E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ / ৭ পৌষ, ১৪২৯

প্রসঙ্গঃ সাবঅলটার্ন এবং নগরায়ণ

অশোক ভট্টাচার্য


(শেষাংশ)

শিল্পায়ন ও নগরায়ণ - উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে

আমরা যদি বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকে একবিংশ শতাব্দীর বর্তমানকাল পর্যন্ত দেখি, তা হলে দেখব - এ‍ই সময়ের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী অনেকগুলো পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই পরিবর্তন ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি, অর্থাৎ শিল্প উৎপাদন, জীবনযাপন, ভোগ-বণ্টন, প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা, নগরায়ণ ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই ঘটে চলেছে। পুঁজির বিকাশেরও একটা পরিবর্তন হচ্ছে, তা ধনতান্ত্রিক বা উন্নত দেশগুলো থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলির অভিমুখে বেশিভাবে তা বর্তমানে স্থানান্তরিত হচ্ছে।

উন্নত দেশগুলি ক্রমশ প্রবীণ মানুষদের দেশে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু এশিয়া বা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি হচ্ছে তরুণ নাগরিকদের দেশ। ভারত বা চীনে মধ্যবিত্ত ও তরুণ প্রজন্মের মানুষের সংখ্যার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শতাব্দী উন্নয়ন ও নগরায়ণের শতাব্দী - বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলির উন্নয়ন ও নগরায়ণ উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হচ্ছে এবং এই দেশগুলোতে সাবঅলটার্ন স্টাডিজও বাড়ছে। নগরায়ণ ক্রমশই উন্নত দেশগুলি থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থানান্তরিত ও বিকশিত হচ্ছে।

আরেকটি বিষয়ও দেখা যাচ্ছে, শহরে বা নগরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কমছে ইয়োরোপ বা উত্তর আমেরিকার দেশগুলিতে। কিন্তু বৃদ্ধি পাচ্ছে এশিয়া বা তৃতীয় বি‍‌শ্বের দেশগুলিতে। একইভাবে আর্থিক গতিবৃদ্ধির হারও উন্নত দেশগুলি থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বেশিহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

উন্নয়নশীল দেশগুলির এই যে বিরাট নগরায়ণ - এই নগরায়ণের সাথে ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর শিল্পনির্ভর নগরায়‌ণের পার্থক্য রয়েছে। আজকের বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলির নগরায়ণের চরিত্র আলাদা। এই দেশগুলি মূলত কৃষিভিত্তিক। কৃষি যতই অলাভজনক হচ্ছে ততই কৃষি শ্রমিকরা উদ্বৃত্ত হয়ে যাচ্ছে - রোজগারের আশায় তারা স্থানান্তরিত হচ্ছে - গ্রাম থেকে শহরে বা শহর সংলগ্ন অঞ্চলে। লগ্নি পুঁজির এই যুগে উৎপাদনভিত্তিক শিল্পে এই উদ্বৃত্ত মানুষদের রোজগারে যুক্ত হবার সুযোগ কম - যা ছিল ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর ইয়োরোপ বা উত্তর আমেরিকার দেশগুলিতে শিল্পায়নকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নগরায়ণে।

এবার যদি ভারতের দিকে তাকানো যায় তবে দেখা যাবে, এই বিপুল জনসংখ্যা, শহর বা শহরতলিতে যা বাড়ছে, তা বড়ো বড়ো শহরগুলিতে উৎপাদনভিত্তিক শিল্পকে কেন্দ্র করে নয় - এই নগরায়ণ হচ্ছে সেন্সাস টাউন, ছোটো শহর - কিছু এলাকার চরিত্রগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। ভারতে এই মুহূর্তে যত শহর আছে - তার নব্বই শতাংশই ছোট ও সেন্সাস টাউন। যত মানুষ শহরে বসবাস করে তার ৪০ শতাংশ ছোট শহরে বসবাস করে। এদের একটা বড়ো অংশই বস্তিবাসী বা শহুরে গরিব। এরা যুক্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের সাথে। আমরা এই প্রক্রিয়াকে বলতে পারি সাবঅলটার্ন আরবানাইজেশন (Subaltern Urbanisation) বা নিম্নবর্গীয় নগরায়ণ। একবিংশ শতাব্দীতে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বা আর্থিক গতিবৃদ্ধির ক্ষেত্রে, ক্ষুদ্র উৎপাদন বা পরিষেবা ভিত্তিক ক্ষেত্রের এই নিম্নবর্গীয় নগরায়ণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বি‍‌শেষ করে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টিতে। সাবঅলটার্ন বা নিম্নবর্গীয় নগরায়ণের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো অনুৎপাদনশীল অর্থনীতি।

