৬০ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ / ৭ পৌষ, ১৪২৯
কাতার বিশ্বকাপ শেষ, অপেক্ষা আবার চার বছরের
সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ হলো কাতার বিশ্বকাপ ২০২২। কোটি কোটি মানুষের প্রধান আকর্ষণের বিন্দু হয়েছিল গত একমাস যাবত। শুধু ৩২টি দেশ নয়, মহাবিশ্বের নীল রঙের এই গ্রহটির প্রায় সবদেশের মানুষ আশা আকাঙ্ক্ষার দোলায় দোদুল্যমান ছিল। আর হবে নাই বা কেন? ফুটবল পৃথিবীর জনপ্রিয়তম খেলা, সেই খেলা যে মানুষ দেখবে তা স্বাভাবিক। অংশগ্রহণকারী দেশের সমর্থকরাই শুধু নয়, বাদবাকি দেশের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো দেশের সমর্থক হয়ে চোখ রেখেছিল টিভির পর্দায়, বা ইন্টারনেটের দুনিয়ায়। লেখা হয়েছে লক্ষ লক্ষ ম্যাচ রিপোর্ট, আলোচনা হয়েছে পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে মোড়ে, ক্লাবে ক্লাবে, শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র।
তৃতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ জিতে নিলো আর্জেন্টিনা। ৩৬ বছর বাদে, কিংবদন্তী দিয়েগো মারাদোনার নেতৃত্বে শেষ বার জেতা দল, মারাদোনার মৃত্যুর পরে তাঁরই উত্তরসূরি লিওনেল মেসির হাত ধরে আবার বিশ্বজয়ী হলো। রানার্স হলো ফ্রান্স। ফাইনালে ৫৬ বছর বাদে হ্যাটট্রিক হলো, ক্যামেরুনের বংশোদ্ভুত ফরাসি ফুটবলার, ২৩ বছর বয়সের এমবাপে হ্যাটট্রিক করেও জেতাতে পারলেন না দেশকে। যদিও এই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোল করলেন (৮টি) তিনিই।
তৃতীয় স্থানে গেলো সোভিয়েত পতনের পরে যুগোস্লাভিয়ার থেকে সৃষ্ট ক্রোয়েশিয়া। চতুর্থ হলো প্রথমবারের জন্য আফ্রিকা থেকে সেমিফাইনাল খেলা দেশ মরক্কো।
মেসি সেরা খেলোয়াড়, সেরা গোলকিপার মার্টিনেজ, সেরা উঠতি ফুটবলার এঞ্জো ফার্নান্দেজ, সবই আর্জেন্টিনার। তবে ফেয়ার প্লে পুরস্কার পেয়েছে ইংল্যান্ড।
কাতারের গরমের হাত থেকে বাঁচতে নভেম্বর-ডিসেম্বরের ২৯ দিন ধরে ৫টি শহরের ৮টি স্থানে ৬৪ টি ম্যাচ খেলে ৩২টি দল। এবারই শেষ ৩২ দলের প্রতিযোগিতা হলো, এরপর থেকে ৪৮ দলের খেলা হবে।
দুই প্রাক্তন বিশ্বজয়ী দেশ উরুগুয়ে ও জার্মানি গ্রুপ লিগেই বিদায় নেয়। আয়োজক কাতার কোনো ম্যাচ জিততে পারেনি। বিশ্বকাপের আগে অবধি দ্বিতীয় স্থানে থাকা বেলজিয়াম, যারা আবার গত বিশ্বকাপের তৃতীয়, তারাও গ্রুপ লিগেই বিদায় নেয়। এবারের জয়ী আর্জেন্টিনাও গ্রুপ লিগের প্রথম খেলায় সৌদি আরবের হাতে পরাজিত হয়। এদিকে পাঁচবারের বিজয়ী ব্রাজিলের এবারও হেক্সা হলো না। কোয়ার্টার ফাইনালেই বিদায় নিলো তারা। স্পেন এবং পর্তুগালও মরক্কোর জন্য বিদায় নেয়।
এবারই সম্ভবত শেষ বিশ্বকাপ খেললেন গত দেড় দশকের দুই শ্রেষ্ঠ তারকা আর্জেন্টিনার মেসি ও পর্তুগালের রোনাল্ডো। তবে আরও একটা বিশ্বকাপে দেখা যেতেই পারে ব্রাজিলের নেইমারকে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে দুটি বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলা এমবাপের সম্পর্কে হয়তো আরও অনেক কিছুই আশা করা যায়।
