৫৮ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২৩ জুলাই, ২০২১ / ৬ শ্রাবণ, ১৪২৮
ফোনে আড়িপাতার ঘটনায় উত্তাল দেশ
জবাব নেই মোদী-শাহ’র মুখে
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ইজরায়েলের কুখ্যাত সংস্থা এনএসও’র তৈরি স্পাইওয়্যার পেগাসাসকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, উচ্চ আদালতের বিচারপতি, বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, শিল্পপতি সহ তিনশতাধিক ব্যক্তির ফোনে আড়িপাতার গুরুতর অভিযোগে তোলপাড় দেশ। ভারত সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করার রণকৌশল নিলেও ফ্রান্স ইতিমধ্যেই সরকারি তদন্ত শুরু করেছে। বিশ্বের ১৭টি সংবাদ মাধ্যমের যৌথ অনুসন্ধানে সাংবাদিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিজ্ঞানী, সমাজকর্মীদের ফোনে আড়ি পাতার নির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার মিশেল বেচলেটও বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, যে অভিযোগ উঠেছে। তা যদি অংশত সত্যিও হয় তা সীমানা অতিক্রম করে গিয়েছে এবং নিয়মবিধির তোয়াক্কা না করেই। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, সম্পূর্ণরূপে বিপরীত অবস্থান নিয়ে তদন্তের পথে না গিয়ে উলটে অভিযোগ অস্বীকার করে যাচ্ছে কেন্দ্রের সরকার।
এই পরিস্থিতিতে আড়িপাতার ঘটনার যথাযথ তদন্তের পাশাপাশি সংসদের ভেতরে বাইরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। এই আড়িপাতার ঘটনায় সরকার যুক্ত নয়, এমনটা বোঝাতে কেন্দ্র যে যুক্তি হাজির করেছে তাতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠেছে। বিরোধীরা এই আড়িপাতাকে রাজনৈতিক চক্রান্ত বলেই আখ্যা দিয়েছে।
ফোনে আড়ি পেতে ভারতীয়দের উপরে বেআইনি নজরদারি চালানোর অনুমতি কে দিল তার জবাব চেয়েছে সিপিআই(এম)। ১৯ জুলাই পার্টির পলিট ব্যুরো এক বিবৃতিতে এই প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি পেগাসাস স্পাইওয়্যার কেলেঙ্কারি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, সাইবার স্পাই সফটওয়্যার ব্যবহার করে স্মার্টফোনে সরকারের আড়িপাতা ভারতীয় আইনে নিষিদ্ধ। তারপরেও কোন্ আইনে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিজের নাগরিকদের উপর এমন নজরদারি করল? ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে জানিয়ে দিয়েছে, গোপনীয়তার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, বিজেপি সরকার সেই সত্যকে মানতে নারাজ। গোপনীয়তা আইনকে সরকার নস্যাৎ করে দিচ্ছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, দেশের নাগরিকদের উপর নজরদারি চালানোর জন্য মোদী সরকার ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও’র পেগাসাস নামে একটি স্পাইওয়্যার বা ফোনে আড়িপাতার সফটওয়্যার ব্যবহার করেছে বলে অত্যন্ত উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। সাইবার নজরদারিতে বিশ্বে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এই এনএসও। ইতিমধ্যেই এনএসও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে সরকার ছাড়া কাউকে তারা তাদের পণ্য বিক্রি করে না। এবারের রিপোর্টের তথ্যে জানা যাচ্ছে, স্মার্টফোনে আড়ি পেতে নজরদারি চালানোর জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে এক বিশাল সংখ্যক সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীকে। সেই সঙ্গে এনএসও’র এই সফটওয়্যারের ক্রেতা যেসব দেশ তাদের নাম যেমন উঠে এসেছে, তেমনই জানা গিয়েছে ওই সব দেশে সব মিলিয়ে ৫০ হাজারের বেশি নজরদারির ঘটনা ঘটেছে। এই দেশগুলির মধ্যে ভারত ছাড়াও রয়েছে রোয়ান্ডা, মরক্কো, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমির শাহি, মেক্সিকো প্রভৃতি। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে যাঁদের ফোনে আড়িপাতা হয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছেন শ’য়ে শ’য়ে সাংবাদিক, সমাজকর্মী, বিরোধী রাজনীতিক, সরকারি আধিকারিক এবং নানা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কর্মকর্তা। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অন্তত ৪০ জন সাংবাদিকের নাম জানিয়েছে পেগাসাসকে ব্যবহার করে যাঁদের ফোনে আড়িপাতা হয়েছে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, দু’বছর আগেই সংসদে এ বিষয়ে উত্থাপন করেছিল সিপিআই(এম)। পার্টির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, হোয়াটসঅ্যাপ জানিয়েছে, ফোনে গোপনে নজরদারির জন্য ভারতে একটি বিপজ্জনক স্পাইওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে। তখন মোদী সরকার সরাসরি একথা বলেনি যে, এনএসও-র পরিষেবাকে সরকার কাজে লাগায়নি। শুধু এটুকুই সরকার দাবি করেছিল যে, কোথাও কোনও ‘অননুমোদিত নজরদারি’ চালানো হচ্ছে না। স্পষ্টতই মোদী সরকার নিজের নাগরিকদের উপর এমন নজরদারি চালানোর জন্য এনএসও-কে কাজে লাগিয়েছে। সরকারকে অবশ্যই জানাতে হবে যে, এনএসও-কে কী শর্তে কী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এরজন্য সরকারি তহবিলের কত অর্থ ওই সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে।