বিংশ শতাব্দীতে মানুষ শিল্প বিপ্লব দে‍‌খেছে। দেখেছে কৃষিক্ষেত্রের বিপ্লব বা সবুজ বিপ্লব, দেখেছে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন। একইভাবে একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ দেখছে নগর বিপ্লব বা আরবান রেভেলিউশন। এই শতাব্দীতেই সারা বিশ্বের শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বা সংখ্যার দিক দিয়ে গ্রামকে পিছিয়ে এগিয়ে গেছে শহর বা নগর। ইতিমধ্যেই তা ৫৪ শতাংশতে পৌঁছেছে। ২০৫০ সালে ৬৮ শতাংশ বিশ্ববাসী বসবাস করবে শহর এলাকায়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই নগরায়ণের গতি-প্রকৃতি বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করেছিল উন্নত দেশের থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে কেন্দ্র করে বেশি হারে। কীভাবে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০১৮ সালে ৪২২ কোটি মানুষ সারা বিশ্বের শহর বা নগরে বসবাস করতেন। ২০৩০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হবে ৫১৭ কোটি, ২০৫০ সালে তা হবে ৬৫৮ কোটি। সেই সময়ে সারা বিশ্বের গ্রামে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে হবে ৩০৯ কোটি।

অর্থাৎ নগরায়ণ প্রসারিত হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলির অভিমুখে। যদিও এই নগরায়ণের সাথে উন্নত দেশগুলির নগরায়ণের মধ্যে বেশ কিছু গুণগত পার্থক্য রয়েছে যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলির নগরায়ণ মূলত উৎপাদনভিত্তিক শিল্পকে ভিত্তি করে। যদিও একবিংশ শতাব্দীতে এই সমস্ত দেশের অর্থনীতিও নগরায়ণ পরিষেবাভিত্তিক। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলি থেকে উৎপাদন ভিত্তিক শিল্প ক্রমশ স্থানান্তরিত হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। যদিও তা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে না, উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় উৎপাদন বৃদ্ধি সাবঅলটার্ন নগরায়ণ বলে সংজ্ঞায়িত করতে পারি।

উন্নয়নশীল দেশগুলির শহর বা নগরগুলির অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মানুষ গরিব বা বস্তিবাসী। তারা অনেকেই আজও বঞ্চিত অনেক বুনিয়াদি পরিষেবা থেকে। তাদের কাছে আজও বসবাস, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য, জনস্বাস্থ্যের সমস্যাই বড়ো সমস্যা।

