটা তৃণমূল দল এমনকী তাদের রাজ্য অফিসটা বিজেপি’র হয়ে গেল। এই রাজ্যেও সেই লক্ষ্যে এগোতে চাইছে বিজেপি। শুধু ফুলবদল, নীতি এক। বিজেপি’র অধুনা প্রধান দীক্ষিত সংঘী দিলীপ ঘোষ তো এক বছর আগে মমতা দেবীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছিলেন, বাংলা যদি কোনো প্রধানমন্ত্রী পায় তবে ওনার সম্ভাবনা আছে, প্রথম সুযোগ ওনার।

কপিল মুনি আশ্রমের প্রধান সেবাইত মোহান্ত জ্ঞান দাস বলেছিলেন, ‘‘মমতা প্রধানমন্ত্রী হলে রাম মন্দির হবে’’।

নন্দীগ্রামের তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার আগে বলেন, তিনি আসলে আরএসএস কর্মী, তাদের নির্দেশে বামফ্রন্ট হটাতে তৃণমূলে যোগদান করেছিলেন। সেই কাজ হয়ে গেছে তাই পুরনো দলে ফিরছেন।

২০১৭ সালে ভদ্রেশ্বর পৌরসভার প্রধান মনোজ উপাধ্যায় খুন হওয়ার পর বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি তাকে ‘দীর্ঘদিনের আরএসএস কার্যকর্তা’ বলে দাবি করেন। আরএসএস’র আহ্বানে যেমন বিজেপি রামনবমীর মিছিল করে তেমনি দেখা গেছে ইসলামপুরে তৃণমূল নেতা কানাইলাল আগরওয়ালার মতো অনেককেই রামনবমীর মিছিল করতে। প্রাক্তন তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী স্বীকার করেছেন, তাঁদের সাথে বিজেপি’র পুরনো যোগাযোগের কথা। তৃণমূল নেত্রী যতোই এনআরসি নিয়ে হইচই করুন, তিনি কিন্তু ২০০৫-এর ৪ আগস্ট এই ইস্যুতে বিজেপি’র নীতিকে সমর্থন করে ‘রাজ্যে অনুপ্রবেশকারীদের বামফ্রন্ট মদত দেয়’ - এই অভিযোগ তুলে সংসদের নিম্নকক্ষে অধ্যক্ষকে কাগজ ছুড়ে মারেন।

সেই পরম্পরা মেনেই তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্যরা এনআরসি ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থেকে কার্যত এনআরসি আইন চালু করতে সাহায্য করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর স্নেহভাজন, এনআরসি’র উগ্র সমর্থক সদ্য প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় যখন বালিগঞ্জ আসনে জোড়া ফুলের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়ে মমতার মন্ত্রীসভার সদস্য হয়ে যান, আরএসএস-ও বামপ্রার্থী তথা এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী সায়রা হালিমকে হারাতে বিজেপি’র বদলে বাবুল সুপ্রিয়কে জেতাতে গোপন প্রচার শুরু করে। আসানসোলের পুত্রহারা ইমাম রশিদির চোখের জলের মতোই সত্য হয়ে ওঠে দক্ষ বাজিগর সংঘের গোপন কলাকৌশল। ফলে এরকম আরও হাজারো উদাহরণ দেওয়া যায় তৃণমূল-বিজেপি’র অভিন্ন উদ্দেশ্য ও আঁতাত নিয়ে। কাঁথি আর হাজরা মোড়ের নকল যুদ্ধে মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসলে দেশজুড়ে করপোরেটের লুটের রাজত্ব কায়েম হবে। গরিবের চামড়া ছাড়িয়ে বড়োলোকের ঢাক পেটাবে করপোরেটের দালাল মিডিয়া। দেশের সম্পদ লুট হবে, দেশের সম্পদ খনি জমি মাটি জল বিমান রেল ব্যাঙ্ক বিমা সব কিছু। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, বেকারি, বৈষম্য বাড়বে। আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াই যেহেতু বামপন্থীদের প্রধান কাজ, তাই তাদের শক্তি কমাতে করপোরেটের নির্দেশে আরএসএস কখনো তৃণমূল আবার কখনো বিজেপি-কে ব্যবহার করে তাদের আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবে। এ রাজ্যে তারা সেই কাজই করে চলেছে। গ্রাম শহরে ব্যাপকভাবে সংঘের শাখা বেড়েছে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক শাখা, শিক্ষাকেন্দ্র, শারীরিক কসরতের ট্রেনিং, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আড়ালে তারা কাজ করে চলেছে। মানুষের শ্রেণি পরিচয়কে ভুলিয়ে পরিচিতিসত্তার রাজনীতি কায়েম করে তারা মানুষের ঐক্য সংহতিকে ভাঙছে। মানুষের আন্দোলন, কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবদের আন্দোলন, বামপন্থীদের লড়াই , বাংলার গ্রামে গ্রামে লাল রঙের পতাকা হাতে শ্রমজীবী মানুষের পদযাত্রার ছবি সেখানে ব্রাত্য। অতিমারীর সময়ে রাজ্যজুড়ে বামপন্থীদের কমিউনিটি কিচেন, রক্তদান, পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে থাকার ছবির চেয়ে নেতা মন্ত্রীদের দলত্যাগ, দাম্পত্য কলহের ছবি আর দুই দলের নেতাদের নকল বাকযুদ্ধ দেখাতে মিডিয়া ব্যস্ত।

আর অন্যদিকে উভয়দলই ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষের জীবন-জীবিকা, রুটি রুজির সংগ্রামকে ভাঙার কাজ করে চলেছে। যদিও প্রকৃত ধর্মের সাথে এই বিভাজনের রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এই সর্বনাশের কিনারা থেকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলাকে, ভারতকে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে, সংবিধানকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র বামপন্থীরা। তাদের উদ্যোগে আরও ব্যাপক দেশপ্রেমিক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ঐক্য, মানুষের জীবন জীবিকা রুটিরুজির সংগ্রাম গড়ে তোলা জরুরি। সেই সাথে বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক চর্চা, লোকায়ত সংস্কৃতির বিকাশ, সামাজিক আন্দোলন, সাক্ষরতা, পরিবেশ ও জনবিজ্ঞান আন্দোলন, শিশু কিশোরদের সুস্থ সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াচর্চার মধ্য দিয়ে এদের বিভেদকামী কার্যক্রমকে প্রতিহত করা প্রয়োজন। ইতিহাস সাক্ষী, আরএসএস, মুসলিম লিগের কৌশলে দাঙ্গা নয়, তেভাগার লড়াই-ই রক্ত দিয়ে বাংলার ইতিহাস লিখেছে। সম্প্রতি সেই ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছে শীতের দিল্লির রাজপথে কৃষক আন্দোলনের উত্তাপ। আরএসএস’র মুখোশ বিজেপি বা সাক্ষাৎ দুর্গা মমতার তৃণমূলের পরাজয় ঘটিয়ে এ বাংলার মানুষও সেই ইতিহাস রচনা করবেন।