৫৮ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২৩ জুলাই, ২০২১ / ৬ শ্রাবণ, ১৪২৮
উত্তর প্রদেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আইন (খসড়া) সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ গত ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে প্রকাশিত উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকারের ‘জনসংখ্যা নীতি ২০২১-২০২২’-র অভিমুখ এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত প্রস্তাবিত আইনের খসড়া-এই দু’টির বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করেই দেশজুড়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। আসাম সরকারও একই আইন প্রণয়নের পথে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার আইন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এভাবে উত্তর প্রদেশের মানুষের ওপর রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জবরদস্তি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই। এই সামগ্রিক প্রবণতাকে ‘জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ভারসাম্য আনার জন্যই করা হচ্ছে’ এমন ভাষ্যের মোড়ক দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার পক্ষ। এই ভারসাম্য আনার লব্জ জনসংখ্যা নীতির ব্যাখ্যার বিষয়বস্তুতে আদিত্যনাথেরা রাখলেও খসড়া আইনে তা উল্লেখ করেনি। কন্যা ভ্রূণ হত্যায় বিশ্ব তালিকায় ওপরের দিকে থাকা ভারতের একটি বড়ো রাজ্যে এই ধরনের আইন পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন করে তুলবে বলে সিপিআই(এম)সহ বাম দলগুলি ইতিমধ্যেই তীব্র বিরোধিতা করেছে এই আইনের।
দেশের মধ্যে সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক অনুযায়ী, কেরালা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রয়েছে তালিকা শীর্ষে। সেখানে জন্মহার সর্বনিম্ন। কেরালা তা অর্জন করেছে সামগ্রিক উন্নয়নের পক্ষপাতিত্বহীন দৃষ্টিভঙ্গির স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে, জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা না চাপিয়েই। গত কয়েক দশক আগেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত যে ম্যালথুজিয়ান তত্ত্ব মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেই ব্যর্থ তত্ত্বে সওয়ার না হয়ে কেরালার মডেলকে কেন অনুসরণ করছে না উত্তর প্রদেশ, উঠছে সেই প্রশ্নও।
১৯৯৪ সালে মিশরের রাজধানী কায়রোতে জনসংখ্যা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে স্লোগান দেওয়া হয়েছিল ‘ডেভেলপমেন্ট ইজ বেস্ট কন্ট্রাসেপটিভ’ অর্থাৎ উন্নয়নই হলো সবচেয়ে ভালো গর্ভনিরোধক। এই স্লোগান ভারত সহ আরো ১৭৯ টি দেশ গ্রহণ করেছিল। অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী(১৯৯৮-২০০৪) থাকার সময় ভারত সরকারের জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ‘টার্গেট ফ্রি অ্যাপ্রোচ’ (লক্ষ্যহীন পন্থা), অর্থাৎ যা নাগরিক নিজেই স্বেচ্ছায় নির্বাচন করে নিতে পারবেন। আর মোদী জমানায় ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সুপ্রিমকোর্টে দাখিল করা পিটিশনে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক একটি এফিডেভিটে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরি এবং ভরতুকি না দেবার শর্তে সরকার ২ সন্তান নীতি বাধ্যতামূলক করবে না।... আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যায় সন্তানের সংখ্যা বেঁধে দেবার ক্ষেত্রে জোর খাটানো হলে হিতে বিপরীত হয় আর এবং এটা জনবিন্যাসকে বিপর্যস্ত করে। অথচ দিল্লির সরকার সুপ্রিম কোর্টে এহেন অবস্থান নিলেও উত্তর প্রদেশ এবং আসামের ক্ষেত্রে যে উদ্দেশ্যপূর্ণ নৈঃশব্দ্য বজায় রেখে চলেছে তা ওই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে উৎসাহিত করছে সংবিধান এবং দেশের আইনি অধিকার সমূহ লঙ্ঘন করার।
গত কয়েক দশক ধরে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত মোট ৩৫ টি’র মতো প্রস্তাব এবং প্রাইভেট মেম্বার বিল বা আইনের খসড়া প্রস্তাব দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং আইনসভাগুলিতে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগেই উত্তর প্রদেশে হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা পুরণের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি জনসংখ্যা নীতির ভিত্তিতে আনা সংখ্যালঘু বিরোধী এই প্রস্তাবিত দানবিক ‘উত্তর প্রদেশ পপুলেশন কন্ট্রোল স্টেবিলাইজেশন অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার ২০২১ বিল’ নাগরিক অধিকারের ওপর সবচেয়ে বড়ো আঘাত বলে মনে করা হচ্ছে।
এই আইনে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে এটিকে গরিববিরোধী, মহিলাবিরোধী এবং শিশুবিরোধী করে তোলার। নয়া উদারবাদের জমানায় যেখানে অসাম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে সেখানে নাগরিকের সাংবিধানিক এবং আইনগত ভাবে গ্যারেন্টি করা যে সমস্ত অধিকার রয়েছে সেগুলো থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা হচ্ছে। জন্মহারের ভিত্তিতে দেশে দু’ধরনের নাগরিক তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে।