ক্ষুদ্র ও সেন্সাস শহর ও শহরতলির নগরায়ণ

এ প্রসঙ্গে ভারত বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নগরায়ণ প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের নগরায়‌ণের হার এখনও জাতীয় হারের সামান্য হলেও বেশি। তা সত্ত্বেও অনেকগুলি রাজ্যে নগরায়ণের গতি বৃদ্ধির হার পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেশি। ২০১১ সালের জনগণনার তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, এই সমস্ত রাজ্যে নগরায়ণের স্বাভাবিক গতিবৃদ্ধিতে সেন্সাস টাউনগুলির অবদান ২৬ শতাংশের মতো। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই অবদান প্রায় ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বহু শহরের স্বাভাবিক জনসংখ্যা ও অভিবাসী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। বরং গ্রামীণ চরিত্র পরিবর্তিত হয়ে ছোটো শহর বা সেন্সাস টাউনের সংখ্যা এই রাজ্যে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সংখ্যা প্রায় ৭০০টি। এই বৃদ্ধি (Vertically) উলম্ব নয়, (Horizontally) সমান্তরাল। শহরগুলিতে উৎপাদন ভিত্তিক শিল্পায়ন হ্রাস পাওয়ায়, কৃষিক্ষেত্র থেকে উদ্বৃত্ত কৃষি মজুররা শহরের উপকণ্ঠে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। যুক্ত হচ্ছেন কিছু অসংগঠিত পরিষেবা ক্ষেত্রের সাথে। অন্যদিকে শহরের মধ্যে জমির মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার ফলে, শহরে জীবনযাপনের ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ায়, শহর ও শহর সংলগ্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ফলে তারা শহরের উপকণ্ঠে বা বাইরে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এভাবেই গড়ে উঠছে অসংখ্য ছোটো শহর ও সেন্সাস টাউন (CT)। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের ৯০ শতাংশ শহরই এই শ্রেণিভুক্ত। শহরের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই ছোটো বা সেন্সাস শহরের। অন্যদিকে শহরগুলিতে জমির সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার ফলে, জমির মূল্যের অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বহু মানুষ নতুন করে বস্তিতে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। কলকাতার ৩০ শতাংশ, মুম্বাই‌য়ের ৫০ শতাংশ’র উপর মানুষ বসবাস করে বস্তি এলাকায়। একসময়ে উৎপাদন ভিত্তিক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা কর্মস্থলের নিকটবর্তী অঞ্চলে বসবাসের বাধ্যবাধকতার কারণে বস্তিতে বসবাস করত। মুম্বাই, কলকাতা ইত্যাদি মেট্রো শহরগুলির ভেতর থেকে বহু উৎপাদন ভিত্তিক শিল্প ক্রমেই শহরের বাইরে স্থানান্তরিত হয়ে যাবার ফলে বহু শ্রমিক পরিবার হয় শহরের বাইরে, বা তাদের স্ব স্ব গ্রামের দিকে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। যা সাম্প্রতিক করোনাজনিত পরিস্থিতির সময়ে বেশিভাবে দেখা গিয়েছিল। যাকে বলা হয়ে থাকে বিপরীতমুখী অভিবাসন (Reverse Migration)। এভাবে বহু বড়ো ও মেট্রো শহরের শ্রেণি চরিত্রের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে শ্রেণি ভারসাম্যেরও।

সাবঅলটার্ন নগরায়ণ এবং শহর ও বস্তির চরিত্র পরিবর্তন

এইভাবে ক্রমেই বস্তিগুলির চরিত্রেরও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এক সময়ের সর্বহারা বা সংগঠিত শ্রমিকদের পরিবর্তে অসংগঠিত ও গরিব শহরবাসীদের সংখ্যা বস্তিগুলিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একে আমরা স্লাম আরবানাইজেশন বা স্লাম সাবঅলটার্ন বলতে পারি। সংগঠিত শিল্পশ্রমিক থেকে অসংগঠিত শ্রমিক, গ্রাম থেকে, কৃষি থেকে উচ্ছেদ হওয়া গরিব মানুষ, হকারি, পরিবহণ, পথিপার্শ্বস্থ ক্ষুদ্র ব্যবসা, দিনহাজিরার কর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, পরিচারক বা পরিচারিকার কাজ করা, হাতের কাজ জানা, বেসরকারি হাসপাতাল, হোটেল, রেস্টুরেন্টে কর্মরত মানুষরাই বেশি বসবাস করে বস্তি এলাকায়। বিগত জনগণনার রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে কলকাতায় মোট ১,২৫৩টি স্বীকৃত বস্তি রয়েছে। মোট ৩.৬১ লক্ষ পরিবার, মোট ১২ লক্ষ মানুষ এই সমস্ত বস্তিতে বসবাস করেন যারা মূলত নিম্নবর্গীয় বা সাবঅলটার্ন।

বিগত এক দুই দশক ধরে বস্তি এলাকার বেশ কিছু আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন চোখে পড়ছে। প্রথমত, এক সময়ে বস্তিগুলিতে পরিবারে পুরুষের সংখ্যাই বেশি ছিল। বর্তমানে পুরুষ-মহিলা উভয়ের সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তির মহিলারা মূলত পরিচারিকা বা সেবামূলক কাজে যুক্ত থাকেন। বস্তিবাসীরা সাধারণভাবে শহরের মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রয়োজন ও চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। আর একটি পরিবর্তন হলো বস্তিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার প্রভাব, বিশেষ করে তৃতীয় প্রজন্মের মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়া।

বস্তি এলাকায় বর্তমানে একটি নেতিবাচক দিকও দেখা দিতে শুরু করেছে। তা হলো বস্তির তরুণ প্রজন্মের একটি অংশের মধ্যে বেআইনি বা অনৈতিক পথে রোজগার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া। বিশেষ করে বহু প্রমোটার, ডেভেলপার এদের নানাভাবে, এমনকি অনৈতিক বা অপরাধমূলক কাজের সাথে যুক্ত করে বা ব্যবহার করে রোজগারের ব্যবস্থা করিয়ে দিয়ে থাকে। শহরগুলিতে জমির সরবরাহ কম। ফলে শহরে জমির দাম ঊর্ধ্বমুখী। তাকে কেন্দ্র করে একদল মানুষ বিত্তশালী হয়ে উঠছে। যাকে লুম্পেনাইজেমশন বলা যেতে পারে। এরাই ক্রমেই বস্তি সংগঠনকে এড়িয়ে বস্তির বা শহরের জমির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে। রিয়েল এস্টেট ক্ষেত্র উদীয়মান শহরগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এরাই আজ শাসকদলের পক্ষে রাজনৈতিক মাতব্বর হয়ে উঠছে। এদের হাতে থাকে বেশ কিছু অর্থও। এইভাবে বহু শহরের চরিত্রের কিছু কিছু পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব শহরের বহু মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও পড়ছে। পড়ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও। অর্থনীতি যতই অনুৎপাদনশীল হচ্ছে, ততই এই অংশের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এদের মধ্যে কিছু অংশ আর্থিক দিক দিয়ে সম্পদশালী হচ্ছে। এইভাবে শহরগুলিতে বাড়ছে রেন্ট শিকারদের সংখ্যা। যারা কোনো উৎপাদনে বিনিয়োগ না করেই সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে শহরগুলির সামাজিক ঐক্যেও দেখা দিচ্ছে ফাটল। এরই সাথে দেখা দিচ্ছে সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধের অধঃপতন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যাতে ধ্বনিত না হয়, তরুণরা যাতে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে না পারে এরকম একটি ব্যবস্থা সৃষ্টিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। শহরগুলিতে কমে যাচ্ছে গণতন্ত্রের বিশেষ করে বিরোধী মতের পরিসরের। বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারি। নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বরং হচ্ছে কর্মহারা।

ছোটো ও মাঝারি শহরের গুরুত্ব

অন্যদিকে ছোটো শহর বা সেন্সাস শহরগুলিতে উন্নত বা প্রশস্ত রাস্তা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, উন্নত বেসরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বড়ো বড়ো মল, সহজভাবে তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা, নানা ধরনের মেরামতি, পরিষেবা ইত্যাদি সুযোগসুবিধা পাবার কেন্দ্র হয়ে উঠছে। গ্রাম ও শহরের উৎপাদিত পণ্য, পরিষেবা ও উপভোগের অন্যতম কেন্দ্র বা বাজারে পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র বা সেন্সাস শহরগুলি। ক্রমেই এসবকে কেন্দ্র করে একটি নব্য মধ্যবিত্ত সমাজের আবির্ভাব ঘট‍‌ছে ছোটো ও মাঝারি শহরেও। যাদের বলা হয় উপভোক্তা শ্রেণি বা কনজিউমিং ক্লাস। নব্য উদারীকরণ আর্থিক নীতির প্রবর্তন বা অনুসরণের সাথে শহর বা গ্রামে নতুন নতুন পরিবর্তন সংগঠিত হচ্ছে। তারই সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ভারতে এক লক্ষ জনসংখ্যার নিচের শহর এবং সেন্সাস শহরগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি। এরই সাথে যুক্ত একটি অংশের মানুষের আয় ও রোজগারের উৎসের পরিবর্তন হওয়া। এদের অধিকাংশই অসংগঠিত, চুক্তিভিত্তিক বা অস্থায়ী শ্রমিক, এদের অনেকেই স্বনিযুক্ত। অথচ অর্থনীতিতে এদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ছোটো শহরগুলির অবদান অস্বীকার করা যায় না। বড়ো বড়ো শহর নিয়ে অনেক আলোকপাত করা হয়। এই সমস্ত বড়ো শহরের উন্নত পরিকাঠামো, নানা ধরনের সামাজিক পরিষেবা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অবশ্যই সম্ভাবনাপূর্ণ। তাই এদের নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়। এদের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা হয়, নানা আধুনিক প্রচার বা বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ছোটো ছোটো শহর ও সেন্সাস শহরগুলিও কম সম্ভাবনাপূর্ণ নয়। শুধু মেট্রো বা স্মার্ট সিটি নয়, সরকারকে বিশেষ নজর দিয়ে এই সমস্ত ছোটো শহরগুলির অর্থনৈতিক, পরিকাঠামোগত ও সামাজিক উন্নয়নের পরিকল্পনা যত দ্রুত সম্ভব প্রস্তুত করতে হবে। সারা বিশ্বের অর্থনীতি, শিল্পায়ন বা নগরায়ণের ভরকেন্দ্র ক্রমশ তৃতীয় বিশ্বের দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র বা ছোটো শহরগুলির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে অনেক বেশি সংখ্যায়। নগরায়ণের ক্ষেত্রেও তাই বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শহরগুলির দিকে। বি‍‌শেষভাবে নজর দিতে হবে এই সমস্ত শহর বা উঠতি শহরের সাবঅলটার্ন সামাজিক গোষ্ঠীর প্রতি। বিষয়টি বিশেষভাবে অধ্যয়ন বা স্টাডির দাবি রাখে।

