৫৮ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২৩ জুলাই, ২০২১ / ৬ শ্রাবণ, ১৪২৮
কমরেড শঙ্করাইয়া প্রজন্মের পর প্রজন্মকে কমিউনিস্ট শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে চলেছেন
জি রামাকৃষ্ণন
কমরেড এন শঙ্করাইয়ার শততম জন্মদিনে তাঁর বাড়িতে পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।
কমরেড এন শঙ্করাইয়ার জন্ম ১৯২২ সালের ১৫ জুলাই। এন এস নামেই তিনি বেশি পরিচিত, ২০২১ সালের ১৫ জুলাই শতবর্ষে পদার্পণ করলেন। রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, মতাদর্শগত, সংস্কৃতি সহ আরও বিস্তৃত ক্ষেত্রে তিনি এক বহুমুখী নেতৃত্বের ছাপ রেখেছেন।এক কমিউনিস্ট হিসেবে যেরকমটা বোঝায়, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এবং পারিবারিক জীবনে শঙ্কারাইয়ার জীবন ছিল সেইরকমই এক আদর্শস্থানীয়।
কৈশোরে এন এস আত্মসম্মান আন্দোলন এবং এর সমাজ সংস্কার ও নিরীশ্বরবাদের নীতিসমূহের দ্বারা আকৃষ্ট হন। তখন সময়টা ছিল স্বাধীনতার জন্য জাতীয় আন্দোলনের উত্থানের কাল। সেই সময়ে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই স্লোগান তুলেছিল পূর্ণ স্বাধীনতার। শঙ্করাইয়া রাজনীতির এই বিকাশধারাগুলিকে বিবেচনায় আনেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, অর্থনৈতিক সাম্যের সাথে জাতবর্ণহীন সমাজের দিকে সামাজিক পরিবর্তনই একমাত্র সমাধান। মার্কসবাদ একাই এই লক্ষ্যের অভিমুখে মানবতাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কলেজে পড়ার সময়েই সিপিআই(এম)-র সদস্য হন এন এস। সেটাই ছিল মাদুরাই জেলায় সিপিআই(এম)-র প্রথম শাখা।
রাজনৈতিক বন্দি
মাদুরাইয়ের আমেরিকান কলেজের ছাত্রসভার সভাপতি নির্বাচিত হন শঙ্করাইয়া। দ্রুতই তিনি সমগ্র রাজ্যের ছাত্র আন্দোলনের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রদের ওপর পুলিশের প্রাণঘাতী আক্রমণের বিরুদ্ধে তিনি ইংরেজিতে এক শক্তিশালী প্রচারপত্র লেখেন যা ব্যাপকভাবে প্রচার হয়। ওই প্রচারপত্রে সেই ঘটনার জীবন্ত বিবরণ লেখা হয়েছিল এই ভাষায়ঃ “মাথাগুলোকে চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়েছে, টুকরো টুকরো করে ভাঙা হয়েছে হাড়গুলোকে, আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রক্তের নদী বয়ে চলেছিল”। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র ১৫ দিন আগে এন এস-কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং তাঁকে জেলে পাঠায়। ১৮ মাস পরে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।
বহুবছর পর আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলামঃ “আপনার বাবার ইচ্ছা ছিল আপনি একজন আইনজীবী হবেন। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার এক পক্ষকাল আগেই আপনি গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। এর অর্থ দাঁড়ালো আর পড়াশুনো চালানো যাবে না, ডিগ্রি অর্জন করে আপনি আইনজীবী হতে পারবেন না। কেননা এটা জানা ছিল না যে, সরকার আপনাকে কখন মুক্তি দেবে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ যখন গ্রেপ্তার করল আপনার মনের অবস্থা কিরকম হয়েছিল ?” তাঁর জবাব ছিলঃ “স্বাধীনতার জন্য জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম বলেই গ্রেপ্তার হই এবং আমাকে জেলে পাঠানো হয়, এটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। অন্য কিছু ব্যাপারে আমি ভাবিত ছিলাম না।”
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর শঙ্করাইয়া পার্টির মাদুরাই জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ এই চার বছর পার্টির মাদুরাই জেলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় জেলাজুড়ে পার্টির নেতৃত্বে জনগণের জঙ্গি আন্দোলন সংগঠিত হয়।
