E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২৩ জুলাই, ২০২১ / ৬ শ্রাবণ, ১৪২৮

ঋণের জালে অধিকাংশ রাজ্যবাসী

ঈশিতা মুখার্জি


২০০৭-০৮ সালের বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটের কথা আপনাদের নিশচয়ই মনে আছে? সঙ্কটের শুরু ছিল ঋণের ফাঁদে দেশবাসীর জড়িয়ে পড়াকে কেন্দ্র করে। আসলে কথাটা এভাবে বললে ভালো হয় যে, ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলা হয়েছিল নানা অছিলায় মানুষকে। আগ্রাসী লগ্নিপুঁজি তার মুনাফাকে বাঁচানোর জন্য এক সঙ্কট থেকে বাঁচতে অন্য সঙ্কট তৈরি করতে করতে যা তৈরি করেছিল তা হলো সাব প্রাইম সঙ্কট যা সারা দুনিয়াতে মহামন্দার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। অতিমারীতে জর্জরিত দুনিয়াতে ২০২১ সালে এই সঙ্কটের কথা কীভাবে প্রাসঙ্গিক? প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে, পুঁজিবাদী দুনিয়া যখন এই অতিমারীর ফলে ভীষণ জোরে এক ঝাঁকুনি খেল, সারা পৃথিবীর উৎপাদনের বৃদ্ধির হার কমতে কমতে মহামন্দায় ডুবতে শুরু করল, তখন নানাভাবে বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলি নিজেদের দেশের নাগরিকদের আর্থিক অধঃপতনের হাত থেকে তুলবার চেষ্টা করছে হয় আর্থিক অনুদান দিয়ে নয় ঋণ দিয়ে। আর্থিক অনুদান দিয়ে যারা আর্থিক সঙ্কট দূর করার কথা বলছে, সেখানে পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিশেষ করে আগ্রাসী পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সরকার বা রাষ্ট্রের দায়ভারের প্রশ্ন উঠে আসছে। কিন্তু আগ্রাসী পুঁজিবাদ চলেছে ঋণদানের পথে। বেকার অভুক্ত দেশবাসীকে বরাদ্দ করছে সরকারি ঋণ। অতিমারীর সময়ে যে মন্দা আমরা দেখছি তা বিশ্বের মহামন্দার লেজ ধরে এগিয়ে চলেছে। আর এই মহামন্দার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঋণের দায়ভার, আন্তর্জাতিক লগ্নিপুজির হাত ধরে ঋণের দায়ভার। বিশ্বপুঁজির কাছে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে দেশগুলি, বিশেষ করে উন্নতশীল দেশগুলি। সেই ঋণের বোঝা তারা তাদের নাগরিকদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।আমাদের দেশের সরকার এই নীতির বাইরে নয়। আর আমাদের রাজ্যের সরকার অর্থাৎ তৃণমুল কংগ্রেসের সরকার তো কখনই মোদী সরকারের থেকে ভিন্ন আর্থিক নীতি গ্রহণ করে নি, উলটে অনেক নীতি মোদী সরকার গ্রহণ করার আগেই আমাদের রাজ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। সারা বিশ্বে ঋণের পরিমাণ বিশ্ব উৎপাদনের প্রায় ১২৪ শতাংশ। এত পরিমাণ ঋণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হয়েছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পরিস্থিতি কী? আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ২০২০ সালেই জানিয়েছিল যে, দেশের জাতীয় উৎপাদনের মধ্যে ঋণের অংশ এক বছরের মধ্যে ৭৪ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সকলেই এর মধ্যে জেনে গেছেন যে, অনাদায়ী ঋণের ভার এ দেশে অনেক বেশি এবং এই অনাদায়ী ঋণের মধ্যে বেশির ভাগ হলো অসাধু চক্র। ঋণের বোঝা ৯৯ শতাংশে পৌঁছে যাবে বলে তখন আশঙ্কা করা হয়েছিল। এবার বোধহয় বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, অতিমারী থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি কোন্ ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এবং আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

দেশের কাজ হারানো মানুষ এমনিতেই বাধ্য হয়েছেন এই পরিস্থিতিতে মহাজনের কাছে চড়া সুদের হারে হাত পাততে। এ বিষয়ে সরকার বিশেষ তথ্য বা পরিসংখ্যান না দিলেও নানা গণমাধ্যমে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতেই অর্থনীতিবিদেরা জানতে পারেন যে, দেশের গরিব মানুষ অতিমারীর ফলে এমনিতেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এরকম দরিদ্র পরিবারের কথাও জানা যায় নানা বিক্ষিপ্ত সমীক্ষা থেকে, যারা পরপর ঋণ নিতে নিতে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে ফেলেছে মহাজনের কাছ থেকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকায়, অতিমারীর চিকিৎসার খরচ বাড়ায় ঋণগ্রস্ত হওয়া ছাড়া বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় ছিল না বা থাকছে না গরিব, দিন আনি দিন খাই পরিবারগুলির কাছে। অর্থনীতিবিদেরা বলেন যে, যেই দেশগুলিতে আর্থিক বৈষম্য বেশি, সেই দেশে গরিব মানুষের ঋণগ্রস্ততা খুব বেশি। ভারত এরকম একটি দেশ। তাই আমাদের দেশে এই চিত্র দেখা যায়। আমাদের দেশে এখনও অনেক মানুষ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার বাইরে রয়েছেন। তাঁদের কাছে বেঁচে থাকার জন্য মহাজনের ঋণ ছাড়া আর কী উপায় আছে? এর সাথে যুক্ত হয়ে গেছে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি।