এবারের বিশ্বকাপে শুধু পুরস্কার মূল্য ছিল (দল গুলির প্রাপ্য) ভারতীয় মুদ্রায় ৩ হাজার ৬৪৪ কোটি ৪১ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা।
কিন্তু আলো ঝলমলে এই বিশ্বকাপের চোখ ধাঁধানো জগতের বাইরে একটা অন্ধকার জগৎও আছে। পরিযায়ী শ্রমিক, মহিলা ও LGBTQA+ অর্থাৎ প্রায় সমস্ত প্রান্তিক নিপীড়িতদের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে, এমনকী স্পোর্টসওয়াশিং-এর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ আছে যে, কাতার অবৈধভাবে উপঢৌকন দ্বারা আয়োজন করার এই অধিকার পেয়েছিল।
নরওয়ের একটি ক্লাব এই বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে আধুনিক দাসত্ব ব্যবস্থা ও অস্বাভাবিক সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করে নরওয়েকে বিশ্বকাপ বয়কট করতে বলে। জার্মানির ফুটবল সংস্থাও এমনটাই তাদের মন্ত্রিসভা ও ইউএফা-কে জানায়। বয়কট না করলেও মানবাধিকারের পক্ষে তাঁদের খেলোয়াড়রা প্রচার করবে, এমনটা বলা হয়। বেলজিয়ামের ম্যানেজার সিএনএন- কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া বড়ো ভুল বলে ঘোষণা করেন। এমনকী বহুবার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত শেপ ব্লাটার (প্রাক্তন ফিফা সভাপতি)-ও এমনটাই মনে করেন। নরওয়ে অবশ্য বয়কট করে। বহু শহর, সংস্থা, ক্লাব এই বিশ্বকাপ বয়কট করেছে।
এদিকে সার্বিয়ার সমর্থকদের একাংশ ফ্যাসিস্ত স্লোগান দেয় আলবানিয়ার বিরুদ্ধে খেলার সময়। সুইৎজারল্যান্ডের ম্যাচেও সার্বিয়া বিতর্কে ছিল কসোভোজাত সমস্যা নিয়ে। আলবানিয়ার খেলোয়াড়ের জার্সিতে কসোভোজাত একটি শব্দের উপস্থিতিও বিতর্ক তোলে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে।
এদিকে ক্রোয়েশিয়ার সার্ব বংশোদ্ভূত কানাডার গোলকিপারের বিরুদ্ধে কানাডা ম্যাচে সার্বিয়ার সমর্থকরা রীতিমতো আক্রমণাত্মক স্লোগান দিচ্ছিলেন। আসলে ওই গোলকিপার নিজেকে ক্রোয়েশিয়ার নয়, ক্রাজিনায় জন্মানো খেলোয়াড় বলে দাবি করেন, যে ক্রাজিনার ওপর দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেছিল ক্রোয়েশিয়া, যার ফলে বহু সার্ব দেশ ছাড়ে। যাইহোক, দর্শকদের আচরণে বিরক্ত কানাডার অভিযোগে ক্রোয়েশিয়াকে ফিফা ৫০,০০০ সুইস ফ্রাঙ্ক জরিমানা করে।
এছাড়া কখনও ইরানের মহিলাদের সমর্থনে, কখনও ইউক্রেনের নামে, কখনও প্যালেস্তাইনের পতাকা নিয়ে মাঠে ঢুকে ম্যাচ থামিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার।
তবে পশ্চিমী মিডিয়া কম কিছু নয়। মিডল ইস্ট আই (দাবি করে কাতারের যদিও কাতার স্বীকার করে না) , একটি ফরাসি সংবাদপত্র ‘ল ক্যানা অসিনে’ (le canard enchaine) একটি কার্টুন ছাপায়। তাতে শ্রশ্মুগুম্ফ মণ্ডিত এক ব্যক্তি কাতারের জার্সি গায়ে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে জার্মানির Welt নামক টিভি চ্যানেল পর্তুগালকে হারানোর মরক্কোর খেলোয়াড়দের ধর্মীয় অভিবাদন জানানোর পদ্ধতিকে আইসিস-এর পদ্ধতি বলে দেয়। ওই চ্যানেলেই জার্মানির প্রাক্তন খেলোয়াড় জিমি হার্টউইং জাপানি দলকে বোঝাতে ব্যঙ্গ শব্দ উচ্চারণ, নকল করা অভিবাদন, ভাতের ডিপার্টমেন্ট বলা এইসব বর্ণবাদী কথাবার্তা বলে। ডেনমার্কের TV2 চ্যানেল ও De Volkstrant নামে একটি সংবাদপত্র মরক্কো খেলোয়াড়দের উদ্দেশে নানারকম বর্ণবাদী মন্তব্য চালিয়ে গিয়েছে।