জন্মহার বিষয়টি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচক যেমন দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, সাক্ষরতা এবং শিশু মৃত্যুর হারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ভারতে সরকারি তথ্য বলছে উচ্চ জন্মহার রয়েছে তপশিলি, উপজাতি, দলিত, মুসলিম এবং ওবিসি বা অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এই সমস্ত অংশের মহিলারা সামাজিকভাবে সবচেয়ে নিপীড়িত এবং দরিদ্র। এরা বিভিন্ন দিক থেকে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এই বিল কার্যকর হলে। তপশিলি জাতি এবং উপজাতিদের মধ্যে উচ্চ জন্মহার থাকার দরুন এই আইনে দেশের সংরক্ষণ ব্যবস্থা মার খাবে।
অদ্ভুতভাবে বলা হচ্ছে, যে সমস্ত বাবা মায়েদের ক্ষেত্রে দুই সন্তান নীতি লঙ্ঘিত হবে তাদের সরকারের বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে ছেঁটে ফেলা হবে এবং সরকারি চাকরির দরজা তাদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। এমনকি চাকরি ক্ষেত্রে তাদের পদোন্নতিও বন্ধ করে দেওয়া হবে যা আবার দেশের শ্রম আইনের বিরোধী একটা বিষয়। ওই খসড়া আইনের ধারা অনুযায়ী তাঁদের রাষ্ট্রের আইন ও নীতি অনুযায়ী বাসস্থান, শিক্ষা সহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তার যে ব্যবস্থা রয়েছে সেগুলো থেকে বঞ্চিত করা হবে। অর্থাৎ এই সমস্ত পরিবারের তৃতীয় সন্তানের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে প্রবেশাধিকার থাকবে না, সে মিডডে মিল পাবেনা। ওই পরিবারকে মাথাপিছু চারজনের হিসেবে রেশন দেওয়া হবে। এই আইন ভর্তুকিযুক্ত রেশন দেওয়ার ক্ষেত্রে খাদ্য নিরাপত্তা আইনের বিরোধী। এই আইনের একটা বিশেষ ক্লজ অনুযায়ী, অন্যান্য চালু আইনগুলি এই প্রস্তাবিত জনসংখ্যা আইনের কোনো জায়গায় বিরোধী হলে জনসংখ্যা আইনটিই বলবৎ হবে! সংসদে প্রণয়ন করা আইনকে কি ভাবে কোনো রাজ্যের আইন অতিক্রম করতে পারে তা নিয়ে বিস্ময় তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। দিল্লির সরকারের নীরব ভূমিকা এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, দিল্লির আপ সরকারের বাড়ি বাড়ি রেশন পৌঁছে দেবার প্রকল্প আইনকে যে খাদ্য নিরাপত্তা আইন বলে কেন্দ্রীয় সরকার নাকচ করে দিল, সেই কেন্দ্রীয় সরকারের মূল শক্তি বিজেপি শাসিত আরেকটি রাজ্যে একটি শিশুকে কিভাবে রেশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত করতে পারে খাদ্য নিরাপত্তা আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। কী করে একজন শিশু যে জন্ম নিয়েছে, শুধুমাত্র সেই জন্য তাকে শাস্তি দিতে পারে উত্তর প্রদেশ সরকার?
দেশের সরকারি সমীক্ষার বিভিন্ন সূত্র থেকে ১৭টি রাজ্যের জন্মহার সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে সেখানে সামগ্রিকভাবেই জন্মহার কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এই কমার হার মুসলিমদের (৩.৪ থেকে ২.৬) ক্ষেত্রে বেশি হিন্দুদের (২.৬ থেকে ২.১) চেয়ে।
চলতি আইন এবং ব্যবস্থার মধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক চলতি হারের উপর ভিত্তি করে জন্মহার সম্পর্কে আশার বাণী শুনিয়েছে কিছুদিন আগেই। মন্ত্রকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই হার সামগ্রিকভাবে ২০২৫ সালের মধ্যে ১.৯৩ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১.৮-এ নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের দেশে ঐতিহাসিকভাবেই মহিলাদের জন্মদানের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। দেশে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় বন্ধ্যাত্বকরণে সামগ্রিক পরিসংখ্যানে মহিলাদের অংশগ্রহণ বেশি, ৯৩.১ শতাংশ (ন্যাশনাল হেলথ মিশনের তথ্য)। সরকারি কর্মী বা তাঁর স্ত্রী যে কোনো একজনের বন্ধ্যাত্বকরণ করালে এই সুবিধা দেওয়া হবে বলা হয়েছে। উত্তর প্রদেশে এখন এই আইনের জেরে পদোন্নতি সহ সুদহীন ঋণ ইত্যাদি সুবিধা পেতে মহিলাদের বন্ধ্যাত্বকরণ এবং গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ পরীক্ষায় আরও বেশি করে বাধ্য করা হবে, ভ্রূণ হত্যার ক্ষেত্রেও আরও বেশি চাপ আসবে তাঁদের ওপর, এটা বলাই যায়।
অদ্ভুত বৈপরীত্যের বিষয় হলো ভিএইচপি এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত সহ নানা মাপের হিন্দুত্ববাদী নেতারা যেখানে হিন্দুদের আরো বেশি করে সন্তান উৎপাদনের মধ্য দিয়ে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন তখন এই বিল আনার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানের বৈপরীত্য এবং দেশাত্মবোধের বাগাড়ম্বর দুটোই প্রশ্নের মুখে।
সিপিআই(এম) সহ বামদলগুলি এবং সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি সহ বিভিন্ন গণ সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই এর বিরুদ্ধে লড়াই করে চলছে। এই পরিস্থিতিতে আরও তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।