৫৮ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২৩ জুলাই, ২০২১ / ৬ শ্রাবণ, ১৪২৮
কমরেড কে জি বসু’র জন্মশতবর্ষ
মধ্যবিত্ত কর্মচারী আন্দোলনে শ্রেণিচেতনা
শিশির কুমার রায়
কমরেড কৃষ্ণ গোপাল বসু’র জন্ম ৭ জুলাই, ১৯২১ সালে। তৎকালীন সময়ে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁকে বড়ো হতে হয়েছে। কখন যে তাঁর পোশাকি নাম কৃষ্ণ গোপাল বসু থেকে কে জি বসু হয়ে উঠলো সেটা জানা নেই। শৈশবে পিতৃবিয়োগের জন্য তাঁকে পরিবারের সব দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাঁর পরিবারের অনুজ অনেকেই তৎকালীন সময়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালে ১১ ডিসেম্বর তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।
আজ ভারতের প্রায় প্রতিটি বড়ো শহরে তাঁর অনুগামীরা আন্দোলনের কেন্দ্র হিসাবে কে জি বসু ভবন তৈরি করেছেন এবং সেখান থেকে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করছেন। এমন ঘটনা সাধারণত আগে দেখা যায়নি। যিনি মাত্র ৫৩ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন, তাঁর প্রতি এত গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেশব্যাপী শ্রমিক কর্মচারীদের মনে কী করে গড়ে উঠেছিল, সেটা সত্যিই বিবেচনার বিষয়।
কে জি বসু ১৯৪৬ সালে পরাধীন দেশে একটি সর্বভারতীয় ধর্মঘটে অন্য অনেকের সঙ্গে বিশেষত, কমরেড ভূপেন্দ্রনাথ ঘোষ (দাদা ঘোষ) এর সঙ্গে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এই সময় কমরেড কে জি বসু পশ্চিমবঙ্গে ডাক তার বিভাগে কাজ করতেন। ১৯৪৬ সালের ধর্মঘট সম্পর্কে সরকারি বিবেচনায় আছে যে ‘‘অন জুলাই ১৯৪৬ মেজরিটি অব দ্য স্টাফ ওয়েন্ট অন স্ট্রাইক। দে রিমেনড অন স্ট্রাইক টিল, ১৯৪৬ অগাস্ট ৭। অল এক্সচেঞ্জ হ্যাড টু বি সাট ডাউন অ্যান্ড দিস সিরিয়সলি এফেকটেড দ্য ডেলি লাইফ অফ দি সিটি অ্যান্ড ব্রট অ্যাবাউট দ্য ডিসকনটেনমেনট।’’
এই ধর্মঘট শুধুমাত্র কলকাতা শহরে হয়নি। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এই ধর্মঘট। বোম্বের পোস্টম্যানদের কিছু দাবির সমর্থনে এই ধর্মঘট ডাকা হলেও, দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই দেশব্যাপী হরতাল ও সাধারণ ধর্মঘটে পর্যবসিত হয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এই ধর্মঘট ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে পড়ে। শ্রমিক আন্দোলন, এই ধর্মঘট তৎকালীন সময়ে ক্রান্তিকারী ভূমিকা পালন করেছে। কমরেড ভূপেন্দ্রনাথ ঘোষ ও ২৫ বছরের যুবক কমরেড কে জি বসু আরও অন্য অনেকের সঙ্গে এই ধর্মঘটে উজ্বল ভূমিকা পালন করেন। কে জি বসু’র সঙ্গে কলকাতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন কমরেড সমর দত্ত, কমরেড সত্য দত্ত প্রমুখ।
ভারত স্বাধীনতা পেল ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে। স্বাধীন ভারত সরকার তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৯ সালে ডাক তার কর্মচারী আন্দোলনে এক আঘাত নেমে আসে, নেতৃত্বের এক অংশকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। কমরেড কে জি বসু, মনি বসু, সমর দত্ত, সত্য দত্ত, শচীশ বিশ্বাস ও অনিমা মুন্সীকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। পরবর্তীকালে কে জি বসু চাকুরি ফিরে পেলেও তিনি সেটা গ্রহণ করেননি। তিনি সংগঠন ও আন্দোলন পরিচালনা করার দায়িত্ব নিজে থেকে গ্রহণ করেন।
শতবর্ষের আলোকে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান বিবেচনায় আনতে গেলে কয়েকটি বিষয়কে নজরে আনতে হবে। পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ সহ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনগুলি নিজ নিজ দপ্তরে চলছিল। এই সময়ে রাজ্য সরকারি কর্মচারী, শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবির আন্দোলন, বিমা, ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের আন্দোলন প্রবলভাবে সংগঠিত হচ্ছিল। মধ্যবিত্ত কর্মচারীদের এই আন্দোলনগুলিকে শ্রেণিচেতনা দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে ভূমিকা পালন করেন কমরেড কে জি বসু।
মধ্যবিত্ত কর্মচারীদের শ্রেণি সচেতন আন্দোলন সারা পশ্চিম বাংলার গণআন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম ও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই কাজে কমরেড কে জি বসু’র ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এর ফসল পশ্চিমবাংলার ১২ জুলাই কমিটি গঠন। গণ আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য ওই তারিখে ১৯৬৬ সালে গঠিত হয় আন্দোলনের এই যুক্ত মঞ্চ। তৎকালীন রাজনৈতিক কারণে পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক দলগুলি গণ আন্দোলন তৈরিতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। নবগঠিত যুক্ত আন্দোলনের মঞ্চ ১২ জুলাই কমিটির মধ্য দিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়।
দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে থাকা তাঁর নামাঙ্কিত স্মৃতিভবনগুলো শ্রেণি আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্র হিসাবে কাজ করছে।
বর্তমান এই অতিমারী পরিস্থিতিতে দেশের সর্বত্র তাঁর চিন্তা ও কর্মকাণ্ডকে শ্রেণি সচেতনভাবে প্রসারিত করার কাজ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। অতিমারী পরিস্থিতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে রুজিরোজগার জীবনধারণের ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। এর বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে শ্রমিকশ্রেণি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে জনসাধারণের কষ্ট লাঘবের আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সর্বক্ষেত্রেই সরকারের ভূমিকা অপ্রতুল ও দিশাহীন। শিক্ষাব্যবস্থা, গণবণ্টন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিষেবা সব ক্ষেত্রেই নৈরাজ্য চলছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীরা সর্বশক্তি দিয়ে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে। আমরা যারা কর্মচারী আন্দোলনের কর্মী তারাও এই পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যস্ত রয়েছি। অতিমারীর এই পরিস্থিতিতেও কমরেড কে জি বসু’র দেওয় চেতনা আমাদের উদ্বুদ্ধ করছে। আমরা আশাকরি এই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে কমরেড কে জি বসু’র আদর্শবোধ ও চেতনার দ্বারা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারব।
এ কথা স্মরণে রাখা দরকার যে, শ্রমজীবী মানুষের বিরূদ্ধে যারা, তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপব্যবহার করে দেশের সাধারণ মানুষকে একই ছাঁচে ঢেলে (drilling human being into uniformity) আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে কে জি বসু’র জন্মশতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আমাদের কিছু করণীয় কাজ আছে। জনসাধারণের স্বাধীন ও শ্রেণিসচেতন চিন্তাকে প্রসারিত করাই হবে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। এ কাজে যেন আমরা বিরত না হই।