পলিট ব্যুরোর বিবৃতিতে এই সঙ্গেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, এর আগে বেশ কয়েকজন মানবাধিকার কর্মীর স্মার্টফোন এবং কম্পিউটার হ্যাক করার ঘটনা ধরা পড়েছে। তাঁদের যন্ত্রে নানা ‘নথিপত্র’ ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর দানবীয় আইনে তাঁদের গ্রেপ্তার করার জন্য সব নথিপত্রকে ব্যবহার করা হয়েছিল। পলিট ব্যুরো বলেছে, ফ্যাসিস্ত পদ্ধতিতে কর্তৃত্ববাদ প্রয়োগ করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যেতে পারে না। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে ‘আড়িপাতা প্রমাণ সাজানো ও গ্রেপ্তার করা’র নীতি নিয়ে চলেছে, তাতে ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকেই লঙ্ঘন করা হচ্ছে। বেআইনিভাবে এই সরকার ভারতীয় নাগরিকদের ওপর গোপনে নজরদারি চালাচ্ছে পেগাসাস সাইবার সফটওয়্যারের সাহায্যে। অবশ্যই এরজন্য জবাবদিহি করতে হবে সরকারকে।
প্রসঙ্গত, ইজরায়েলি স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে যে ৩০০ জন ভারতীয়র নাম তালিকায় রয়েছে তার মধ্যে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, তাঁর দুই রাজনৈতিক সহকারী, রাহুলের ব্যক্তিগত পরিসরের পাঁচ বন্ধুর নাম রয়েছে বলে জানা গেছে। রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ আনা শীর্ষ আদালতের এক কর্মী এবং তাঁর পরিবারের সদস্য, প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা প্রমুখের। এদের পাশাপাশি বিজেপি’র কয়েকজন নেতা ও সহকারীর নামও এই তালিকায় রয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দুই সদস্য অশ্বিনী বৈষ্ণব ও প্রহ্লাদ প্যাটেলের নামও রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ভারতের সাংবাদিকদের যে তালিকা রয়েছে তারমধ্যে ৮৫ শতাংশের ফরেনসিক পরীক্ষায় দেখা গেছে তাঁদের ফোন পেগাসাস-সংক্রমিত ছিল। এই সাংবাদিকদের মধ্যে দি ওয়্যার-এর সিদ্ধার্থ বরদারাজন, স্বাতী চতুর্বেদি, রোহিনী সিং, সুশান্ত সিং, বিজয়েতা সিং, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতাদের নাম রয়েছে। এদের কেউ রাফালে কেলেঙ্কারি, কেউ অমিত শাহের পুত্র জয়শাহের ব্যবসা, কেউ আম্বানিদের সম্পত্তি নিয়ে রিপোর্ট লিখেছেন। হিন্দুস্তান টাইমসের সহ সম্পাদক, পাঞ্জাবের পত্রিকার সম্পাদকও এই তালিকায় ছিলেন।
এছাড়াও এই তালিকায় রয়েছেন সমাজকর্মীরা। ‘দি ওয়্যার’ ওয়েবসাইট জানিয়েছে, নজরদারির তালিকায় উমর খালিদ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, বনজ্যোৎস্না লাহিড়ী, আম্বেদকরবাদী অশোক ভারতী, রেলকর্মী আন্দোলনের নেতা শিবগোপাল মিশ্র, দিল্লির অঞ্জনি কুমার, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সরোজ গিরি, ছত্তিশগড়ের শুভ্রাংশু চৌধুরী প্রমুখ সমাজকর্মীর নাম রয়েছে। বিশেষ করে ভীমা কোরেগাঁও মামলার অভিযুক্ত, তাঁদের আইনজীবী, আত্মীয়স্বজনদের ফোনে আড়িপাতা হয়েছে। এই মামলায় ইতিমধ্যেই ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর অজ্ঞাতেই কম্পিউটারে আপত্তিকর নথি ঢুকিয়ে দেবার প্রমাণ মিলেছে। আবার সেই নথিকেই হাতিয়ার করেই মামলা সাজানো হয়।
এছাড়াও সামনে এসেছে, কর্ণাটকে জনতা দল (এস)-কংগ্রেস সরকারকে যখন ফেলে দেবার অভিযান চলছিল, তখন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামীর ব্যক্তিগত সহায়কের ফোনেও আড়িপাতা হয়। এছাড়াও তালিকায় ছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার ব্যক্তিগত সহায়ক, উপ-মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস দলের জি পরমেশ্বরের নাম। শেষ পর্যন্ত ১৭ জন বিধায়ক শিবির বদল করায় সরকার পরিবর্তন হয়।
জানা যাচ্ছে, ভারতে ২০১৭ সাল থেকেই স্পাইওয়্যার ব্যবহার হচ্ছে। ২০১৭ সালে নরেন্দ্র মোদী ইজরায়েল যান এবং তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু’র সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক হয়। ইজরায়েল সরকারের অনুমোদন নিয়েই এনএসও তাদের স্পাইওয়্যার বিক্রি করে। দেখা যাচ্ছে, ভারতে ২০১৭ থেকে এই আড়িপাতার অত্যাধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০২১ পর্যন্ত ওই স্পাইওয়্যারের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে।