৬০ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ / ৭ পৌষ, ১৪২৯
জিএম সরিষাঃ প্রযুক্তির বিরোধিতা না বিরোধিতা তার প্রভাবের?
তপন মিশ্র
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনেটিক ম্যানিপুলেশন অফ ক্রপ প্ল্যান্টস (সিজিএমসিপি)-র বিজ্ঞানীরা সরিষার (ব্রাসিকা) একটি নতুন প্রজাতি (variety) ডিএইচএম-১১ (ধারা সরিষা হাইব্রিড-১১), গবেষণাগারে তৈরি করেছেন। এটি তৈরি হয়েছে জেনেটিক মোডিফিকেশন (জিএম)অর্থাৎ জিনের গঠন বা সজ্জারীতির পরিবির্তন ঘটিয়ে। গবেষণাগারে তৈরি এই ধরনের উদ্ভিদ বাণিজ্যিকভাবে চাষের আগে ভারত সরকারের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং আপ্রাইজাল কমিটি (জিইএসি)-র অনুমোদন দরকার লাগে। গত অক্টোবর মাসে জিইএসি এই নতুন প্রজাতিটির পরিবেশগত মুক্তির অনুমোদন দিয়েছে। জিন পরিবর্তিত সরিষার এটি হলো Brassica juncea-র এক নতুন প্রজাতি। আমাদের দেশে এটি হলো প্রথম জিএম খাদ্য ফসলের বাণিজ্যিকীকরণের প্রথম ধাপ।
সাধারণভাবে তিনটি পদ্ধতি ব্যবহার করে জিন পরিবর্তিত জীব তৈরি করা যায়। প্রথমটি হলো, নির্বাচনী প্রজনন (সিলেকটিভ ব্রিডিং) এবং ক্রসব্রিডিং ইত্যাদি। প্রায় ১০,০০০ বছর ধরে এই পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে আসছে এবং প্রকৃতি নিজে বা কৃষকরা নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছেন। এর ফলে ফসলের গুণমান পরিবর্তন হয়ে থাকে। দ্বিতীয়টি হলো, জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিন পরিবর্তন যা এক্ষেত্রে করা হয়েছে। তৃতীয়টি হলো, জিনোম এডিট করা যা এখন আয়ত্তে এলেও আমাদের দেশে তার প্রয়োগ তেমন সহজ নয়। যুক্তিবাদীরা কেউ জিএম কিংবা অন্য নতুন প্রযুক্তির বিরোধিতা করেন না, করেন তার অবিবেচক প্রয়োগের। যে প্রয়োগ পরিবেশ, সমাজ ইত্যাদির উপর প্রযুক্তির কী প্রভাব পড়তে পারে তা খতিয়ে না দেখেই ব্যবহার করা হয় - তার বিরোধিতা অবশ্যই গঠনমূলক।
সরিষায় জৈব প্রযুক্তির প্রয়োগ
প্রযুক্তিটা যে খুব সহজ তা নয়। সাধারণত একটি ফসলের নতুন প্রজাতি তৈরির জন্য অন্য প্রজাতি থেকে পছন্দসই গুণাবলিকে সংকরায়ন পদ্ধতিতে একত্রিত করা হয়। সরিষার ক্ষেত্রে এটি একটি চ্যালেঞ্জ কারণ মূলত ফসলটি স্ব-পরাগায়নকারী, যার অর্থ হলো, একই উদ্ভিদের পুরুষ এবং স্ত্রী অঙ্গকে নিষিক্ত করে বংশধর উৎপন্ন হয়। খুব বেশি হলে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে সরিষা পর-পরাগায়নকারী হতে পারে। সংকরায়নের ক্ষেত্রে প্রথমত সরিষার পরাগ রেণুকে বন্ধ্যা করতে হয়। পরে অন্য একটি প্রজাতির বা প্রজাতির পরাগ রেণু দিয়ে নিষিক্ত বা ক্রস-ব্রিড করা হয়।
ডিএইচএম-১১ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রযুক্তিতে বার্নেস, বারস্টার এবং বার নামক তিনটি জিনের ব্যবহার করা হয়। Bacillus amyloliquefaciens নামে মাটির একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে নেওয়া দুটি জিন (বার্নেস এবং বারস্টার) সরিষার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে পরাগ রেণুর বন্ধ্যাকরণ করা হয়। বার্নেস পরাগ রেণুর বন্ধ্যাকরণের কাজ করে অন্যদিকে, বারস্টার জিন উর্বর হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের জন্য উদ্ভিদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার কাজ করে। অনেকটা লাইটের সুইজ অফ এবং অন করার মতো ব্যাপার। বার্নেস জিন যে সুইজ অফ করে অর্থাৎ বন্ধ্যাত্ব ঘটায় সংকরায়নের পরের প্রথম জনুতে (F1generation - এফ আই জনু) সেই বন্ধ্যাত্ব বারস্টার জিন ফিরিয়ে দেয় অর্থাৎ সুইজ অন হয়ে যায়। ১৯৯০-এর দশক থেকে বেলজিয়ামে এই প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়। ‘বারনেস’ আসলে একটি প্রোটিন। ক্যান্সার নিরাময়ে ‘বারনেস’ এবং ‘বারস্টার’ জুটি ব্যবহার করা হয়। ‘বার’ জিনটি Streptomyces hygroscopicus, নামে একটি জীবাণু থেকে নেওয়া হয়েছে। ‘বার’ জিন মার্কার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর ফলে বন্ধ্যাকরণ প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। এই জিনের অন্য একটি কাজ Glufosinate ammonium নামে হার্বিসাইড (আগাছা নির্মূল করার ঔষধ) থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। মাঠে এই হার্বিসাইডটি দিলে সরিষার বদলে সমস্ত আগাছা শেষ হয়ে যাবে। ফলে আগাছা নির্মূল করার জন্য ওষুধ দিলেই হলো, তার জন্য কৃষিশ্রমিকের দরকার নেই।
সরিষার আদিকথা
আনুমানিক খ্রিস্টপুর্ব ৩,০০০ বছর অর্থাৎ বর্তমান থেকে প্রায় ৫,০০০ বছর আগে সরিষার চাষ (domestication) পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়। ২০২১ সালে Nature Genetics-তে এ সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। লি কাং সহ এশিয়া এবং ইয়োরোপের ২৭ জন বিজ্ঞানী যে প্রবন্ধটি লেখেন তার নাম ‘Genomic insights into the origin, domestication and diversification of Brassica juncea’। এখানে আরও বলা হয় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সরিষার কয়েকটি প্রজাতি যেমন Brassicajuncea এবং Brassicarapa চাষ শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে J S Hemingway নামে একজন বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাপত্রে লেখেন যে, ভারতে সংস্কৃত ভাষায় এবং ব্যাবিলনে সুমেরিয় ভাষায় (কাদামাটিতে লেখা) খ্রিস্টজন্মের ৩০০০ বছর আগে Brassica juncea-র চাষের কথা উল্লেখিত আছে। বর্তমান থেকে প্রায় ৮,০০০ থেকে ১৪,০০০ বছর আগে বন্য পরিবেশে এই প্রজাতিগুলি পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলি যে চাষযোগ্য এবং মানুষের খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তেমন ধারণা তখন তৈরি হয়নি।
বর্তমান ভারতে সরিষার চাষ