নাগরিক সমাজ, সাবঅলটার্ন ও অনুৎপাদনশীল অর্থনীতি

ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশের নগরায়ণের আরও কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ছে। তা হলো এই সমস্ত শহর বা নগরের নাগরিক সমাজের বা সিভিল সোসা‍‌ইটির নামে একদল এলিট প্রকৃতির নাগরিকের মতামতেরই গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে উন্নয়ন বা পরিষেবার ক্ষেত্রে। বস্তিবাসী গরিব শহরবাসী, বা নিম্নবিত্ত মানুষরা থাকছে বহু নাগরিক অধিকার, মতামত প্রদান, অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে মহিলারা। পৌরসভাগুলিতে ওয়ার্ড কমিটিতে প্রাধান্য থাকে এলিট নাগরিকদের মতামতের। শহরগুলিতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এদের হেজেমনি বা আধিপত্য ক্রমবর্ধমান। বস্তিবাসীরা ক্রমেই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। বড়ো বড়ো জমির দালাল, প্রমোটার, ডেভেলপারদের দৃষ্টি এখন বড়ো শহর থেকে শহরের উপকণ্ঠে ছোটো বা সেন্সাস শহরের দিকে পড়ছে। কারণ এই সমস্ত অঞ্চলে এখনও জমির সরবরাহ বেশি। তুলনায় জমির মূল্যও কম। রাষ্ট্রীয় মদতে জমির চরিত্র পরিবর্তনও সহজ হয়ে যাচ্ছে। ফলে এই সমস্ত অঞ্চলে বহু মানুষ ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছে। বহু মানুষের রোজগারের উৎসের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক পেশারও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এরাও পরিণত হচ্ছে নিম্নবর্গে বা হচ্ছে সাবঅলটার্ন। অন্যদিকে কিছু মানুষ কোনো সম্পদ সৃষ্টি না করেও বিত্তশালী হয়ে যাচ্ছে। যাদের বলা হয় রেন্ট শিকার। শহরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বহু শ্রমিক উৎপাদনভিত্তিক শিল্পে কাজ করলেও লগ্নি পুঁজির যুগে এই সমস্ত ক্ষেত্রে বহু শ্রমিক উদ্বৃত্ত হয়ে যাচ্ছে। বহু শ্রমিকের মধ্যে শ্রেণি চেতনাবৃদ্ধির পরিবর্তে বাড়ছে ধর্মীয় প্রভাব। অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিকাশ প্রসারিত হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন করার আগ্রহ কমছে। প্রতিবাদ, আন্দোলনের পরিবর্তে তাদের করা হচ্ছে সরকারের অনুদান বা অনুকম্পার ওপর নির্ভরশীল। তার প্রভাব পড়ছে রাজনীতিতেও। রাজনীতিতে বাড়ছে অর্থের ভূমিকা। তা নিয়ে বাড়ছে হিংসার ঘটনা।