আমাদের রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্য সরকার কোনো তথ্য জানায় নি, বার্ষিক বাজেটেও কিছু জানা যায় নি গরিব মানুষের ঋণগ্রস্ততা নিয়ে। এক বেসরকারি সমীক্ষা হয়েছিল পুরুলিয়ার উপজাতি, আদিবাসী কৃষক পরিবারগুলির মধ্যে। সেই সমীক্ষায় ২০২০ সালেই জানা যায় যে, তাঁরা অর্ধেক দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং বাঁচার জন্য ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন। বেশ কিছু ফসল নষ্ট হয়েছে দাম না পেয়ে। মহাজনের ঋণের সুদের বোঝা মাঝে মাঝে আসলের ৮০ শতাংশও হয়ে যায়। এরকম কথাও তাঁরা বলেছেন। এই অংশের রাজ্যবাসী কিষান সম্মান নিধি প্রকল্প, প্রচেষ্টা প্রকল্প, বা একশ, দিনের কাজ প্রকল্প ইত্যাদি কোনো প্রকল্পেরই সাহায্য পান নি। দরিদ্রতম অংশ নির্ভর করেছে সেই ঋণের উপর। এক সময়ে পাওয়া পাট্টার জমিও খেড়িয়া, শবর পরিবারগুলি বন্ধক রেখে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে। কয়েকজন মাত্র ২ কিলো করে চাল পেয়েছেন। কিন্তু সমীক্ষায় প্রকাশ যে, একেবারেই তা সকলের ক্ষুধা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এই মুহুর্তে পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা যে বিপর্যয়ের সামনে পড়েছে, তা তাঁরা অতীতে পড়েন নি। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নেই, সরকার প্রয়োজনীয় ফসল সংগ্রহ করছে না, অনেক কৃষকের কাছে তাই আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ থাকছে না। ফসলের দাম না পেয়ে ফসল পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

মুখ্যমন্ত্রী বা দেশের অর্থমন্ত্রী কোভিড পরিস্থিতিতে সাহায্যের যে হাত বাড়ালেন, তার প্রতি একটু খেয়াল করুন। সবটাই অর্থাৎ গোটাটাই ঋণ। প্রথমত, এই বিষয়ে সরকারি নির্দেশনামা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে না পাঠালে, তাদের মুখের কথা মুখের হয়েই থাকবে, কার্যকর হবে না। দ্বিতীয়ত, বেকার বিপর্যস্ত মানুষ ঋণ নিলে কবে কিভাবে শোধ দেবেন তাঁরা? এক ঋণ শোধ দিতে তাঁরা অন্য ঋণ নেবেন না তো? একটা ঋণের পর অন্য ঋণ - এইভাবে শেষ পর্যন্ত্ তাঁরা সেই চড়া সুদে মহাজনের কাছেই চলে যাবেন না তো? ছাত্রছাত্রীদের ক্রেডিট কার্ড একইরকমভাবে বিপজ্জনক। কিভাবে শোধ দেবেন তাঁরা এই ঋণ যদি কর্মসংস্থান না হয়? মূল সঙ্কটের দায়ভার কী এইভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না?

অনেক অর্থনীতিবিদেরা বলেছিলেন, সাধারণ ন্যূনতম আয় বা ইউনিভার্সাল বেসিক আয়ের কথা যা রাষ্ট্রকে দায় নিতে হবে। বামপন্থীরা বলেছিলেন, আয়করের আওতার বাইরে মানুষদের হাতে ৭৫০০ টাকা তুলে দেওয়ার কথা। ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তিদানের কথাও উঠেছিল। কিন্তু সে পথে না হেঁটে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়েই বিপর্যস্ত কাজ হারানো, অভুক্ত মানুষদের ঋণদান করতে তৎপর হয়ে উঠল। এর মধ্যেই সারা পৃথিবীর অভিজ্ঞতা এটাই বলছে যে, এর ফলে আরও বেশি অসাম্য, আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, অতি ধনী কর্পোরেট পুঁজি লাভবান হয়। এটাই তো তাহলে ঘটতে চলেছে আমাদের রাজ্যেও? এই সর্বনাশা নীতির বিকল্প নীতি কী ছিল না? ঋণগ্রস্ত মানুষকে আরও ঋণের জালে জড়িয়ে দেওয়া হবে পরিকল্পনামাফিক? পৃথিবীতে এই নিয়ে নানা আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে এবং রাষ্ট্রকে আরও সমাজতান্ত্রিক পথে হাঁটার প্রশ্নটি একাধিক দেশে উঠে এসেছে। বিতর্ক হোক, আলোচনা হোক এ বিষয়ে - কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পথে না হাঁটলে কোনো আলোচনা সম্ভব হয় না। বর্তমানে কর্পোরেট পুঁজি সেই গণতন্ত্র চায় না। তারাই নিয়ন্ত্রণ করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিদান এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর সমাধান সূত্র। মানুষের জণকল্যাণের কথা, বিকল্প অর্থনীতির জন্য তাই মানুষের আন্দোলনের নেতৃত্বে বামপন্থীদেরই পথে থাকতে হবে। এটাই ভবিতব্য।