শস্যদানা মজুতের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং শ্রমজীবী মানুষদের বেশ কয়েকটি লড়াইয়ের পর ১৯৪৬ সালে পি রামমূর্তি, এ বালসুব্রহ্মনিয়ম, এম আর ভেঙ্কটরামন, কে টি কে থঙ্গমনি এবং জানকি আম্মা’র মতো বিশিষ্ট নেতাদের সাথে শঙ্করাইয়া ফের গ্রেপ্তার হন। পার্টির এই নেতৃত্বদের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়। এটাই মাদুরাই ষড়যন্ত্র মামলা নামে বিখ্যাত। এই মামলায় অভিযুক্ত পার্টি নেতৃত্ব মুক্তি পান দেশের স্বাধীনতার একদিন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট।তাঁদের আসন্ন মুক্তির খবর ছড়িয়ে পড়ে, বিশাল জনতা তাঁদের অভিনন্দন জানাতে সমবেত হয়। পার্টির ডাকে সংগঠিত এক বিশাল সমাবেশে নেতৃত্বকে নিয়ে আসা হয়। সেখানে জনতা তাঁদের উঞ্চ অভবাদন জানায়।
জেল এবং আত্মগোপন
ঔপনিবেশিক শাসনে চার বছর এবং স্বাধীনতার পর কংগ্রেস শাসনে চার বছর, মোট আট বছর কমরেড শঙ্করাইয়ার এই শতবর্ষের জীবনে জেলে কাটিয়েছেন। এছাড়াও তিন বছর ছিলেন আত্মগোপনে। আন্দোলনের জন্য উৎসর্গীকৃত জীবনের এক দৃষ্টান্ত এন এস’র জীবন। যখন সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য পেনশন ঘোষণা করল, তখন কমরেড এন এস পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা নিতে অস্বীকার করেন। এ ব্যাপারে যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি খুব সরলভাবেই বলেছিলেন, “দেশের স্বাধীনতার জন্য জেলে গিয়েছি, এটাই পুরস্কার ছিল।” এরকমভাবেই তিনি বিষয়টার ব্যাখ্যা করেছিলেন।
আত্মগোপন এবং জেলজীবন ছিল খুবই কঠিন এবং বিধ্বংসী। মানসিক শক্তি এবং দৃঢতা ছাড়া কেউই এই ধরনের জীবনে অবিচল থাকতে পারেন না। তা’সত্ত্বেও, কমিউনিস্টরা সাহসের সাথেই এইসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। যখন রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে এন এস ভেলোর জেলে, তখন তিনি বন্দিদের এ এবং বি ক্যাটেগরিতে ভাগ করে রাজনৈতিক বৈষম্য (কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট বন্দিদের মধ্যে) তৈরির প্রতিবাদে অন্যান্য কমিউনিস্ট বন্দিদের সাথে অনশন করেছিলেন। অনির্দিষ্টকালের অনশনের দশম দিনে জেল সুপারিনটেনডেন্ট যখন কারাগার পরিদর্শনে আসেন তখন তিনি এন এস’কে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ পড়তে দেখে অবাক হয়েছিলেন। দশদিন অনশনের পরও কমিউনিস্টদের মানসিক শক্তি দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে যান।
পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদক
১৯৫৩ সালে অবিভক্ত পার্টির রাজ্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন এন শঙ্করাইয়া। সিপিআই(এম) গড়ে ওঠার আগে অবিভক্ত পার্টির জাতীয় পরিষদের সভা থেকে যে ৩২ জন বেরিয়ে এসেছিলেন এন এস ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৫ সালে সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্পাদক হিসেবে সেই সময়ে রাজ্যে উদ্ভূত ইস্যুগুলিতে তিনি দ্রুত হস্তক্ষেপ করতেন।
১৯৯৮ সালে কোয়েম্বাটোরে বোমা বিস্ফোরণ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, যা ২৪ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। শঙ্করাইয়া কমরেড উমানাথকে এই সঙ্কটে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করেন। এন এস মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে আরজি জানান, এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনায় যারা দায়ী তাদের গ্রেপ্তারের সাথেই সারা রাজ্যে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।এন এস বলেন, সিপিআই(এম) কোয়েম্বাটোরের ঘটনায় খুবই উদ্বিগ্ন। এই শহর শ্রমজীবী মানুষদের একটা কেন্দ্র। তিনি সরকারকে আরজি জানান, এই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে; এরা শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যকে ধ্বংস করতে চাইছে।