ভারসাম্যহীন নগরায়‌ণ

তাই উন্নত দেশের শিল্পায়ন ও নগরা‌য়ণের সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলির শিল্পায়ন ও নগরায়ণের মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য। আমাদের দেশের পশ্চিমাঞ্চল বা দক্ষিণাঞ্চল নগরায়ণের ক্ষেত্রে যতটা উন্নত বা এগিয়ে, বাকি দুই অংশ রয়েছে অনেক পিছিয়ে। পশ্চিমবঙ্গেও দেখা যাচ্ছে কলকাতা মেট্রোপলিটন এলাকা বা আসানসোলের শিল্পাঞ্চল নগরায়ণে বা উন্নয়নে যতটা এগিয়ে, উত্তরবঙ্গ সেই তুলনায় রয়েছে অনেক পিছিয়ে। এই সমস্ত পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে নিম্নবর্গীয় বা সাবঅলটার্নদের সংখ্যা অনেক বেশি। সাবঅলটার্ন নগরায়ণের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে অনুৎপাদনশীল অর্থনীতি। এর সাথে যুক্ত রাজনীতিতে প্রমোটার, ডেভেলপার, জমির দালালদের নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতা বৃদ্ধি। এরই সাথে যুক্ত তোলাবাজি, কাটমানি, রাষ্ট্রকে ফাঁকি দিয়ে আয় করার ঝোঁক। এইসব কাজের সাথে যুক্ত থেকে যারা আয় বৃদ্ধি করে থাকে তারা দায়বদ্ধ থাকে শাসকদল বা সরকারের ওপর। সাবঅলটার্ন নগরায়ণেরই একটি পরিণতি শহরে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি। একই সাথে সাম্প্রদায়িক বা পরিচিতির ভিত্তিতে দাঙ্গা, নারী ধর্ষণ, সন্ত্রাসের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে নগরা‌য়ণ যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি গরিব, মহিলা, শিশুদের ওপর হিংসার ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সাথেও যুক্ত সাবঅলটার্ন নগরায়ণ।

আন্তোনিও গ্রামসি জন্মসূত্রে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া ইতালির দক্ষিণাংশের একজন মানুষ ‍ছিলেন। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তিনি বুঝেছিলেন ইতালির উত্তর-দক্ষিণের মানুষের জীবন যাত্রার মধ্যে পার্থক্য। সেই কারণেই তিনি ইতালির দক্ষিণাংশের কৃষক ও গরিব মানুষদের সাবঅলটার্ন শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারার সাথে সাবঅলটার্নের পার্থক্য সূচিত করেছিলেন। ভারতের মতো দেশে যে আধিপত্য রয়েছে, শাসকশ্রেণির দ্বারা শোষিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত দলিত শ্রেণির মানুষের ওপর, তেমনি বড়ো শহরগুলির ছোটো শহরগুলির প্রতি রয়েছে তাচ্ছিল্য, আবার বড়ো বা মাঝারি শহরগুলির সিভিল সোসা‍‌ইটি বা নাগরিক সমাজেরও একপ্রকার হেজেমনি বা আধিপত্য রয়েছে শহরগুলির বস্তিবাসী, গরিব বা মধ্যবিত্ত শহরবাসীর ওপর। শহরের গরিব বা বস্তিবাসীদের কণ্ঠস্বর ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। শহরগুলিতে এলিটরাই সর্বেসর্বা হয়ে উঠছে। এমনকী পুরবিধি অনুযায়ী ওয়ার্ড কমিটিতে বস্তিবাসী, গরিব, নিম্নবিত্ত বা মহিলাদের কোনো ভূমিকা থাকছে না। এই সিভিল সোসা‍‌ইটি বা নাগরিক সমাজের আধিপত্যের স্থানে আঘাত না করে শহরের নিম্নবর্গ বা সাবঅলটার্নদের স্বার্থরক্ষা করা কঠিন। বর্তমানে শহরগুলি চলছে কিছু বিত্তশালী এলিটদের স্বার্থে ও নেতৃত্বে। এই নগরায়ণ শহরগুলি থেকে ক্রমেই বস্তিবাসী বা গরিব শহরবাসীরা দূরে বা বাইরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এভাবে শহর ও নগরের ভারসাম্যেও পরিবর্তন হচ্ছে। তার মধ্য দিয়ে শহরে এক নতুন অংশের মানুষ ও রাজনীতির সৃষ্টি হচ্ছে।