ভারতের বৈচিত্র্যময় কৃষি-বাস্তুতন্ত্রে বেশ কয়েক ধরনের সরিষা প্রজাতির চাষ হয়। এদেশে মোট তৈলবীজ চাষ এলাকার ২৪ শতাংশ সরিষা চাষের এলাকা এবং উৎপাদনের দিক দিয়ে দেখলে সয়াবিনের পরে সরিষার স্থান। ভারতে যে ব্রাসিকা প্রজাতিগুলি ভোজ্য তেলের জন্য চাষ করা হয় সেগুলি হলো Brassica juncea, B. rapa, B. napus এবং মসলার জন্য B. carinata এবং B. oleracea এবং B. nigra রয়েছে। এর মধ্যে ব্রাসিকা জুন্সিয়া প্রজাতিটি সাধারণত ‘ভারতীয় সরিষা’ বলা হয়, যার কৃষি জমির আয়তন সর্বাধিক।
এদেশে ১৯৫০-৫১ সালে মাত্র ০.৭৬ মিলিয়ন টন সরিষা চাষ হতো। ২০১৬-২০১৭ সালে উৎপাদন ১০ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৭.৯৮ মিলিয়ন টন হয়। একইভাবে, ফলনের মাত্রা ১৯৫০-৫১ সালে ৩৬৮ কেজি/হেক্টর থেকে ২০১৬-১৭ সালে ১৩২৪ কেজি/হেক্টর হয়েছে। ১৯৫০-৫১ সালকে বেস বছর ধরে একই সময়ে সরিষার এলাকা, উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতাও যথাক্রমে +২০৪, +৯৫০ এবং +২৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এই সমস্ত তথ্য প্রমাণ করে যে, এদেশের সরিষা বীজের বাজার ক্রমবর্ধমান। ফলে এদেশে বাণিজ্যিকভাবে সরিষা জিএম বীজের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
বিরোধিতা কেন?
এটা ঠিক যে, সরিষার এই জিএম প্রজাতিটি সরকারি আর্থিক সহায়তায় তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার বীজের বিপণন ব্যবস্থা যে সরকারের হাতে থাকবে তেমনটা নয়। সরকার দাবি করছে যে, আগের যে কোনো জাতের তুলনায় এই জিএম জাতটির ফলন বেশি। বাণিজ্যিক বিষয়টি বাদ দিলেও কয়েকটি আশঙ্কা সামনে আসে। সরকারের দাবি - এই অনুমোদন আগামী ৪ বছরের জন্য। কিন্তু একবার সার্বজনীন চাষ শুরু হলে তার পরিবেশের উপর প্রভাব নিয়ন্ত্রিত করা যে সম্ভব নয় তা সরকারি আধিকারিকদের মাথায় কেন আসে না বোঝাই ভার।
প্রথম যে বিপদটি সামনে আসছে তা হলো ‘বার’ জিনের উপস্থিতি, যা জিএম সরিষা গাছকে গ্লুফোসিনেট অ্যামোনিয়াম নামে আগাছা মারার জন্য রাসায়নিকের ব্যাপক ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে। ফলে মাঠের জৈব বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে মাটি এবং পরিবেশের উপর এর কি প্রভাব পড়বে তার কোনো তথ্য প্রস্তুতকারকরা দিতে পারে নি। জমিতে রাসায়নিক আগাছানাশক স্প্রে করা হলে আগাছা ধ্বংস হলেও ফসল রক্ষা পাবে এটা ঠিক। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, ফসলের জমির আগাছার উপর অনেক পোকামাকড়, পাখি ও অন্যান্য জীবজন্তু খাদ্য ও বসবাসের জন্য নির্ভরশীল থাকে। অর্থাৎ আমাদের জানা, যে খাদ্য শৃঙ্খল ক্রিয়াশীল তা ভেঙে পড়বে। কানাডাতে ইতিমধ্যে এই নিয়ে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে।
দ্বিতীয় আপত্তিটি হলো, মৌমাছি ইত্যাদির মতো রেণুবাহক (pollinator)-দের উপরে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে। আমাদের দেশে সরিষা ফুল থেকে মৌমাছি সহ আরও কয়েকটি পতঙ্গের মধু সংগ্রহ এক সাধারণ বিষয়। বার্নেস, বারস্টার এবং বার জিনগুলি যে টক্সিক প্রোটিন সংশ্লেষ করবে তার কিছু অংশ মধুতেও থাকবে। মৌমাছির শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় এর প্রভাব এবং তার পর সংগৃহীত মধু যারা খাবেন তাদের শরীরের উপর এর প্রভাব কি হবে সে নিয়ে কোনো তথ্য এই জিএম বীজ উৎপাদকের কাছে বা জিইএসি’র কাছে নেই। ফলে জিএম সরিষা সম্পর্কে এই আশঙ্কা থাকবেই।