উনিশশো নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয় অর্ধে তামিলনাডুর দক্ষিণের জেলাগুলিতে জাতিগত সংঘর্ষ দেখা দেয়। এর পরিণতিতে বহু জীবনহানি এবং সম্পত্তি ধ্বংসের মতো বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে। কমরেড শঙ্করাইয়ার অনুরোধে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধি সর্বদল বৈঠক ডাকেন। কমরেড এন এস’র সঙ্গে আমি দু’দিনের ওই বৈঠকে অংশ নিয়েছিলাম। সভার কার্যপ্রণালীতে দৃঢ়তার সাথে হস্তক্ষেপ করে এন এস ঘোষণা করেনঃ সিপিআই(এম) গোরস্থানের শান্তি চায় না। আমরা যে মূল স্লোগান উত্থাপন করেছি তার ভিত্তিতেই সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সামাজিক সংগঠনসমূহ এই প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকা পালন করুক। আমাদের স্লোগান হলোঃ “অস্পশ্যতার অভিশাপকে নির্মূল করো, বন্ধ হোক জাতিগত সংঘর্ষ, জনগণের ঐক্যকে রক্ষা করো”। এন এস’র দেওয়া পরামর্শকে মুখ্যমন্ত্রী স্বাগত জানান। এর ওপর ভিত্তি করে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে বিভিন্ন জেলায় অস্পৃশ্যতা-বিরোধী সম্মেলন সংগঠিত হয়। শঙ্করাইয়া এই সম্মেলনগুলিতে অংশ নেন এবং জনগণের উদ্দেশে বার্তা দেন। এটা বলা অতিশয়োক্তি হবে না যে, এন এস এই স্লোগানকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং রাজ্যের অবস্থা স্বাভাবিক করতে তাঁর উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বিধায়ক হিসেবে কমরেড শঙ্করাইয়া
তামিলনাডু বিধানসভায় শঙ্করাইয়া তিনবার নির্বাচিত হন। বিধানসভায় প্রথমবার পার্টির উপনেতা এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার পার্টির নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন বিধায়ক হিসেবে তাঁর ভূমিকাকে সবাই শ্রদ্ধা করতেন এবং শিক্ষা, প্রশাসন ও আদালতে তামিল ভাষা ব্যবহারে তিনি বিশেষ জোর দিতেন।
তামিলনাডুতে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলায় কমরেড এন এস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সারা ভারত কৃষক সভার তামিলনাডু রাজ্য কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সারা ভারত কৃষক সভার সর্বভারতীয় সভাপতি এবং সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘জনশক্তি’র সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সিপিআই(এম) গড়ে ওঠার পর পার্টির দৈনিক পত্রিকা ‘থিক্কাথির’-এর সম্পাদকের কার্যভার সামলান। সমসাময়িক শিল্প, সাহিত্যের বিকাশধারার প্রবণতার ওপর গভীর পর্যবেক্ষক হিসেবেও এন এস পরিচিত ছিলেন। তামিলনাডু প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স ইউনিয়ন গড়ে তোলায় তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ইউনিয়নের সম্মেলনে তাঁর বক্তব্যে এন এস সাহিত্যের আঙ্গিক এবং বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে তাঁর গভীর বোঝাপড়ার বিষয়টা তুলে ধরেন এবং তা সকলের দ্বারা গৃহীত হয়।
এন এস তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও গণতান্ত্রিক আদর্শগুলিকে ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগ করে গেছেন। শুধু জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ বিরোধিতাই ঘোষণা করেননি, তিনি ব্যক্তিগত জীবনেও নিজের ধর্ম ও বর্ণের বাইরের একজনকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁর বর্ধিত পরিবারে বহু অসবর্ণ বিবাহ হয়েছে। এসবে এন এস’র বিরাট ভুমিকা ছিল।
কমরেড এন শঙ্করাইয়ার জীবন প্রজন্মের পর প্রজন্মের কমিউনিস্ট কর্মীদের অনুপ্রাণিত করবে এবং পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
ভাষান্তরঃ শংকর মুখার্জি