এবারের বিশ্বকাপের সর্বাধিক বিখ্যাত ও বিতর্কিত ঘটনা হলো ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্স রেফারি (ভিএআর)-এর ব্যবহার। ভিএআর এবার বহু গোল নাকচ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে এতে খেলার স্বাভাবিক গতিও নষ্ট হয়েছে। ভিএআর’র বিতর্ক এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, উরুগুয়ের একজন ফুটবলার ভিএআর’র মনিটরে আঘাত পর্যন্ত করেছেন।
এতকিছুর পর চার বছর বাদে ৪৮ দেশের বিশ্বকাপ হবে ২০২৬ সালে। দেশের সংখ্যা বাড়লে কি নতুন দেশ দেখা যাবে? নাকি আগে যারা খেলেছে, এখন সুযোগ কম পায় তারাই আবার সুযোগ পাবে? নতুন বিশ্বজয়ী পাবে? নাকি পুরোনোরাই আবার জয়ী হবে? সবকিছুর উত্তরের জন্য অপেক্ষা চার বছরের।
কী পেলাম আমরা ভারতীয়রা? অন্য দেশের হয়ে গলা ফাটানো? তাদের জার্সি পরে আনন্দ? নিজেদের মধ্যে তর্ক - বিতর্ক?
একথা সত্যি যে, ফিফা এশিয়া ও আফ্রিকার ক্ষেত্রে অন্যায় বিভেদমূলক নিয়ম তৈরি করে। ইয়োরোপের মতো ওপেন কোয়ালিফাইং নিয়মে খেলা এশিয়া ও আফ্রিকায় হয় না। কিন্তু মনে রাখা উচিত গতি বস্তুর ভেতরেই থাকে। ফলে সংকট ভারতের নিজের মধ্যেই বর্তমান।
অপেশাদার মানসিকতা, অনুন্নত স্টেডিয়াম, বিপুল পরিমাণে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা, ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গা হিসেবে ক্লাব এবং ক্রীড়া সংস্থাকে ব্যবহার, সর্বোপরি অনৈতিক ও অবৈধ সুযোগ নেওয়া করপোরেট সংস্থা দ্বারা তৈরি হওয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রতিযোগিতা, যারা গভীরে প্রোথিত হওয়া ফুটবলের ঐতিহ্যকে উপড়ে ফেলে তার বাজার দখলের চেষ্টায় তৈরি করা প্রতিযোগিতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর ওপর আশু নিয়ন্ত্রণ ও অদূর ভবিষ্যতে সুশৃঙ্খল দেশব্যাপী প্রিমিয়ার লিগ চালু না করলে, বিশ্বকাপের আয়োজন করে বিশ্বকাপ খেলা ছাড়া কোনোভাবেই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উন্নীত হওয়ার উপায় নেই বললেই চলে।
যাই হোক, এবারের বিশ্বকাপ দেখালো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক, কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই ও দুই, করপোরেট মিডিয়ার অন্ধ আতঙ্কের বর্ণবাদী চেহারা। বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক ধ্বস ও সংকট যত বাড়বে এর প্রভাব আরও বাড়বে।
তবে এত কিছুর মধ্যে আশার কথা, ফিফার ইয়োরোপের প্রতি অতি - অনুরাগী ঘরানার নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ২০ বছর পরে বিশ্বকাপ ঢুকলো লাতিন আমেরিকায়। ২২তম বিশ্বকাপে এটাই পাওনা।