তৃতীয়টি আরও মারাত্মক এবং সুদূরপ্রসারী। সরিষায় বন্ধ্যাত্ব ঘটিয়ে যে বীজ তৈরি হলো এফ ১ জনুতে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, অর্থাৎ সুইজ অন হয়ে যায়। মৌমাছির মতো পরাগরেণু সংগ্রাহক পতঙ্গের পায়ে এবং ডানাতে এই রেণু আশেপাশে ছড়িয়ে যাবে।পরিবেশের উপর এর কি প্রভাব পড়বে তা আমাদের অজানা।আর একটি ভয় হলো, এই জিএম সরিষার বহিরাগত ‘বার’ এবং অন্য দুটি জিন সংশ্লিষ্ট জাতের বন্য উদ্ভিদ জগতে সংক্রমিত হতে পারে। যেহেতু বাতাসে প্রবাহিত পরাগ থেকে উদ্ভিদ ভ্রুণ গঠন করে, ফলে জিএম ফসলের পরাগ প্রবাহিত হয়ে অনেক দূরবর্তী স্থানেও অন্য উদ্ভিদের ফুলে ঢুকে পড়তে পারে। ফলে এই সমস্ত বন্যজাত উদ্ভিদের আগাছানাশক সহনশীলতা বৃদ্ধি পেয়ে এমন আগাছা তৈরি হতে পারে, ভবিষ্যতে যা নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে পড়বে। কীটনাশকের ক্ষেত্রে এমনটা তো আগে হয়েছে।
চতুর্থটি হলো,পরবর্তী বছরে ফসল উৎপাদনে জিএম সরিষার বীজ উপযোগী হবে না। এমনকী অঙ্কুরিত হবে না। অঙ্কুরিত হলে তাঁর এই বিশেষ গুণাবলি থাকবে না। ফলে বীজ কোম্পানিগুলির উপর কৃষকদের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাবে। প্রতিবছর ফসল উৎপাদনের সময় নির্দিষ্ট কোম্পানি থেকে বীজ এবং তার সাথে সার, কীটনাশক ইত্যাদি ক্রয় করতে হবে।
পঞ্চমত, আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলে সরিষার তেল বা মশলার মধ্যদিয়ে বার্নেস, বারস্টার এবং বার জিনগুলির তৈরি প্রোটিনের প্রবেশ ঘটবে। আমাদের অজান্তে আমাদের দেহের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপের উপর কি প্রভাব বিস্তার করবে তার কোনো তথ্য জিএম উৎপাদক সংস্থা কিংবা জিইএসি দিতে পারেনি।
সরকারি আধিকারিকদের ‘হাঁ’ বা ‘না’ তে কিছু এসে যাবে না। এটা সত্যি যে, এই সম্পর্কিত যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া দরকার তা এখনও হয়নি। এক বছর শস্য উৎপাদন করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রবণতা হাস্যকর। অতীতে সংকরায়নের মাধ্যমে যে নতুন প্রজাতি প্রকৃতি বা মানুষ তৈরি করেছে তা দীর্ঘসময় ধরে প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতির মধ্যদিয়ে হয় টিকে গেছে বা বিলুপ্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে সেই সুযোগ নেই। তাই জিইএসি ‘এনভারনমেন্টাল রিলিজ’-এর অনুমোদনের আগে যে পরীক্ষার আবশ্যকতা ছিল তা না করে এক বড়ো ঝুঁকি নেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেছেন যে,আমাদের দেশের জন্য ভবিষ্যতে এটি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দেশজুড়ে বিজ্ঞানীদের বিরোধিতা জিএম প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নয় বরং এর অবাঞ্ছিত প্রভাবের বিরুদ্ধে।